প্রকাশিত: বুধবার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ইং।। ২৪শে ভাদ্র ১৪২৮ বঙ্গাব্দ (শরৎকাল)।২৯শে মহররম ১৪৪৩ হিজরী।।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : ১৯১৪ সালে কিছুদিনের জন্য শিলাইদহ গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে তিন তরুণ শিল্পী। এই তরুণদের উচ্ছ্বল স্বভাব তাঁকে উদ্দীপ্ত করে। তিনি দীনবন্ধু এন্ড্রুজকে লেখেন, ‘Their enthusiasm of enjoyment adds to my joy.’ এই তিনজনের একজন ছিলেন শিল্পী নন্দলাল বসু। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অবশ্যই দৈব নির্দিষ্ট ছিল। বিশ্বভারতীর প্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র শৈল্পিক খেয়ালের এক অন্যতম রূপকার ছিলেন নন্দলাল। তাঁর ম্যাজিক তুলির স্পর্শে শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন সত্যি আশ্চর্য সুন্দর হয়ে উঠল। বিশ্বভারতীর দেওয়ালে, চীনাভবনের বারান্দায়, হিন্দীভবনের হলে, শ্রীনিকেতনের উৎসব মঞ্চে, দিনান্তিকার দেওয়ালে, কলাভবনের কালোবাড়ি, চৈত্য, উত্তরায়ণের শ্যামলী বাড়ি— সব ক্ষেত্রেই রয়েছে নন্দলালের নান্দনিক স্পর্শ। শান্তিনিকেতনের উৎসবে, অনুষ্ঠানের বৈশিষ্ট্যই ছিল শৈল্পিক আবহাওয়া। রবি ঠাকুরের কল্পনার যথাযথ প্রকাশ করতেন নন্দলাল বসু। কবি ও ছবির এ এক জাদুকরী মেলবন্ধন।
অবনীন্দ্রনাথের ছাত্র ও ভক্ত ছিলেন নন্দলাল। কলকাতার চারুকলা বিদ্যালয়ে আর্ট বিষয়ে শিক্ষালাভের সূত্রেই তাঁদের আলাপ। নন্দলাল দ্য ওরিয়েন্টাল সোসাইটিরও ছাত্র ছিলেন। ১৯০৮ সালে শিব ও সতীর চিত্র এঁকেছিলেন এবং ৫০০ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রাচীন শিল্পের প্রতি এক অমোঘ টান অনুভব করতেন অবনীন্দ্রনাথে ছাত্র নন্দলাল। ১৯০৯ সালে অজন্তার প্রাচীন চিত্র অনুকরণের একটি কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নন্দলাল। ১৯১৪ সালে কলাভবন পরিদর্শনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসে এই শিল্পী। এ এক মনিকাঞ্চন যোগাযোগ। প্রথম পরিচয় হয়ে গিয়েছিল ১৯০১ সালে। রবি ঠাকুর তখন তাঁর কাব্যগ্রন্থ চয়নিকার সম্পাদনার কাজে ব্যস্ত। অবনীন্দ্রনাথ ইলাস্ট্রেশনের জন্য নিয়ে এলেন নন্দলালকে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপের আগেই এঁকেছিলেন ‘রুদ্র বৈশাখ’ নামের এক ছবি। বাকি ছবি আঁকতে চান কবিতার ভাব বুঝে। ‘চয়নিকা’ কাব্যগ্রন্থের সাতটি ছবি এঁকেছিলেন নন্দলাল। তাঁকে ছাড়া বিশ্বভারতীর নন্দনলোক সত্যিই অসম্পূর্ণ ছিল। ১৯১৪ সালের ১২ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের সৃজনের ভূমিতে আসেন এই ছদ্মবেশী গন্ধর্ব।শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে তাঁকে সম্বর্ধনা জানালেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বললেন, ‘তোমার তুলিকা রঞ্জিত করে ভারত ভারতী চিত্ত।’ ১৯১৫ সালে নন্দলাল ‘বিচিত্রা’ চিত্রশালার কাজে যুক্ত হন। রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীকে ছবি আঁকা শেখাতেন নন্দলাল। এরপর কলাভবনের সৃষ্টি। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার এই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘সুরেন্দ্রনাথ, অসিতকুমার ও নন্দলাল এই ত্রয়ীর যোগে কলাভবনের পত্তন হইল।’ বিশ্বভারতীর শিল্পচিন্তার গুরু দায়িত্বভার নিলেন নন্দলাল। তিনি হয়ে উঠলেন সকলের ‘মাস্টারমশাই’।
