হাদীস ও সুন্নাহর আলোকে তারাবীর নামায

0
1
হাদীস ও সুন্নাহর আলোকে তারাবীর নামায

প্রকাশিত : মঙ্গলবার ৪মার্চ, ২০২৫, খ্রিষ্টাব্দ।। ১৯ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ( বসন্ত কাল)।। ০৩ রমজান, ১৪৪৬ হিজরী।

বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক :          শায়েখ মুহাম্মাদ আলী আসসাবুনী

[বক্ষমাণ প্রবন্ধটি সৌদি আরবের খ্যাতিমান আলেমজামেয়া উম্মুল কুরা’র উস্তায, মসজিদে হারামের মুদাররিসপ্রসিদ্ধ তাফসীরগ্রন্থ ‘সাফওয়াতুত তাফাসীর’-এর লেখক শায়েখ মুহাম্মাদ আলী আসসাবুনী হাফিযাহুল্লাহু ওয়া রাআহু-এর

الهدي النبوي الصحيح في صلاة التراويح –এর বঙ্গানুবাদ।

প্রবন্ধটিতে তিনি হাদীস ও সুন্নাহ্র আলোকে তারাবী রাকাত সংখ্যা বিষয়ে উম্মাহ্র সঠিক কর্মপন্থা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।

জ্ঞাতব্য : পুস্তিকাটির অনুবাদ করার সময় অতিরিক্ত কিছু কাজ করা হয়েছে

১. শায়েখ সাবুনী সাধারণত হাদীস ও আসারের মান সম্পর্কে কিছু বলেননি। টীকায় সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনাসমূহের মান বলে দেওয়া হয়েছে।

২. উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে পুস্তিকাটিতে হাদীস নম্বর উল্লেখ করা হয়নিকখনো কিতাবের নামও উল্লেখ করা হয়নিশুধু ‘হাদীস’ শিরোনামে পেশ করা হয়েছে। অনুবাদকের পক্ষ থেকে হাদীসগ্রন্থ ও হাদীস নম্বর যোগ করা হয়েছে।

৩. পুস্তিকায় হাদীসগ্রন্থ ব্যতীত যেসব গ্রন্থের বরাত দেওয়া হয়েছে সাধারণত সেগুলোর খণ্ড ও পৃষ্ঠা উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে কোনো রদবদল করা হয়নি। কিছু ক্ষেত্র আছেযেখানে বরাত উল্লেখ করা হয়নি বা খণ্ড ও পৃষ্ঠা উল্লেখ করা হয়নিসেগুলো যোগ করা হয়েছে।

৪. মনে হচ্ছেসম্মানিত লেখক কোনো কোনো বর্ণনা হাদীসের মূল গ্রন্থ থেকে না নিয়ে পরবর্তী কোনো কিতাব থেকে উল্লেখ করেছেন। তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে দু-একটি শব্দের হেরফের হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে হাদীসের উৎসগ্রন্থ থেকে মূল শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে।]

بسم الله الرحمن الرحيم

نحمد الله تبارك وتعالى، ونصلي على صفوة خلقه سيدنا محمد صلى الله عليه وسلم، الداعي إلى الله بالحكمة والموعظة الحسنة، وعلى آله وأصحابه، والتابعين لهم بإحسان إلى يوم الدين وبعد:

আপনার হাতে আছে তারাবীর নামায সম্পর্কে রচিত একটি পুস্তিকা। পুস্তিকাটি কলেবরে ছোট। তবে ইনশাআল্লাহ এর দ্বারা যথেষ্ট উপকার হবে। পুস্তিকাটি তারাবীর রাকাত-সংখ্যার বিষয়ে সঠিক বিষয়টি প্রকাশ করবে এবং দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে ঐসকল লোকদের সন্দেহ-সংশয় বিদূরিত করবেযারা সুন্নত যিন্দা করার নামে একথা বলে বেড়ায় যেতারাবীর নামায হল আট রাকাত এবং বিশ রাকাত তারাবী পড়া বিদআত। অথচ তাদের খবর নেই যেএহেন কর্মের কারণে তারা ন্যায়ের পথ থেকে সরে যাচ্ছে এবং সুন্নাহ্র বিরুদ্ধাচরণ করছে।

তারা বুঝতেই পারছে না যেবিশ রাকাত তারাবীকে বিদআত বলার পরিণতি খুব ভয়াবহ। এর দ্বারা তো এটা প্রতিয়মান হয় যেসালাফ ও খালাফ তথা আমাদের পূর্বসূরী ও উত্তরসূরী ইমামগণ অজ্ঞ ও ভ্রষ্ট ছিলেন। এখানেই শেষ নয়বরং তাদের উক্ত বক্তব্য অনুযায়ী তো স্বয়ং সাহাবাদের চাদরেই অজ্ঞতা ও ভ্রষ্টতার দাগ লেগে যায়। কেননাউমর রা. বিশ রাকাত তারাবীর নির্দেশ দিলে নবীজীর সকল সাহাবী তাঁর সমর্থন করেছেন। কেউ কোনো আপত্তি করেননিবরং সকলে ইজমা করে নিয়েছেন।

সুতরাং আট রাকাতকে সুন্নাত বলে বিশ রাকাতকে বিদআত আখ্যা দেওয়া অত্যন্ত ভয়াবহ বিষয়। কিন্তু তারা এটাই বলছে। এসব বলে মানুষকে পেরেশানিতে ফেলছেমুসলমানদের একতা বিনষ্ট করছে এবং মুসলমানদের ঐক্যকে টুকরো টুকরো করে ফেলছে। পরিতাপের বিষয় হলতারা এসব করছে আর ভাবছেখুব মহৎ কর্ম আঞ্জাম দিচ্ছে।

এ কারণে মনে হয়েছেতারাবী বিষয়ে কলম ধরা জরুরি। যাতে এ বিষয়ে ভুল ধারণার অপনোদন হয়সহীহ সুন্নাহ এবং উম্মাহ্র সঠিক অবস্থান পরিষ্কার হয়। আলোচনার সুবিধার্থে পুস্তিকাটিকে আমি নিম্নোক্ত শিরোনামে সাজিয়েছি :

১. প্রাথমিক কিছু কথা।

২. তারাবী নামাযের হুকুম ও ফযীলত।

৩. সর্বপ্রথম তারাবীর নামায পড়েছেন কে?

