জানা গেছে, যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেফতার তারা মিয়া গত ১০ বছর ধরে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাতা উত্তোলন করে আসছেন। এর মধ্যে গত পাঁচ বছর ধরে ৩০ হাজার টাকা করে মাসিক ভাতা উত্তোলন করছেন। এর আগে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে পেয়েছিলেন। এ ১০ বছরে তিনি মুক্তিযোদ্ধার ভাতা হিসেবে প্রায় ৩০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। ১০ বছর আগে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার শাহ নেওয়াজের পুত্র মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়ার (মুক্তিযুদ্ধ নাম্বার ৯৭৯৩) নাম ব্যবহার করে গ্রেফতার শমসের আলীর পুত্র তারা মিয়া মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রতারণা করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সেজে এই ভাতা উত্তোলন করে আসছেন। সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে গ্রেফতার তারা মিয়ার প্রতারণা ফাঁস হয়ে যায়। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারোবাড়ী ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার রঞ্জন ঘোষ রানা
রায়ের বাজার এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, ‘তাকে আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই জানতাম। সারাক্ষণ হুইলচেয়ারে বসে থাকতেন। সব সরকারি অনুষ্ঠানেই তাকে ডেকে সম্মান দেওয়া হয়েছে। এখন গ্রেফতার হওয়ার পর মানুষ অবাক। কীভাবে একজন যুদ্ধাপরাধী মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম লেখালেন, আর কীভাবেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পাচ্ছেন, এটা স্থানীয়দের প্রশ্ন।’
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক কলিম উদ্দিনের অভিযোগ, তারা মিয়া শুধু মানুষকে না, প্রশাসন এবং সরকারকে ধোঁকা দিয়েছে। এরকম তারা মিয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আরও আছে কি-না তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। এ ধরনের প্রতারককে খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা জামাল উদ্দিন বলেন, ‘তারা মিয়া পাশের উপজেলা গৌরীপুরের ঠিকানা ব্যবহার করে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। তার ভারতীয় প্রামাণ্য দলিল নম্বর ৯৭৯৩। লাল মুক্তিবার্তা নম্বর ০১১৫১১০২৪৩। তিনি যুদ্ধ না করেও প্রতারণার মাধ্যমে গৌরীপুরে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম উঠিয়েছেন। গৌরীপুরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতারা সহায়তা করেছেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বারবার কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদে তারা মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেও এ বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সরষের মধ্যে ভূত থাকলে, সেই ভূত তাড়ানো কখনও সম্ভব না।’
গৌরীপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার ও পৌর মেয়র আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘গ্রেফতার তারা মিয়া স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও প্রশাসনকে প্রভাবিত করে নিজে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন এবং ভাতা নিয়েছেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বরগঞ্জের পৈতৃক বাড়িতে না থেকে নানার বাড়ি গৌরীপুরে থাকতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধোঁকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। সেজেছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। এ ধরনের ঘটনা আমাদের জন্য লজ্জাজনক।’
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার আব্দুর রব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না। তারা মিয়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর দোসর ছিলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থেকে অনেক পাপ করেছেন। দীর্ঘদিন পর হলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করায় তারা মিয়া গ্রেফতার হয়েছেন। এটাই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্বস্তির বিষয়। তবে এ ধরনের তারা মিয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অনেক আছে। এদেরকে খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবি।’
তবে তারা মিয়ার স্ত্রী রাবেয়া খাতুনের দাবি, তার স্বামী গৌরীপুরে নানার বাড়িতে থেকে বড় হয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ করার সময় গুলিতে আহত হয়েছেন বলেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাচ্ছেন। বিয়ের পর থেকেই তিনি শুনে আসছেন, তার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার স্বামী কখনও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত এ ধরনের তথ্য তার কাছে নেই।
ঈশ্বরগঞ্জ থানার ওসি আব্দুল কাদের জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তদন্ত শেষে গত বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। সেটি আমলে নিয়ে অভিযুক্ত তারা মিয়াকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।