কলকাতায় থাকাকালীন সাহিত্যনির্ভর চিত্র সৃষ্টি করতেন তিনি। রামায়ণ মহাভারত, আরব্যোপন্যাস, ওমর খৈয়াম, বৈষ্ণবপদাবলী, চিত্রাঙ্গদা ইত্যাদি কাহিনি ও চরিত্র রূপ পেয়েছে তাঁর তুলির টানে। কল্পনা আর বাস্তবকে অনায়াসে মিলিয়ে দিতে পারতেন নন্দলাল। পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায় এই সূত্রে বলেছিলেন, ‘–হয়তো ইচ্ছে করলেই বৈষ্ণবপদাবলীর বৃন্দাবনের সঙ্গে বেলগাছিয়ার জীবনকে অনায়াসে মিলিয়ে দিতে পারেন— তাঁদের তুলির টানে আকবর বাদশা ও হরিপদ কেরানি দুই-ই জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে।’ শান্তিনিকেতনে এসে নন্দলাল প্রকৃতির কাছে নিজেকে সমর্পণ করলেন। শান্তিনিকেতনের উৎসব, পরব, প্রাঙ্গণ, শ্রেণিকক্ষ নন্দনলোক হয়ে উঠতে লাগলো তাঁর সেই ম্যাজিক কলমের ছোঁয়ায়। শালবীথি, গোয়ালপাড়া, কোপাইয়ের কেয়াবন, সাঁওতাল গ্রামের কেয়াফুল জানে নন্দলালের সাধনার গল্প। তাঁর ছবি এবার কথা বলে উঠল সাধারণ মানুষের হয়ে। চাষি, সাঁওতাল, পুরোহিত, বাউল, বাদ্যকর, ভিখারি, কামার, জেলে সকলে নন্দলালের ছবির ভুবনে জায়গা পেলো মাটির গন্ধ নিয়ে। খোয়াইয়ের লাল মাটি, ধানক্ষেতের সাদা মাটির রং, চাল, ডাল, তিল, সরষে, রঙিন পাথুরে মাটি, ফুলের পাপড়ি, গাছের পাতা থেকে রং তৈরি করে সাজিয়ে তুলেছিলেন তাঁর শিল্পাঙ্গণ। কলাভবন থেকে বাড়ি ফেরার পথে সব দেখতে দেখতে যেতেন। ছাত্রদের স্মৃতিচারণায় ধরা পড়ে এক মগ্ন শিল্পাচার্যের ছবি। প্রজাপতি, রাতের আকাশ, আমলকি বন অন্য রূপ, অন্য রং নিয়ে ধরা দিত তাঁর চোখে। মঞ্চ ও নাট্যসজ্জাতেও তাঁর অবদান অসীম। রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠের সাদা কালো ছবিগুলিও নন্দলাল বসুরই আঁকা। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম ‘দুর্গা’ ও ‘মরুভূমিতে তৃষ্ণার্ত হরিণের মৃত্যু’। গান্ধীজীর লাঠি হাতে বস্ত্রখোদিত চিত্রটিও তাঁর অনবদ্য সৃজন।
দেশিকোত্তম, ডক্টরেট, ডক্টর্স অফ লেটারস, পদ্মভূষণ ইত্যাদি উপাধি লাভ করেছিলেন নন্দলাল বসু। কিন্তু সে যেন তাঁর আসল পরিচয় নয়। বরং ওই যে তারায় ভরাট রাতের আকাশের দিকে চেয়ে থাকা নন্দলাল, খোয়াইয়ের উপর দিয়ে টোকা মাথায় এগিয়ে চলা মাস্টারমশাই, কলাভবন থেকে আনমনে তুলি হাতে হাঁটতে থাকা চিত্রকর সত্য, আশ্চর্য সত্য।
সৌজন্যে: মহুয়া দাসগুপ্ত
Sampa Patra
সহায়ক তথ্যপঞ্জিঃ
রবীন্দ্র পরিকর, পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়
রবীন্দ্রজীবনী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
(বিজ্ঞাপন) https://www.facebook.com/3square1
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com
আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।