৪. এ নামাযকে তারাবীর নামায বলার কারণ।

৫. তারাবী নামাযের রাকাত-সংখ্যা এবং এব্যাপারে উলামায়ে কেরামের বক্তব্য।

৬. ‘বিশ রাকাত তারাবীই সুন্নাহ’-এ বিষয়ক দলীল।

৭. হারামাইন শরীফাইনের আমল।

৮. শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. -এর মীমাংসাকারী ফতোয়া।

৯. উমর রা.-এর সুন্নাহ নবীজীরই সুন্নাহ।

১০. যুবকদের কাছে কিছু নিবেদন ও উপসংহার।

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সবধরনের কঠিন ফিতনা থেকে বাঁচিয়ে রাখুনপ্রবৃত্তির পূজা থেকে রক্ষা করুনইখলাস ও একনিষ্ঠতা দান করুন এবং যশ-খ্যাতির আসক্তি থেকে মুক্ত রাখুন। নিঃসন্দেহে আপনি সব শোনেন এবং বান্দার সব দুআ কবুল করেন।

প্রাথমিক কিছু কথা

বহু যুগ মুসলমানেরা কল্যাণের মাঝে বসবাস করেছেন। তারা ভাই ভাই হয়ে থেকেছেন। পরস্পর প্রীতি-ভালবাসা ও সাহায্য-সহযোগিতার আচরণ করতেন এবং প্রীতিহৃদ্যতা ও একাত্মতার সাথে রমযান মাসে তারাবীর নামায আদায় করতেন। মোটকথাইসলামের অনুপম শিক্ষাদীক্ষা ও সমুন্নত জীবনব্যবস্থার কল্যাণে মুসলমানগণ মিল-মহব্বতের চাদরে আচ্ছাদিত ছিলেন।

এভাবে যুগ যুগ ধরে মুসলিমসমাজে মহব্বত ও অন্তরঙ্গতার আবহ বিরাজ করছিল। কোনো কিছুই তাদের নির্মলতাকে পঙ্কিল করতে পারেনিতাদের ঐক্যকে বিনষ্ট করতে পারেনিনা রমযানেনা রমযানের বাইরে। কারণকুরআনে কারীম এবং ইবাদত-বন্দেগিই ছিল তাঁদের মূল ব্যস্ততা। অন্যদিকে মন দেওয়ার তাঁদের সুযোগ ছিল কোথায়?

এরপর এসেছে বর্তমান যুগচিন্তার স্থবিরতা ও জ্ঞানের দৈন্যের যুগ। এখন মুসলমানগণ চিন্তা ও মগ্নতার পুরো অংশই নিবদ্ধ করেছে শাখাগত বিষয়াদির দিকে। যেন দ্বীনের জরুরি ও মৌলিক বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। অথচ গুরুত্ব ও ব্যস্ততার বড় অংশ এর জন্যই ব্যয় করা উচিত ছিল।

এভাবে গৌণ ও শাখাগত মাসআলাগুলো নিয়ে এমন ব্যস্ততার কারণে আমাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে বিবাদ-বিসংবাদ ও ঝগড়া-ফাসাদ। আর এই কলহ-বিবাদের কারণেই আমরা পিছিয়ে পড়েছিঅন্যদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। অথচ একসময় আমরাই ছিলাম অগ্রগামীবিশ্বের নেতৃত্ব দানকারী।

আশ্চর্যের বিষয় হলইসলামের সরল রেখা থেকে বিচ্যুত বিবাদ সৃষ্টিকারী এসব লোক আম জনসাধারণ নয়বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গযারা উম্মাহ্র নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত। তারা নিজেদেরকে কুরআন-সুন্নাহ্র পণ্ডিত হিসাবে প্রকাশ করেনসালাফে সালেহীনের অনুসারী বলে দাবি করেন এবং ভাবেনমেধা-প্রতিভা ও জ্ঞান-গরিমায় তারা এতটা উৎকর্ষ লাভ করেছেন যেবর্তমানের খুব কম আলেমই এই পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছেন।

বরং তাদের কেউ কেউ তো আত্মম্ভরিতার শিকার হয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যেনিজেকে মুজতাহিদ ইমামগণের কাতারে দাঁড় করাতে শুরু করে দিয়েছেন। এরপর এমন আজিব আজিব ইজতিহাদ নিয়ে উপস্থিত হনযা পূর্বসূরী ও উত্তরসূরী জুমহুর উলামায়ে কেরামের সাথে সাংঘর্ষিক। ফলে মুসলমানদের একতা বিনষ্ট হয়উম্মাহ্র ঐক্যে ভাঙন সৃষ্টি হয়। কবি কতই না সুন্দর বলেছেন

يا علماء العصر، يا ملح البلد +  ما يصلح الملح إذا الملح فسد

দ্বীন পরস্পরের মাঝে হৃদ্যতা ও ঐক্যের প্রাসাদ তৈরি করেইসলামী ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করে। আর আজ মূর্খতা ও প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে দ্বীনকেই ব্যবহার করা হচ্ছে বিভেদ-বিভক্তি ও হানাহানির হাতিয়ার হিসাবে এবং ধর্মের নামেই ছিন্ন করা হচ্ছে ঈমানী ভ্রাতৃত্বের সকল বাঁধন। অথচ দ্বীনের সূত্রেই আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের ঐক্যের আহ্বান করেছেন। তিনি বলেছেন

اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ فَاَصْلِحُوْا بَیْنَ اَخَوَیْكُمْ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ.

প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।… সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০

হায়! এ যুগের শায়েখদের নিজস্ব রায় ও ইজতিহাদ মুসলমানদের মাঝে কী কঠিন বিপর্যয় নিয়ে এসেছে! তাদের মত ও পথের অন্ধ পক্ষপাত আমাদের উপর কী ভয়ানক বিপদ ডেকে এনেছে! এই শায়েখরা (উম্মাহ-বিচ্ছিন্ন মত প্রকাশ করে) প্রসিদ্ধি লাভ করতে চান। এজন্য মুসলমানদের এ দুঃসময়ে তারা মুজতাহিদ হওয়ার দাবি করে বসেছেন।

তারা সাধারণ মুসলমানদের মাঝে বিদ্বেষ ও বিবাদ-বিচ্ছেদের ধোঁয়া ছড়িয়ে দেন এবং ছোটখাট বিষয় নিয়ে দাঙ্গা ও গোলযোগের আগুন জ্বালিয়ে দেন। তাসবীহ হাতে যিকির করা যাবে কি নানামাযে হাত কোথায় রাখবেতারাবীর নামায কীভাবে পড়বেশ্রদ্ধা করে আলেমের হাতে চুমু দেওয়া যাবে কি নামেহমানের সম্মানার্থে দাঁড়ানো যাবে কি নাইজতিমায়ী যিকির জায়েয হবে কি নাকুরআন তিলাওয়াতের পর ‘সাদাকাল্লাহুল আযীম …’ বলা যাবে কি না ইত্যাদি গৌণ বিষয়াদি নিয়ে তারা ফেতনা-ফাসাদ শুরু করে দেন। অথচ এখানে হালাল-হারামের ইখতিলাফ না। বেশি থেকে বেশি এক পদ্ধতি উত্তম হলে অন্য পদ্ধতিটাও জায়েয।

এসব হল শরীয়তের আনুষঙ্গিক বিষয়। এগুলোকে নিয়েই তারা সমাজের মধ্যে ফেতনা উসকিয়ে দেন এবং এমন গুরুত্বের সাথে প্রচার করেন যেঅবস্থাদৃষ্টে মনে হয়এসবই হল শরীয়তের মৌলিক বিষয়। এগুলোর প্রতি এমন গুরুত্বই দেওয়া দরকারযেমন গুরুত্বারোপ করা হয় আকীদা-বিশ্বাস ও উম্মাহ্র ঐক্যের প্রতি এবং এগুলো নিয়ে এতই ব্যস্ত হওয়া প্রয়োজনযেমন প্রয়োজন খ্রিস্টান মিশনারী ও অন্যান্য ঈমানবিধ্বংসী আহ্বানের প্রতিরোধে সম্মিলিত চেষ্টা ব্যয় করার এবং নাস্তিকতাধর্মদ্রোহিতা ও যুবসমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া চারিত্রিক অবক্ষয়ের গতি রোধে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলার। ভাবখানা এমন যেঔপনিবেশিক শত্রুদের দ্বারা মুসলমানদের শতধাবিভক্ত হওয়ার পর তাদেরই মধ্য হতে এমন এক শ্রেণির প্রয়োজনযারা উম্মাহ্র সেই বিভক্তিকে ষোলকলায় পূর্ণ করবে।

দুঃখের ব্যাপার হলএই শায়েখরা এধরনের হীন কর্মকাণ্ড নিয়েই ব্যস্ত ও তৃপ্ত। আল্লাহ তাআলা তো বলেই দিয়েছেন

كُلُّ حِزْبٍۭ بِمَا لَدَیْهِمْ فَرِحُوْنَ.

