প্রকাশিত : শনিবার ১২ অক্টোবর ২০২৪, খ্রিষ্টাব্দ।। ২৭ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ(শরৎকাল )।। ০৮ রবিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : বিক্রমপুরের কন্যা রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীদের মধ্যে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। বিশেষত টপ্পা অঙ্গের রবীন্দ্রসংগীতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক গায়িকা। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অতুলপ্রসাদের গানেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন; যদিও এই ধারায় তাঁর রেকর্ড সংখ্যা খুব বেশি নয়। কলকাতা পৌরসংস্থা তাঁর সম্মানে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও রবীন্দ্র সদনের মধ্যবর্তী ময়দানের একাংশে একটি সুরম্য সুবৃহৎ উদ্যান উৎসর্গ করেছেন। স্বনামধন্য এই রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীর আজ জন্মদিন। তাঁর জন্ম ১৯২৪ সালের ১২ অক্টোবর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার সোনামুখী গ্রামে। তার পৈতৃক বাড়ি বিক্রমপুরে (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলায়)। শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১০০তম জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।
জীবনের অধিকাংশ সময় শান্তিনিকেতনে অতিবাহিত করলেও তাঁর জনপ্রিয়তা পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে আমাদের বাংলাদেশেও পরিব্যাপ্ত ছিল।
শিক্ষাজীবন:
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সময় কণিকা ছিলেন শান্তিনিকেতনে। এই সময় রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ মতো সমুখে শান্তিপারাবার গানটি যে বৃন্দদলে গাওয়া হয়, সেই দলে ছিলেন কণিকা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই গানটি মৃত্যুর কয়েক বছর আগে রচনা করলেও, রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে তাঁর মৃত্যুর পরেই প্রকাশিত ও গীত হয়। এরপর ইন্দিরা দেবী চৌধরানী, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ, অমিতা সেন, রমা কর প্রমুখ খ্যাতনামা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষকের কাছে গান শিখতে থাকেন কণিকা। শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন হেমেন্দ্রলাল রায়, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভি ভি ওয়াজেলওয়ার, পি এন চিনচোর ও ধ্রুবতারা যোশির কাছে। ভজন শেখেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও প্রকাশকালী ঘোষালের কাছে। কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের পিতা হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নিকট শেখেন অতুলপ্রসাদের গান। এছাড়াও কমল দাশগুপ্ত ও ফিরোজা বেগমের কাছে কিছুকাল নজরুলগীতিও শেখেন কণিকা।
কর্মজীবন ও পারিবারিক জীবন:
১৯৪২ সাল থেকে তিনি হিজ মাস্টার্স ভয়েসের শিল্পী। ১৯৪৩ সালে বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষিকা হিসাবে যোগদান করেন কণিকা। এই বছরেই আকাশবাণীর নিয়মিত শিল্পীরূপে তাঁর যোগদান। পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীর এমিরিটাস অধ্যাপকও হন তিনি। ১৯৪৪ সালে কলকাতায় গীতবিতানসঙ্গীত বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নৃত্যনাট্য মায়ার খেলা মঞ্চস্থ হলে কণিকা সেই নাটকে প্রমদার চরিত্রটি করেন। এই অনুষ্ঠানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সূত্রে তিনি পরিচিত হন বাঁকুড়ার বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পরের বছর বৈশাখ মাসে বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি আবদ্ধ পরিণয়-সূত্রে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বীরেনবাবু ছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থাগারের কর্মী, রবীন্দ্র-বিশারদ ও আত্মকথা বাদে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত সকল গ্রন্থের সহলেখক।
