প্রকাশিত:শুক্রতিবার,২৩ অক্টোবর ২০২০ইং ।। ৭ই কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)।। ৫ই রবিউল আউয়াল,১৪৪২ হিজরী
বিক্রমপুর খবর : মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি : চারণ সাংবাদিক, ভাষা সৈনিক ও মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সফিউদ্দিন আহম্মেদের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে স্বরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের আয়োজনে প্রেসক্লাব ভবনের সফিউদ্দিন আহমেদ মিলনায়তনে এ স্বরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় বক্তারা সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমেদের কর্মময় জীবনের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।
মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বলের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ খোকার সঞ্চালনায় স্বরণসভায় বক্তব্য রাখেন প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শহীদ-ই-হাসান তুহিন, কাজী সাব্বির আহমেদ দিপু, প্রবীন সাংবাদিক শেখ আলী আকবর, প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি গোলজার হোসেন, সহ-সভাপতি মোঃ মাসুদুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ চাকলাদার মোঃ তানজিল হাসান, সাহিত্য সম্পাদক সুমন ইসলাম, কার্যকরি সদস্য মাহবুবুর রহমান লিটন ।
আরো উপস্থিত ছিলেন প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মোঃ শিমুল, তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক জুয়েল রানা, প্রচার সম্পাদক আরাফাতুজ্জামান বাবু, ক্রীড়া সম্পাদক নাদিম মাহমুদ, সাংবাদিক নজরুল ইসলাম ছোটন, আবু সাইদ সোহান, মাসুদ রানা, শেখ মোঃ রতন, শুভ ঘোষ, সাজ্জাদ হোসেন, আরাফাত রায়হান সাকিব, আবু সাঈদ, মৃদুল হোসন, রবিন হোসেন।
স্বরণসভায় দোয়া মোনাজাত ও এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
উল্লেখ,যে ভাষা সৈনিক,সাংবাদিক,ছাত্রনেতা ও চারণ সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমদ বিক্রমপুরের লৌহজং উপজেলার হাড়িদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ।
তিনি ১৯৪৮ সালে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক থাকাবস্থায় বাংলা মাতৃভাষা জন্য রাজপথে আন্দোলনে অংশ নেন এবং কারাবরণ করেছেন একাধিকবার।
১৯৫২-৫৩ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় সফিউদ্দিন আহমদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েও তিনি কারাবরণ করেন। এর ফলে তিনি ভাষা সৈনিক হিসেবে উপাধি পান।
১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের প্রথম দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল মনসুর আহমদ ও কফিল উদ্দিন চৌধুরীসহ যে ১৭ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল তাঁদের মধ্যে সফিউদ্দিন আহমেদ একজন।
পত্রিকা বিক্রি ও পড়া থেকেই তার মনে রাজনীতির সঙ্গে সাংবাদিকতা করার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় বিক্রমপুরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সংবাদ লিখে পাঠাতেন। ব্রিটিশ আমলের তেভাগা আন্দোলনসহ নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় কৃষক সভার জাতীয় সম্মেলনে সফিউদ্দিন আহমদ বিক্রমপুর কৃষক সভার কর্মী হিসেবে জিতেন ঘোষের সঙ্গে যোগদান করেছিলেন।
দেশ স্বাধীন হবার পরে তিনি সর্বদাই ক্ষমতাসীনদের বিরোধীতা করেছেন। কখনও ন্যাপ ভাসানী, কখনও কমিউনিস্ট পার্টি ও মোজাফফর আহমদের ন্যাপ এ থেকে রাজনীতি করেছেন। সংসদ নির্বাচনে তিনি একাধিকবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন কারাগারে বিভিন্ন মেয়াদে মোট ১০ বছর জেলজীবন এবং ১৩০ দিন অনশনে কাটান তিনি।
তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় সিপিআই বা কমিউনিটি পার্টি অব ইন্ডিয়ার সাপ্তাহিক মুখপত্র জনযুদ্ধ কলকাতা থেকে এবং ইংরেজি ভার্সন বোম্বে থেকে প্রকাশিত ‘পিপলস ওয়ার’ পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়ে সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করেন।ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পূর্বে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ, দৈনিক মিল্লাত, আমার দেশ এবং সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তীকালে দৈনিক বাংলা), অবজারভার (পাকিস্তান), দৈনিক ইত্তেফাক, মর্নিং নিউজ প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেন।
এছাড়া, একজন সংবাদকর্মী হিসেবে অনেক সংবাদ সংস্থার সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তার মধ্যে ইউপিপি, এনা, এপিপি, বিএসএস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সাংবাদিকতা চালিয়ে যান। দৈনিক বাংলায় থাকা অবস্থায় তিনি দৈনিক জনতার ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া দেশ- বিদেশের আরো অনেক সংবাদপত্র এবং সংস্থাসমূহে কাজ করেছেন।
শুধু সাংবাদিক হিসেবেই নয়, সংগঠক হিসেবেও তিনি ছিলেন দক্ষ ও কঠোর পরিশ্রমী। তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ১৯৬১ সালে তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির বহুবার সভাপতি হন। মফস্বল সাংবাদিকদের ন্যায্য বেতন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন তিনি।
এছাড়া, তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য এবং মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও বিক্রমপুর প্রেসক্লাবের সভাপতিসহ বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
১৯৮৭ সালে ভারতে অসমের গোয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত অল অসম জার্নালিস্ট কনফারেন্সে তাকে প্রধান অতিথি করে, পরে অসম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্মাননা প্রদান করেন।এছাড়া, সাংবাদিকতায় অবদান রাখায় ১৯৯৯ সালে জনকণ্ঠ প্রতিভা সম্মাননা’, ২০০২ সালে মাওলানা মনিরুজ্জামান (চট্টগ্রাম) স্বর্ণপদক, মওলানা ভাসানী স্বর্ণপদক, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া পদক পান। বাংলাদশে সুফি পরিষদ-২০০৬ পদক ও অতীশ দীপঙ্কর পদকসহ আরও গুণীজন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের বিখ্যাত চারণ সাংবাদিক এবং বিক্রমপুরের কৃতিসন্তান হিসেবে ২০০০ সালে ভারতের কলকাতায় বিক্রমপুর সম্মেলনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা প্রদান করেন।
এছাড়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারদলীয় জোট সরকারের সময় বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকা অবস্থায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে ২০০৬ সালে এক সুফি সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বন্দি থাকা রাজবন্দী সফিউদ্দিন আহমদকে সম্মাননা ও পদক প্রদানসহ জায়নামাজ ও তসবি প্রদান করেন।
বিক্রমপুরের এই সংগ্রামী কৃতি সন্তান ও মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, ছাত্রনেতা এবং ভাষা সৈনিক সফিউদ্দিন আহমদ ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানের পারিবারিক কবরে তাকে সমাহিত করা হয়।
আজীবন সংগ্রামী, আপোষহীন ছাত্রনেতা, ভাষা সৈনিক ও চারণ সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমদ তার ত্যাগ ও আদর্শের জন্য অমর হয়ে থাকবেন।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’