প্রতিটি দল নিজেদের ভাবনা মতে যে পন্থা অবলম্বন করেছে তা নিয়েই উৎফুল্ল। সূরা মুমিনুন (২৩) : ৫৩

সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলমুসলমানদের এই বিভক্তিবৈরিতা ও হানাহানিকে বলা হচ্ছেদ্বীনের প্রতি গায়রত ও অবিচলতা। এসবেরই নাম দেওয়া হচ্ছে ইহইয়াউস্ সুন্নাহ (সুন্নত যিন্দাকরণ)। আবার কখনো বলা হচ্ছেএটাই সালাফে সালেহীন তথা মহান পূর্বসূরীদের আদর্শ। অথচ তাঁদের সাথে এসবের দূরতম সম্পর্কও নেই।

এই শায়েখরা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারতেন যেএটা দুশমনদের পাতানো গভীর ষড়যন্ত্র। এদের উদ্দেশ্য হলমুসলমানদেরকে এসবের পিছনে লাগিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখা এবং নিজেদের মধ্যে কঠিন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করাযাতে মুসলমানদের ঐক্য টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং তাদের শক্তি খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতির জোর তাকিদ দিয়েছেন এবং বিদ্বেষ ও বিভক্তির উপর কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে

وَ اعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِیْعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوْا وَ اذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ عَلَیْكُمْ اِذْ كُنْتُمْ اَعْدَآءً فَاَلَّفَ بَیْنَ قُلُوْبِكُمْ فَاَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهٖۤ اِخْوَانًا.

আল্লাহ্র রশিকে (অর্থাৎ তাঁর দ্বীন ও কিতাবকে) দৃঢ়ভাবে ধরে রাখ এবং পরস্পরে বিভেদ করো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তা স্মরণ রাখ। একটা সময় ছিলযখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহকে জুড়ে দিলেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই-ভাই হয়ে গেলে। সূরা আলে-ইমরান (৩) : ১০৩

আরো ইরশাদ হয়েছে

وَ لَا تَكُوْنُوْا كَالَّذِیْنَ تَفَرَّقُوْا وَ اخْتَلَفُوْا مِنْۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ الْبَیِّنٰتُ  وَ اُولٰٓىِٕكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِیْمٌ.

এবং তোমরা সেইসকল লোকের (অর্থাৎ ইহুদী ও নাসারার) মত হয়ো নাযারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী আসার পরও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল ও আপসে মতভেদ সৃষ্টি করেছিল। এরূপ লোকদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। সূরা আলে ইমরান (৩) : ১০৫

সালাফের অনুসারী হওয়ার দাবিদার এই ভাইদের যদি ইসলামের খেদমত করারই ইচ্ছা হয়তাহলে কী ক্ষতি হত তারা যদি তারাবীর নামায আট রাকাত না বিশ রাকাততাসবীহ পড়ার সময় গণনা করবে আঙ্গুলে না তাসবীহ-দানায়যিকির-আযকার এককভাবে করবেনা ইজতিমায়ীভাবেএসব বিষয় নিয়ে মুসলমানদের পেরেশান না করতেন?

তাদের কী সমস্যা হতযদি মুসল্লীদের ইবাদত-বন্দেগির বিরোধিতায় চিন্তা-ফিকির খরচ না করে নিজেদের চেষ্টা ও মনোযোগকে উৎসর্গ করতেন নাস্তিকতা ও কমিউনিজমের প্রতিরোধে?

তারা কি স্মরণ করেন না সত্যের দিশারী নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী

إِنّ الدِّينَ يُسْرٌ، وَلَنْ يُشَادّ الدِّينَ أَحَدٌ إِلّا غَلَبَهُ.

নিঃসন্দেহে দ্বীন সহজ। যে-ই দ্বীনের ব্যাপারে কঠোরতা করবে সে-ই পরাজিত হবে। সহীহ বুখারীহাদীস ৩৯

তাদের কানে কি পৌঁছয়নি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীস

بَشِّرُوا وَلَا تُنَفِّرُوا، وَيَسِّرُوا وَلَا تُعَسِّرُوا.

তোমরা সুসংবাদ দান কর, (দ্বীনের প্রতি) ঘৃণা সৃষ্টি কোরো না। সহজ করকঠিন কোরো না। সহীহ বুখারীহাদীস ৩০৩৮সহীহ মুসলিমহাদীস ১৭৩২

হে আল্লাহ! আপনি আমাদের হেদায়েত দান করুন। প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে হেফাযত করুন। হে রাব্বুল আলামীন! সবধরনে কঠিন ফেতনা-ফাসাদ থেকে আমাদের রক্ষা করুন।

এখন মূল আলোচনা অর্থাৎ তারাবীর নামাযের বিষয়ে নববী নির্দেশনার বিবরণ শুরু করছি। আল্লাহ তাআলাই সাহায্যকারী ও তাওফীকদাতা।

তারাবীর নামাযের হুকুম ও ফযীলত

রমযান মাসে ইশার পর বিতরের আগে যে নামায পড়া হয় তা হল তারাবীর নামায। এই নামায নারী পুরুষ সকলের জন্য সুন্নত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত তারাবীর নামায পড়েছেন এবং অন্যদেরকে উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁর ইনতিকালের পর সাহাবা-তাবেয়ীনও গুরুত্বের সাথে তারাবীর নামায আদায় করেছেন।

তারাবীর নামায রমযানুল মুবারকের অন্যতম শিআর বা প্রতীক। মুসলিমদের হৃদয়ে রয়েছে তারাবীর অনেক মর্যাদা ও মহত্ত্ব এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকটও আছে এর বিশেষ সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব। হাদীস শরীফে এসেছেনবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন

مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রাতে ইবাদত করবে তার অতীতের গোনাহ-খাতা মাফ করে দেওয়া হবে। সহীহ বুখারীহাদীস ৩৭

হাদীসটির উদ্দেশ্য হচ্ছেযে ব্যক্তি আল্লাহ্র প্রতি ঈমান রেখে এবং আল্লাহ্র দরবারে আজর ও সাওয়াবের আশা পোষণ করে রমযানের রাতে নামাযযিকিরতিলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদতের মধ্যে মশগুল থাকবেআল্লাহ তার পিছনের যাবতীয় সগীরা গুনাহ মাফ করে দেবেন। বাকি কবীরা! তো সেজন্য খালেস নিয়তে তাওবা করতে হবে। অনেক আলেম এ বিষয়ে স্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন।১

সর্বপ্রথম তারাবীর নামায পড়েছেন কে?