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে গানটির রেকর্ড আনন্দধারা বহিছে ভুবনে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বাধিক জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত। ১৯৫৬ সালে এই গানটি তিনি প্রথম রেকর্ড করেন। গানটি তিনি শিখেছিলেন সংগীতাচার্য রমেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। রমেশবাবু গানটির মূল সুরটি জানতেন না। তাই স্বরবিতান-সম্মত মিশ্র মালকোষ রাগের বদলে তিনি কণিকাকে গানটি শেখান শুদ্ধ মালকোষ রাগে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে এ হেন সুর বিকৃতি বিশ্বভারতীসঙ্গীত সমিতি শুধু অনুমোদনই করেনি, গানটির জনপ্রিয়তায় প্রভাবিত হয়ে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় গীত সুরটির স্বরলিপি ভি বালসারাকে দিয়ে লিখিয়ে তা স্বরবিতানভুক্ত করে নেয়। আজও অন্যান্য শিল্পীরাও জনপ্রিয়তার বিপরীতে গিয়ে গানটি মূল সুরে গাইবার সাহস বড় একটা দেখান না। পরে আরও দুবার এই সুরেই গানটি রেকর্ড করেন কণিকা স্বয়ং। এই গানটি ছাড়া বাজে করুণ সুরে গানটিও কণিকা স্বরলিপি-বহির্ভূত প্রথায় গেয়েছিনিকাএই বিষয়ে বিশদ তথ্য মিলবে শ্রী সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত কার গান কার সুর শীর্ষক নিবন্ধে, প্রকাশিত হয়েছিল দলছুট খুদেপত্রীর জানুয়ারি ২০১১ সংখ্যায়।
বিদেশ সফর:
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৭৪, ১৯৭৮ ও ১৯৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা; ১৯৭৬, ১৯৮০ ও ১৯৮৬ সালে ইংল্যান্ড এবং ১৯৮০ সালেই জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। কিন্তু তাঁর আত্মকথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন তাঁর যে বিদেশ-ভ্রমণের কথা সেটি বাংলাদেশ। তাঁর কথায়,
“ আমি বহুবার বাংলাদেশে গেছি। বাংলাদেশের মানুষের ভালবাসা আমার জীবনে অমূল্য সম্পদের মত সঞ্চিত হয়ে আছে। ”
বাংলাদেশে কণিকা যান ১৯৭২, ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৮৬ ও ১৯৯৪ সালে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতে একটি চিত্র আঁকা আছে তাঁর আত্মকথায়, “ সেবার দেখা হল শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। তখন উনি বাংলাদেশের হৃদয়ের মণি। দেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গভবনে ঢুকতে স্বাগত জানালেন স্বয়ং মুজিবুর রহমান। আমাকে বললেন, জানেন আপনার রেকর্ড ছিল আলমারি ভর্তি। শয়তান ইয়াহিয়ার দল সব ভেঙে তছনছ করেছে। আপনার গানের আমি খুব ভক্ত। আমাদের সঙ্গে ছিল আমার গাওয়া দুটি লং প্লেয়িং রেকর্ড। উপহার দিলাম ওঁকে। রেকর্ড দুটো মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, আপনার কণ্ঠের গান বয়ে এনেছেন আমাকে উপহার দিতে। এর থেকে বড় আর কী হতে পারে?
শুনে আমি লজ্জায় সঙ্কুচিত হচ্ছিলাম। আমার স্বামী সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর নিজের হাতে তোলা গুরুদেবের একখানি ছবি। সেই ছবি পেয়েও শেখ সাহেব দারুণ খুশি। একজনকে ডেকে বলে দিলেন, বঙ্গভবনে তাঁর বসার জায়গার সামনের দেওয়ালে সেই ছবিটি টাঙিয়ে দিতে। ”
পরবর্তীকালে তাঁর প্রিয় ছাত্রী ও বিশিষ্ট বাংলাদেশী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার তত্ত্বাবধানে তিনি বাংলাদেশ সফর করেন। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে শেষবার সেই দেশ ভ্রমণ করেন কণিকা। কবি সুফিয়া কামাল তাঁর সম্মানে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন সেবার। সেই কবিতার শেষ পংক্তিগুলি শুনে তাঁর মনে হয় “দেশান্তরে নয়, যেন নিজেরই দেশে, নিজভূমে, নিজের মানুষদের ভালবাসাতেই পূর্ণ হয়ে উঠছি আমি” –
“ জয়তু অমৃত কন্যা। সুর কন্যা অয়ি
সুন্দর জীবন লভ সুর সুধাময়ী
আরও ব্যাপ্ত, বিথারিত হোক তব সুর
বেদনা, বঞ্চনা হতে লভ শান্তি প্রশান্তি মধুর।”
সম্মাননা:
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনে পেয়েছেন বহু সম্মাননা ও পুরস্কার। ১৯৭৩ সালে জাহ্নবী যমুনা বিগলিত করুণা ছবিতে আনন্দধারা বহিছে ভুবনে গানটি গেয়ে পান বি এফ জে এ পুরস্কার। ১৯৭৮ সালে পান গোল্ডেন ডিস্ক ই এম আই গ্রুপ।সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার পান ১৯৭৯ সালে। ১৯৮৬ সালে হন পদ্মশ্রী। ১৯৯৬ সালে পান এশিয়ান পেন্টস শিরোমণি পুরস্কার। ১৯৯৭ সালে বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম দ্বারা সম্মানিত করা হয় তাঁকে। ১৯৯৮ সালে পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতি কেন্দ্র তাঁকে সম্মান জানান। ১৯৯৯ সালে পান আলাউদ্দিন পুরস্কার। এছাড়া মৃত্যুর পরে কলকাতার বিখ্যাত সিটিজেন্স পার্কটিকে তাঁর নামে উৎসর্গিত করা হয়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল লাগোয়া এই সুরম্য বিশাল উদ্যানটির বর্তমান নাম মোহরকুঞ্জ।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীতে। পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থাগারের কর্মী ও মা অনিলা দেবী ছিলেন শান্তিনিকেতনের আশ্রমজননী। তাঁদের পাঁচ কন্যা ও তিন পুত্রের মধ্যে কণিকা ছিলেন জ্যেষ্ঠ। পিতৃদত্ত নাম অনিমা। ছেলেবেলা কাটে বিষ্ণুপুরের মামাবাড়ির যৌথ পরিবারে। পরে খুব অল্পবয়সে পিতার কর্মস্থল শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। ভর্তি হন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে। তাঁর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় এই সময় এক কালবৈশাখীর সন্ধ্যায় উত্তরায়ণের বাগানে আম চুরি করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ। সহজাতসঙ্গীত প্রতিভার কারণে তিনি সেই বয়সেই কবির বিশেষ স্নেহভাজন হয়ে পড়েন। তাঁর নিজের কথায়,
“ ততদিনে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক যেন কত সহজ। আজ জানি, তখনই তিনি অন্যদের কাছে কত ‘মহান’, কত ‘বিরাট’, কত ‘বিশাল’, কিন্তু তখন তিনি আমার অতি আপনজন। আমার আবদার করার, আমার নালিশ জানাবার, আমার অভিমান করবার, আমার সমাধান খুঁজে দেবার মানুষ তিনি। ”
১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘অণিমা’ নামটি পরিবর্তন করে ‘কণিকা’ রাখেন। অবশ্য ডাকনাম হিসাবে তিনি ব্যবহার করতেন ‘মোহর’। পরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই ‘মোহর’ নামটি বিস্তারিত করে বলেছিলেন ‘আকবরী মোহর’। ১৯৩৫ সালেই শিশুশিল্পী হিসাবে প্রথম মঞ্চাবতরণ করেন কণিকা। শান্তিনিকেতনের শারদোৎসবে একটি অনুষ্ঠানে বালক-বালিকাদের দলে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সেই প্রথম ও শেষ মঞ্চাবতরণ; কারণ সেই অনুষ্ঠানটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষ মঞ্চাভিনয়। ২৪ জুলাই ১৯৪০ বোলপুর টেলিফোন কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি ওগো তুমি পঞ্চদশী গানটি গেয়েছিলেন। গানটি তিনি সরাসরি রবীন্দ্রনাথের কাছেই শেখেন। এই অনুষ্ঠানটি বেতারে সম্প্রচারিত হয়। এটিই কণিকার প্রথম বেতার অনুষ্ঠান। এরপর ১৯৩৭ সালে প্রথম কলকাতার ছায়া সিনেমা হলে আয়োজিত বর্ষামঙ্গল উৎসবে কণিকা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে ছায়া ঘনাইছে বনে বনে গানটি গেয়েছিলেন। কলকাতার মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরূপে সেটিই ছিল তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ। এই সময়ে অনেকগুলি গান রবীন্দ্রনাথ তাঁকে স্বয়ং শিখিয়েছিলেন। কণিকা অভিনয় করেছিলেন তাসের দেশ নাটকের দহলানী, ডাকঘর নাটকের সুধা, বিসর্জন নাটকের অপর্ণা ও বশীকরণ নাটকের নিরুপমা চরিত্রে।
প্রথম রেকর্ড:
১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নীহারবিন্দু সেনের কথায় ও হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের সুরে দুটি আধুনিক গান রেকর্ড করেন কণিকা। গানদুটি ছিল ওরে ওই বন্ধ হল দ্বার ও গান নিয়ে মোর খেলা । এই রেকর্ডই তাঁর জীবনের প্রথম রেকর্ড। জানা যায়, প্রিয় ছাত্রী জীবনের প্রথম রেকর্ডে তাঁর গানের পরিবর্তে আধুনিক গান গেয়েছে শুনে দুঃখ পান রবীন্দ্রনাথ। ব্যথিত কণিকাও আধুনিক গানের জগতে প্রবেশ না করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই বছরেই হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি থেকে তাঁর প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এই গ্রামোফোন রেকর্ডের একপিঠে ছিল মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে এবং অন্যপিঠে ছিল না না না ডাকব না, ডাকব না। ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হিন্দুস্তান রেকর্ডের তালিকা পুস্তিকায় লেখা হয় –
“ কুমারী কণিকা মুখার্জ্জির প্রথম রেকর্ডখানি সকলের তৃপ্তি সাধন করিয়াছে। এবার তাহার আর একখানি রেকর্ড বাহির হইল। এই গান দুখানি শুনিয়া সকলেই প্রীতিলাভ করিবেন। ”
এই গান দুটি ছিল ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে ও ওই মালতীলতা দোলে। পূর্বের রেকর্ড ও এই রেকর্ডের চারখানি গানই রবীন্দ্রনাথের শোনা কণিকার রেকর্ডধৃত গান। জানা যায়, এই গানগুলি শুনে তিনি খুশি হয়েছিলেন।
আপ্তজন:
অপর এক প্রবাদপ্রতিম রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র ছিলেন তাঁর কৈশোরের বন্ধু। দেবব্রত বিশ্বাস, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, নীলিমা সেন প্রমুখ শিল্পীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।সঙ্গীত জগতের পাশাপাশি সাহিত্য জগতেও তাঁর বন্ধু ও গুণমুগ্ধ ছিলেন অনেকে। সৈয়দ মুজতবা আলি, অবধূত, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, মহাশ্বেতা দেবী, সমরেশ বসু, নিমাই ভট্টাচার্য, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ প্রমুখের সঙ্গেও ছিল তাঁর স্নেহ ভালবাসার সম্পর্ক। তাঁর নিজের জেলার মানুষ রামকিঙ্কর বেইজ তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মায়া সেন, কমলা বসু, অরবিন্দ বিশ্বাস, গোরা সর্বাধিকারী, বনানী ঘোষ, সোহিনী মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের পাপিয়া সারোয়ার, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সাদি মহম্মদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
ব্যক্তিজীবনে কণিকা ছিলেন অত্যন্ত লাজুক; সংকোচ ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। অপরিচিত স্থানে গান গাইতে যেতে বেশ ভয় পেতেন তিনি। শোনা যায়, সত্যজিৎ রায় তাঁর কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবির গানে নেপথ্যশিল্পী হিসাবে তাঁর নাম ভেবেছিলেন; কিন্তু কলকাতায় এনে অপরিচিত পরিবেশে তাঁকে দিয়ে রেকর্ড করানোর ঝক্কির কথা মাথায় রেখে সে পরিকল্পনা বাতিল করেন। যদিও সত্যজিৎ ও তাঁর স্ত্রী বিজয়া রায় উভয়েই ছিলেন কণিকার গুণমুগ্ধ ও পরম বন্ধু । সত্যজিতের শেষ ছবি আগন্তুক-এ ব্যবহৃত সাঁওতাল নৃত্যের দৃশ্যটি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবস্থাপনায় তোলা হয়। আবার তাঁর কিছু অদ্ভুত স্বভাবের কথাও জানা যায় স্বরচিত আত্মকথা থেকে। যেমন – কোনও অঞ্চল থেকে গান গাওয়ার ডাক পেলে সেই অঞ্চলের নামটি তিনি দেখতেন। নাম পছন্দ না হলে আমন্ত্রণ গ্রহণ করতেন না। এই কারণেই একবার ডানকুনিতে অনুষ্ঠান করতে যেতে অস্বীকার করেন তিনি।
শেষজীবন:
১৯৮৪ সালেসঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষের পদ থেকে অবসর নেন কণিকা। ১৯৯৩ সালে বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ ‘মোহর’ নামে তাঁর জীবনভিত্তিক একটি তথ্যচিত্র তোলেন। এর প্রযোজক ছিল ফিল্ম মেকার্স কনসর্টিয়াম। তাঁর শেষজীবন কাটে শান্তিনিকেতনে। অসুস্থতার কারণে শেষদিকে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতাতেই তাঁর জীবনাবসান হয়। রবীন্দ্রসদন চত্বরে শায়িত তাঁর মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাংলার সকল ক্ষেত্রের দিকপালগণ। পরে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।