ইবনে কুদামা রাহ. তাঁর বৃহৎ ও বিস্তৃত গ্রন্থ ‘আলমুগনী’তে বলেন-

তারাবীর নামায সুন্নতে মুআক্কাদা। সর্বপ্রথম যিনি এই নামায চালু করেছেন তিন হলেন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। বিষয়টি একাধিক হাদীসে বিবৃত হয়েছে। যেমন :

১. আবু হুরায়রা রা. বলেনরাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের কিয়াম তথা রাতের বেলা ইবাদত-বন্দেগীর উৎসাহ দিতেন। কিন্তু দৃঢ়তার সাথে নির্দেশ দিতেন না। তিনি বলতেন

مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমযানের রাতে ইবাদত করবে তার অতীতের গোনাহ-খাতা মাফ করে দেওয়া হবে। সহীহ মুসলিমহাদীস ৭৫৯

২. আয়েশা রা. বর্ণনা করেন

إِنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ صَلّى فِي الْمَسْجِدِ ذَاتَ لَيْلَةٍ، فَصَلّى بِصَلَاتِهِ نَاسٌ، ثُمَّ صَلّى مِنَ الْقَابِلَةِ، فَكَثُرَ النّاسُ، ثُمّ اجْتَمَعُوا مِنَ اللّيْلَةِ الثّالِثَةِ، أَوِ الرّابِعَةِ فَلَمْ يَخْرُجْ إِلَيْهِمْ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، فَلَمّا أَصْبَحَ، قَالَقَدْ رَأَيْتُ الّذِي صَنَعْتُمْ، فَلَمْ يَمْنَعْنِي مِنَ الْخُرُوجِ إِلَيْكُمْ إِلّا أَنِّي خَشِيتُ أَنْ تُفْرَضَ عَلَيْكُمْوَذَلِكَ فِي رَمَضَانَ.

রমযানের এক রাতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে গিয়ে নামাযে দাঁড়িয়েছেন। কিছুসংখ্যক সাহাবী তাঁর পিছনে ইক্তিদা করেছেন। দ্বিতীয় রাতেও তিনি নামায পড়েছেন। এ রাতে প্রচুর মুসল্লী হয়েছে। এরপর তৃতীয় বা (রাবী বলেছেন) চতুর্থ রাতে সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে জড়ো হয়েছেনকিন্তু ঐ রাতে তিনি কামরা থেকে বের হননি।

সকাল হলে তিনি সাহাবাদের লক্ষ করে বললেনতোমরা যে এসেছো তা আমি দেখেছি। তবেআমি তোমাদের কাছে আসিনি এ আশঙ্কায় যেনা জানি এই নামায তোমাদের উপর ফরয করে দেওয়া হয়। সহীহ মুসলিমহাদীস ৭৬১

৩. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত

خَرَجَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، فَإِذَا أُنَاسٌ فِي رَمَضَانَ يُصَلّونَ فِي نَاحِيَةِ الْمَسْجِدِ، فَقَالَمَا هَؤُلَاءِ؟، فَقِيلَهَؤُلَاءِ نَاسٌ لَيْسَ مَعَهُمْ قُرْآنٌ، وَأُبَيّ بْنُ كَعْبٍ يُصَلِّي، وَهُمْ يُصَلُّونَ بِصَلَاتِهِ، فَقَالَ النّبِيّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَأَصَابُوا، وَنِعْمَ مَا صَنَعُوا.

একদা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কামরা থেকে বের হয়ে মসজিদে আসলেন। দেখেনকিছু লোক মসজিদের এককোণে নামায পড়ছে। জিজ্ঞেস করলেনএরা কী করছেবলা হলতারা নিজেরা কুরআনের হাফেয নয়তাই উবাই ইবনে কা‘বের পিছনে নামায পড়ছে। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা ঠিক করেছে। কাজটা খুব ভালো হয়েছে।২

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারাবীর নামায প্রথম পড়েছেন। এরপরও বলা হয়উমর রা. তারাবীর নামায চালু করেছেন। এর কারণ হলতিনিই সর্বপ্রথম উবাই ইবনে কা‘ব রা.-এর পিছনে জামাতের ব্যবস্থা করেছেন। তার নির্দেশে উবাই ইবনে কা‘ব রা. লোকদের নিয়ে তারাবীর জামাত শুরু করেছেন। আবদুর রহমান ইবনে আবদুল কারী রাহ. বলেন-

خَرَجْتُ مَعَ عُمَرَ بْنِ الخَطّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ لَيْلَةً فِي رَمَضَانَ إِلَى المَسْجِدِ، فَإِذَا النّاسُ أَوْزَاعٌ _أَيْ يُصَلُّوْنَ جَمَاعَاتٍ جَمَاعَاتٍمُتَفَرِّقُونَ، يُصَلِّي الرّجُلُ لِنَفْسِهِ، وَيُصَلِّي الرَّجُلُ فَيُصَلِّي بِصَلاَتِهِ الرّهْطُ، فَقَالَ عُمَرُإِنِّي أَرَى لَوْ جَمَعْتُ هَؤُلاَءِ عَلَى قَارِئٍ وَاحِدٍ، لَكَانَ أَمْثَلَ _أَيْ أَفْضَلَ وَأَقْرَبَ إِلَى الْخَيْرِثُمَّ عَزَمَ، فَجَمَعَهُمْ عَلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ، ثُمّ خَرَجْتُ مَعَهُ لَيْلَةً أُخْرَى، وَالنَّاسُ يُصَلّونَ بِصَلاَةِ قَارِئِهِمْ، قَالَ عُمَرُنِعْمَ البِدْعَةُ هَذِهِ، وَالّتِي يَنَامُونَ عَنْهَا أَفْضَلُ مِنَ الّتِي يَقُومُونَيُرِيدُ آخِرَ اللّيْلِ وَكَانَ النّاسُ يَقُومُونَ أَوّلَهُ.

রমযানের এক রাতে উমর রা.-এর সাথে বের হলাম। দেখিলোকজন বিক্ষিপ্তভাবে ছোট ছোট জামাত করে নামায পড়ছে। কেউ একা একা পড়ছে আর কেউ ইমামতি করছেকিছু লোক তার ইক্তিদা করছে। উমর রা. বললেনমনে হচ্ছেসবাইকে যদি এক ইমামের পিছনে জমা করিয়ে দিই তাহলে ভালো হবে। এরপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন এবং সবাইকে উবাই ইবনে কা‘ব রা.-এর পিছনে দাঁড় করিয়ে দেন

আরেক রাতে তাঁর সাথে বের হলাম। লোকজন উবাই ইবনে কা‘ব রা.-এর পিছনে জামাতের সাথে নামায পড়ছেন। উমর রা. তখন বললেন, এটা উত্তম বিদআত।

সাহাবায়ে কেরাম রাতের প্রথমাংশে (তারাবীর) নামায পড়তেন। উমর রা. বললেনএই নামায থেকে ঐ নামায উত্তমযার সময় তারা ঘুমিয়ে থাকে। অর্থাৎ শেষ রাতের নামায। (সহীহ বুখারীহাদীস ২০১০) আলমুগনীইবনে কুদামা ২/১৬৬

এসব হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝে আসে যেসর্বপ্রথম যিনি তারাবীর নামায পড়েছেন তিনি হলেন সায়্যিদুনা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি সাহাবীদের নিয়ে তিন বা চার রাত্রে তারাবীর জামাত করেছেন। এরপর তাঁদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে আর জামাত করেননি। কেননাতিনি আশঙ্কা করেছেনতিনি নিয়মিত জামাতের সাথে তারাবীর নামায পড়লে তারাবীর নামায ফরয হয়ে যেতে পারে। ফলে নিয়মিত আদায় করতে না পারলে কবীরা গুনাহ হবে। বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করে নিম্নোক্ত রেওয়ায়েতটি

إِنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، خَرَجَ مِنْ جَوْفِ اللّيْلِ فَصَلّى فِي الْمَسْجِدِ، فَصَلّى رِجَالٌ بِصَلَاتِهِ، فَأَصْبَحَ النّاسُ يَتَحَدّثُونَ بِذَلِكَ، فَاجْتَمَعَ أَكْثَرُ مِنْهُمْ، فَخَرَجَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فِي اللّيْلَةِ الثّانِيَةِ، فَصَلّوْا بِصَلَاتِهِ، فَأَصْبَحَ النّاسُ يَذْكُرُونَ ذَلِكَ، فَكَثُرَ أَهْلُ الْمَسْجِدِ مِنَ اللّيْلَةِ الثّالِثَةِ، فَخَرَجَ فَصَلّوْا بِصَلَاتِهِ، فَلَمّا كَانَتِ اللّيْلَةُ الرّابِعَةُ عَجَزَ الْمَسْجِدُ عَنْ أَهْلِهِ، فَلَمْ يَخْرُجْ إِلَيْهِمْ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، فَطَفِقَ رِجَالٌ مِنْهُمْ يَقُولُونَالصّلَاةَ، فَلَمْ يَخْرُجْ إِلَيْهِمْ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ حَتّى خَرَجَ لِصَلَاةِ الْفَجْرِ، فَلَمّا قَضَى الْفَجْرَ أَقْبَلَ عَلَى النّاسِ، ثُمّ تَشَهّدَ، فَقَالَأَمّا بَعْدُ، فَإِنّهُ لَمْ يَخْفَ عَلَيّ شَأْنُكُمُ اللّيْلَةَ، وَلَكِنِّي خَشِيتُ أَنْ تُفْرَضَ عَلَيْكُمْ صَلَاةُ اللّيْلِ فَتَعْجِزُوا عَنْهَا.

রমযান মাসে একবার রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মধ্যরাতে বের হলেন এবং মসজিদে গিয়ে নামায পড়লেন। কিছু লোক তাঁর পিছনে ইক্তিদা করল। ভোর হলে লোকজন বিষয়টা নিয়ে পরস্পরে আলোচনা করল। পরের রাতে আরো বেশি মানুষ জমা হল। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে গিয়েছেনতারা তাঁর পেছনে নামায পড়েছে। সকাল হলে লোকেরা তা নিয়ে আরো বেশি আলোচনা করল। তাই তৃতীয় রাতে মুসল্লীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল। নবীজী মসজিদে গিয়ে নামায পড়েছেনলোকেরা তাঁর ইক্তিদা করেছে। চতুর্থ রাতে এত বেশি মুসল্লী হয়েছে যেমসজিদে সংকুলান হচ্ছে না। কিন্তু রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ রাতে নামাযের জন্য বের হলেন না। তা দেখে কিছু লোক আস্সালাতআস্সালাত বলে আওয়ায দিতে লাগল। কিন্তু নারাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হলেন না। একেবারে ফজরের সময় মসজিদে গিয়েছেন। ফজরের নামায শেষ হলে তিনি মুসল্লীদের দিকে ফিরলেন এবং খুতবা পড়ে বললেনশোন! আজ রাতে তোমাদের অবস্থা আমার অজানা নয়। কিন্তু আমি আশঙ্কা করেছি, (নিয়মিত জামাত করলে) না জানিতারাবীর নামায তোমাদের উপর ফরয হয়ে যায় আর তখন তা আদায় করতে তোমরা অক্ষম হয়ে যাও। সহীহ বুখারীহাদীস ৯২৪সহীহ মুসলিমহাদীস ৭৬১

অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে

فَتُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ وَالأَمْرُ عَلَى ذَلِكَ.

এ অবস্থায়ই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকাল হয়ে যায়। সহীহ বুখারীহাদীস ২০১২

এ নামাযকে তারাবীর নামায বলার কারণ

রমযান মাসের রাতের সুন্নত নামাযকে তারাবী বলা হয়। কারণতারাবীর নামায অনেক রাকাতবিশিষ্ট দীর্ঘ নামায। মুসল্লীগণ প্রত্যেক চার রাকাত পর পর ‘তারবীহ’ তথা আরাম ও রাহাত গ্রহণ করে। এরপর ধারাবাহিকভাবে আবার নামায শুরু করে। এজন্য এ নামাযকে সালাতুত তারাবীহ তথা রাহাত ও আরামবিশিষ্ট নামায বলা হয়।

আরবী ভাষাবিৎ ইবনে মানযূর রাহ. বলেনتَرَاوِيْحُ (তারাবীহ) শব্দটি تَرْوِيْحَةٌ -এর বহুবচন। تَرْوِيْحَةٌ -এর অর্থ একবার রাহাত (আরাম) নেওয়া। যেমন تَسْلِيْمَةٌ -এর অর্থ একবার সালাম দেওয়া। রমযানের রাতের সুন্নত নামাযকে তারাবীহ (রাহাত)-এর নামায এজন্য বলা হয় যেমুসল্লীরা প্রত্যেক চার রাকাত পর পর রাহাত গ্রহণ করে।

ইবনে মানযূর রাহ. বলেনআর রাহাতের অর্থ হল ক্লান্তি-ক্লেশ না থাকা। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে

أَرِحْنَا بِهَا يَا بِلَالُ.

হে বেলাল! নামাযের মাধ্যমে আমাদেরকে আরাম দাও। মুসনাদে আহমাদহাদীস ২৩০৮৮সুনানে আবু দাউদহাদীস ৪৯৮৫মুজামে কাবীরতবারানীহাদীস ৬২১৫

অর্থাৎ তুমি আযান দাওতাহলে নামায আদায়ের মাধ্যমে রাহাত লাভ হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের মধ্যে রাহাত পেতেন। কারণনামাযে আল্লাহ্র সাথে নিভৃত আলাপ হয়। এজন্য তিনি বলেছেন

جُعِلَتْ قُرّةُ عَيْنِي فِي الصّلَاةِ.

আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে নামাযের মধ্যে। (মুসনাদে আহমাদহাদীস ১২২৯৩সুনানে নাসায়ীহাদীস ৩৯৩৯) লিসানুল আরবখণ্ড : ১মাদ্দাহ : روح

সুতরাং উল্লিখিত সহীহ হাদীসসমূহে যে কিয়ামে রমযান (রমযানের রাতের নামায)-এর বিবরণ এসেছে সে কিয়ামে রমযানই হল তারাবীর নামায।

তারাবীর নামাযের রাকাত-সংখ্যা

পূর্বের হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত যেতারাবীর নামায সুন্নতে মুআক্কাদা। এর রাকাত সংখ্যা বিশ এবং বিতিরসহ তেইশ। উম্মাহ্র আমল এভাবেই চলে আসছে। খলীফায়ে রাশেদ উমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর যুগ থেকে পূর্বসূরী ও উত্তরসূরী সকল মুসলিম এ বিষয়ে একমত। চার মাযহাবের কোনো ইমাম এতে দ্বিমত পোষণ করেননি। হাঁমদীনার মুজতাহিদ ইমাম মালেক রাহ. থেকে এক বর্ণনা আছে যেতারাবীর নামায ছত্রিশ রাকাত। এ মতের পক্ষে তাঁর দলীল হলতখনকার মদীনাবাসীর আমল। নাফে রাহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে যেতিনি বলেছেনআমি মদীনার লোকদের দেখেছিতারা রমযানে (ছত্রিশ রাকাত তারাবী ও তিন রাকাত বিতর মিলে মোট) উনচল্লিশ রাকাত নামায পড়েন। (মুখতাসারু কিয়ামিল লাইলপৃ. ২০১ফতহুল বারী ৫/৩৫২ بابفضل من قام رمضان)

তবেইমাম মালেক রাহ. থেকে প্রসিদ্ধ বর্ণনা শাফেয়ীহাম্বলী ও হানাফী মাযহাবের মতই। অর্থাৎ তারাবীর নামায বিশ রাকাত। সুতরাং বিশ রাকাতের উপর চার মাযহাবের ইমামগণ একমত এবং এর উপর ইজমা প্রতিষ্ঠিত। আর এভাবে আল্লাহ তাআলা বিবাদ-বিসংবাদের অনিষ্ট থেকে মুমিনদের হেফাযত করেছেন।

মুজতাহিদ ইমামগণের দলীল

বায়হাকী রাহ. ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন যেপ্রসিদ্ধ সাহাবী সাইব ইবনে ইয়াযীদ রাহ. বলেছেন

كَانُوا يَقُومُونَ عَلَى عَهْدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً.

উমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর যামানায় রমযান মাসে সাহাবায়ে কেরাম বিশ রাকাত তারাবী পড়তেন।৩ সুনানে কুবরাবায়হাকী ২/৪৯৬

২. তাবেয়ী ইয়াযীদ ইবনে রুমান রাহ. বলেন

كَانَ النّاسُ يَقُومُونَ فِي زَمَانِ عُمَرَ بْنِ الْخَطّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فِي رَمَضَانَ بِثَلَاثٍ وَعِشْرِينَ رَكْعَةً.

উমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম তেইশ রাকাত নামায পড়তেন। মুয়াত্তা মালেকআসার ৩৮০সুনানে কুবরাবায়হাকী ২/৪৯৬

অর্থাৎ তারা বিশ রাকাত তারাবী ও তিন রাকাত বিতির পড়তেন।

৩. আবুল আলিয়া রাহ. থেকে বর্ণিত

عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ أَنّ عُمَرَ أَمَرَ أُبَيّا أَنْ يُصَلِّيَ بِالنّاسِ فِي رَمَضَانَ فَقَالَ إِنّ النّاسَ يَصُومُونَ النّهَار وَلَا يحسنون أَن يقرؤا فَلَوْ قَرَأْتَ الْقُرْآنَ عَلَيْهِمْ بِاللّيْلِفَقَالَ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَهَذَا شَيْءٌ لَمْ يَكُنْ، فَقَالَ قَدْ عَلِمْتُ، وَلَكِنّهُ أَحْسَنُ، فَصَلّى بِهِمْ عِشْرِينَ رَكْعَة.

উবাই ইবনে কা‘ব রা. বলেন, উমর রা. তাকে বললেনমানুষেরা দিনের বেলা রোযা রাখে। (কিন্তু অনেকেই) সুন্দর করে কুরআন পড়তে পারে না। আপনি যদি তারাবীর নামাযের জামাত করতেন এবং তাদেরকে কুরআন পাঠ করে শোনাতেন (তাহলে ভালো হত)! তখন উবাই ইবনে কা‘ব রা. বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! এই আমল তো নবীজীর যুগে ছিল না! উমর রা. বললেনআমি তা জানি। তবেজামাত করলে ভালো হবে। তখন উবাই ইবনে কা‘ব রা. সাহাবীদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবী পড়লেন।৪ –আলআহাদীসুল মুখতারাহহাদীস ১১৬১মুসনাদে আহমাদ ইবনে মানী‘-কানযুল উম্মাল (হাদীস ২৩৪৭১)

আইম্মায়ে কেরামের বক্তব্যের আলোকে তারাবী বিশ রাকাত

ইবনে কুদামা রাহ. বিশ রাকাত তারাবীর ব্যাপারে ইজমা নকল করেছেন এবং ইমাম মালেক রাহ.-এর দ্বিতীয় মতের খণ্ডন করেছেনযাতে বলা হয়েছে যেতারাবীর নামায ছত্রিশ রাকাত। ইবনে কুদামা রাহ. বলেন

কিয়ামে রমযান তথা তারাবীর নামায বিশ রাকাত। এই নামায সুন্নতে মুআক্কাদা। তারাবীর নামায চালু করেছেন স্বয়ং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কিন্তু বলা হয়তারাবীর নামায চালু করেছেন উমর রা.। এর কারণ হলতিনিই সর্বপ্রথম উবাই ইবনে কা‘ব রা.-এর পিছনে জামাতের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর নির্দেশেই উবাই ইবনে কা‘ব রা. লোকদের নিয়ে তারাবীর জামাত শুরু করেছেন।

এক বর্ণনায় এসেছেরমযানের এক রাতে উমর রা বের হলেন। দেখেনলোকজন বিক্ষিপ্তভাবে ছোট ছোট জামাত করে নামায পড়ছে। উমর রা. বললেনসবাইকে যদি এক ইমামের পিছনে জমা করে দিই (তাহলে ভালো হবে)। এরপর সবাইকে উবাই ইবনে কা‘ব রা.-এর পিছনে এক জামাতে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

এরপর আরেক রাতে বের হয়ে দেখেনলোকজন ইমামের পিছনে জামাতের সাথে নামায পড়ছে। উমর রা. তখন বললেনএটা উত্তম বিদআত। সহীহ বুখারীহাদীস ২০১০

এরপর ইবনে কুদামা রাহ. বলেনইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর মতে তারাবীর নামায বিশ রাকাত। এটাই সুফিয়ান ছাউরী রাহ.আবু হানীফা রাহ. ও শাফেয়ী রাহ.-এর মত। ইমাম মালেক রাহ. বলেছেনতারাবীর নামায ছত্রিশ রাকাত। তিনি তখনকার মদীনাবাসীর আমল গ্রহণ করেছেন।

বিশ রাকাত তারাবীর দলীল হল উমর রা. যখন সাহাবীদেরকে উবাই ইবনে কা‘ব রা.-এর পিছনে দাঁড় করিয়েছিলেন তখন তিনি তাদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবী পড়েছিলেন। ইয়াযীদ ইবনে রুমান রাহ. থেকে ইমাম মালেক রাহ. বর্ণনা করেছেন যে, উমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম (তিন রাকাত বিতরসহ) তেইশ রাকাত নামায পড়তেন।

আলী রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যেতিনি সাহাবী ও তাবেয়ীদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবী পড়ার জন্য একজন ইমাম নিযুক্ত করেছেন।

অন্যান্য সাহাবীর সামনে উমর রা. ও আলী রা.-এর নির্দেশ এবং সাহাবায়ে কেরামের এই আমল ইজমার পর্যায়ের।

ইবনে কুদামা রাহ. আরো বলেন

যদি প্রমাণিত হয় যে, (ইমাম মালেক রাহ.-এর যমানায়) মদীনাবাসী সকলেই ছত্রিশ রাকাত তারাবী পড়েছেনতাহলেও উমর রা. যা করেছেন এবং তাঁর যুগে সাহাবায়ে কেরাম যে বিষয়ে ইজমা করেছেন তারই অনুসরণ করা উত্তম। কোনো কোনো আলেম বলেছেনমক্কাবাসীরা চার রাকাত অন্তরন্তর তাওয়াফ করতেন। মদীনাবাসীরা সে সওয়াব অর্জনের জন্য তাওয়াফের বদলে চার রাকাত নামায পড়তেন। কিন্তু বলাই বাহুল্য যেসাহাবায়ে কেরাম যে রাকাত-সংখ্যার উপর ছিলেন সে অনুযায়ী আমল করাই শ্রেয়।

আলী রা. সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যেতিনি এক রমযানে বিভিন্ন মসজিদ ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। সেগুলোতে বাতি জ্বালিয়ে লোকজন নামায পড়ছে। তখন আলী রা. বললেনআল্লাহ তাআলা উমরের কবরকে আলোকিত করুনযেমন তিনি আমাদের মসজিদগুলোকে আলোকিত করেছেন।

ইমাম আহমাদ রাহ. বলেছেনতারাবীর নামায এ পরিমাণ দীর্ঘ করবেযতটুকু মুসল্লীদের জন্য সহনীয় হয়তাদের কষ্ট না হয়। কেরাতের বিষয়টি মুসল্লীদের সহনক্ষমতার উপর নির্ভর করে। কাযী রাহ. বলেছেনপুরো রমযানে তারাবীতে এক খতমের কম হওয়া উচিত নয় এবং এক খতম থেকে বেশি পড়াও ঠিক নাযাতে মুসল্লীদের কষ্ট না হয়। আলমুগনীইবনে কুদামা ২/১৬৭

(লেখক বলেন,) ইমাম মালেক রাহ.-এর প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী তারাবীর নামায বিশ রাকাত। সুতরাং বিশ রাকাত উত্তম হওয়ার ব্যাপারে মুজতাহিদ ইমামগণের ইজমা সাব্যস্ত হচ্ছে। শায়েখ দারদীর মালেকী রাহ. বলেছেনরমযানে তারাবীর নামায বিশ রাকাত। তা আদায় করবে ইশার নামাযের পর। বিতিরের তিন রাকাত ছাড়া বাকি প্রত্যেক দুই রাকাত পর পর সালাম ফেরাবে। মুস্তাহাব হল প্রত্যেক রাতে বিশ রাকাতে এক পারা পড়া। এভাবে পুরো তারাবীতে একবার কুরআনে কারীম খতম করা।

যদি মসজিদ জামাত থেকে খালি হওয়ার আশঙ্কা না থাতে তাহলে উত্তম হল ঘরে একা একা তারাবীর নামায পড়া। আর মসজিদ খালি হওয়ার আশঙ্কা হলে মসজিদে জামাতে পড়া উত্তম। আকরাবুল মাসালিক আলা মাযহাবিল ইমাম মালিক ১/৫৫২আশ্শারহুস সাগীর আলা আকরাবিল মাসালিক ১/৫৫২

তদ্রƒপ ইমাম শাফেয়ী রাহ. ও ইমাম আবু হানীফা রা.-এর মাযহাবও বিশ রাকাত তারাবী পড়া। কেননাউমর ফারুক রা.-এর খেলাফতকালে এর উপর সাহাবায়ে কেরামের ইজমা হয়ে গেছে। ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. বলেন

وَهُوَ الصّحِيحُ عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ مِنْ غَيْرِ خِلَافٍ مِنَ الصّحَابَةِ.

উবাই ইবনে কা‘ব রা. থেকে এটাই সঠিক যে, তিনি সাহাবীদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবী পড়েছেন। এতে সাহাবীদের মধ্যে কারো দ্বিমত নেই। (আলইসতিযকার ৫/১৫৭)

মুখতাসারুল মুযানী কিতাবে (পৃ. ২১) আছেইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেছেন

وَرَأَيْتهمْ بِالْمَدِينَةِ يَقُومُونَ بِتِسْعٍ وَثَلَاثِينَ وَأَحَبُّ إلَيَّ عِشْرُونَ؛ لِأَنّهُ رُوِيَ عَنْ عُمَرَ، وَكَذَلِكَ يَقُومُونَ بِمَكَّةَ وَيُوتِرُونَ بِثَلَاثٍ.

 আমি মদীনাবাসীদের দেখেছি, তারা (তিন রাকাত বিতিরসহ) উনচল্লিশ রাকাত নামায পড়েন। তবে আমার নিকট বিশ রাকাত পড়া উত্তম। কেননাএটাই উমর রা. থেকে বর্ণিত এবং আমি মক্কাবাসীদেরও দেখেছিতারা বিশ রাকাত তারাবী এবং তিন রাকাত বিতির পড়েন।

ইমাম তিরমিযী রাহ.-এর বক্তব্য

ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেন

وَأَكْثَرُ أَهْلِ العِلْمِ عَلَى مَا رُوِيَ عَنْ عُمَرَ، وَعَلِيٍّ، وَغَيْرِهِمَا مِنْ أَصْحَابِ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ عِشْرِينَ رَكْعَةً، وَهُوَ قَوْلُ الثّوْرِيِّ، وَابْنِ الْمُبَارَكِ، وَالشّافِعِيِّ.

وقَالَ الشّافِعِيّوَهَكَذَا أَدْرَكْتُ بِبَلَدِنَا بِمَكّةَ يُصَلّونَ عِشْرِينَ رَكْعَةً.

উমর রা.আলী রা. ও অন্যান্য সাহাবী থেকে যা বর্ণিত হয়েছে এর উপরই অধিকাংশ আহলে ইলমের আমল। অর্থাৎ তারাবীর নামায বিশ রাকাত। সুফিয়ান ছাওরী রাহ.আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহ. ও শাফেয়ী রাহ.-এর মাযহাবও এ অনুযায়ীই। শাফেয়ী রাহ. বলেছেনমক্কাবাসীদের দেখেছিতারা বিশ রাকাত তারাবী পড়েন। জামে তিরমিযী ২/৩২৭-৩২৮ (بابما جاء في قيام شهر رمضان)

ইবনে রুশদ রাহ. বলেন

ইমাম মালেক রাহ. এক বর্ণনা অনুযায়ী-, ইমাম আবু হানীফা রাহ.শাফেয়ী রাহ. ও আহমাদ রাহ. বিতর ব্যতীত বিশ রাকাত তারাবীর মত গ্রহণ করেছেন। বিদাইয়াতুল মুজতাহিদ ২/২৬২

ইমাম নববী রাহ. বলেন

আমাদের শাফেয়ী মাযহাব মতে তারাবীর নামায বিশ রাকাত। প্রত্যেক দুই রাকাতে সালাম ফেরাবে এবং চার রাকাত পর পর ‘তারবীহা’ তথা আরাম করবে।

আবু হানীফা রাহ. ও তাঁর অনুসারীগণ এবং আহমাদ রাহ.দাউদ রাহ. ও অন্যান্য ইমামগণের মতও এটাই। কাযী ইয়ায রাহ. বলেছেনজুমহুর উলামায়ে কেরামের মাযহাবও তা-ই।

ইমাম মালেক রাহ. বলেছেনতারাবীর নামায বিতর ব্যতীত ছত্রিশ রাকাত।৫ আলমাজমু‘ ৩/৫২৬

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন

إِنّهُ قَدْ ثَبَتَ أَنّ أبي بْنَ كَعْبٍ كَانَ يَقُومُ بِالنّاسِ عِشْرِينَ رَكْعَةً فِي قِيَامِ رَمَضَانَ وَيُوتِرُ بِثَلَاثِفَرَأَى كَثِيرٌ مِنْ الْعُلَمَاءِ أَنّ ذَلِكَ هُوَ السّنّةُ؛ لِأَنّهُ أَقَامَهُ بَيْن الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَلَمْ يُنْكِرْهُ مُنْكِرٌ.

উবাই ইবনে কা‘ব রা. সাহাবীদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবী পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন-বিষয়টি সুপ্রমাণিত। তাই অনেক আলেমের মতে এটাই সুন্নাহ। কেননাউবাই ইবনে কা‘ব রা. মুহাজির ও আনসার সাহাবায়ে কেরামের উপস্থিতিতে বিশ রাকাত পড়েছেন। তখন এর উপর কেউ কোনো আপত্তি করেননি। –মাজমূউল ফাতাওয়াইবনে তাইমিয়া ২৩/১১২-১২৩

মাজমূআতুল ফাতাওয়ান নাজদিয়া’য় আছে, শায়েখ আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহ্হাব তারাবী নামাযের রাকাত-সংখ্যা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে উল্লেখ করেছেন যেউমর রা. যখন উবাই ইবনে কা‘ব রা.-এর মাধ্যমে জামাতের ব্যবস্থা করেন তখন সাহাবায়ে কেরাম বিশ রাকাত তারাবী পড়েছেন।

মুসলিম উম্মাহ্র ইমামগণের এসব উদ্ধৃতি নিশ্চিত প্রমাণ করেমুসলমানদের মাঝে বর্তমানে যে বিশ রাকাত তারাবী প্রতিষ্ঠিত এটাই হক। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিশ রাকাতই সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত। চার মাযহাবের ইমামগণের এর উপরই ইজমাযারা হলেন সর্বযুগে হেদায়েতের আলোকবর্তিকা এবং ইলম ও জ্ঞানের মিনার। উমর রা.-ও এই সংখ্যার নির্দেশই দান করেছিলেন। আর সহীহ হাদীসের ভাষ্য হল

إِنّ اللهَ تَعَالَى جَعَلَ الْحَقّ عَلَى لِسَانِ عُمَرَ وَقَلْبِهِ.

আল্লাহ তাআলা হক ও সত্য গচ্ছিত রেখেছেন উমরের যবান ও কলবে। জামে তিরমিযীহাদীস ৩৬৮২মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহাদীস ৩২৬৪৯মুসনাদে আহমাদহাদীস ৫১৪৫২১২৯৫২১৪৫৭সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস ৬৮৮৯

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

ভাষান্তর : মাওলানা ইমরান হুসাইন ও মাওলানা রিদওয়ান

 

টীকাসমূহ

১. এর জন্য দেখুনআলফিকহুল ওয়াযিহ আলাল মাযাহিবিল আরবাআড. মুহাম্মাদ বকর ইসমাঈল ৩/২৫

২. সুনানে আবু দাউদহাদীস ১৩৭৭

হাদীসটির সনদে মুসলিম ইবনে খালেদ মাখযূমী নামক একজন রাবী আছেন। আবু দাউদ রাহ. বলেছেনতিনি দুর্বল রাবী। ইবনে হাজার রাহ. বলেছেনএই বর্ণনা ভুল। সঠিক হচ্ছেউমর রা. উবাই ইবনে কা‘ব রা.-এর পিছনে তারাবীর জামাত দাঁড় করিয়েছেন। –ফতহুল বারী ৪/২১৮

৩. আছারটির সনদ সহীহ। অনেক ফকীহ ও মুহাদ্দিস এই আছার দ্বারা দলীল দিয়েছেন এবং বেশ কয়েকজন হাফেযুল হাদীস ইমাম সুস্পষ্টভাবে একে সহীহ বলেছেন। যেমনইমাম নববী রাহ.ওয়ালীউদ্দীন সুবকী রাহ.তাজুদ্দীন সুবকী রাহ.বদরুদ্দীন আইনী রাহ.জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ.মোল্লা আলী কারী রাহ.মুহাদ্দিস নীমাভী রাহ. প্রমুখ।

দ্রষ্টব্য : নবীজীর নামাযড. শায়েখ মুহাম্মাদ ইলিয়াস ফয়সাল (পরিশিষ্ট)পৃ. ৩৯৮-৩৯৯দলীলসহ নামাযের মাসায়েলমাওলানা আবদুল মতীনপৃ. ৪০০

৪. আসারটির সনদ হাসান। [মূল পুস্তিকায় তিন নম্বর দলীলে হাসান বসরী রাহ. থেকে বর্ণিত একটি আসার ছিল। বাস্তব কথা হলএতে তারাবীর রাকাত-সংখ্যা বিষয়ে কোনো কথা নেই। তাই সেটি বাদ দিয়ে এ আসারটি যোগ করা হয়েছে। (অনুবাদক)।]

৫. এরপর নববী রাহ. বিশ রাকাত বিতরের দলীলগুলো উল্লেখ করেছে। এসব দলীল যেহেতু পূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে। তাই সেগুলো আর উল্লেখ করা হল না।

নিউজটি শেয়ার করুন .. ..           

‘‘আমাদের বিক্রমপুরআমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুনবিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com
আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।
জাস্ট এখানে ক্লিক করুন। https://www.facebook.com/BikrampurKhobor
email – bikrampurkhobor@gmail.com

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন