প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ২৩মার্চ ২০২১ইং।। ৯ই চৈত্র ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (বসন্তকাল)।। ৯ শা’বান ১৪৪২হিজরী
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক :বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অপরিসীম ভূমিকা রাখছে রেলপথ। জাপান ও ভারতসহ বিশ্বের ৫৫টি দেশের দেড়শ নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা রেলনির্ভর। তাই বিশ্বব্যাপী এখন চলছে রেলের সোনালি যুগ। আর ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশের রেল খাত খুলেছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
স্বাধীনতা পর থেকেই রেলওয়ের উন্নয়নে নানা পরিকল্পনা প্রহণ করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যাত্রীদের চাহিদা থাকায় বাংলাদেশে রেলের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। এখন রেলের সোনালি যুগের সূচনার সময়। আর কয়েকটি ধাপ এগিয়ে গেলেই দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে রেল খাত।
আঠারোশ শতাব্দীর মাঝামাঝি গোটা ভারতবর্ষে প্রথম রেল যোগাযোগ শুরু হয়। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর দর্শনা থেকে জগতী পর্যন্ত ৫৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে যাত্রা শুরু। দেড়শ বছরে রেলপথ বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৯০০ কিলোমিটার। বর্তমানে রেলপথ বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যাত্রী ও পণ্য পরিবহন মাধ্যম। কিন্তু ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪৪টি জেলার সঙ্গে রেললাইন নেটওয়ার্ক সংযুক্ত। ২০টিতে রেল যোগাযোগ নেই। ফলে এখনো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের কিছু জেলা রেল যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন।
অন্যদিকে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় বাংলাদেশ অংশে মোট রেলপথের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭০৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৮৭৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ, এক হাজার ৮০০ কিলোমিটার মিটারগেজ এবং ৩১ কিলোমিটার নেরোগেজ রেলপথ। পরবর্তীসময়ে ৩১ কিলোমিটার নেরোগেজ রেলপথকে ব্রড গেজে রূপান্তরিত করা হয়।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর দেশে রেলপথের পরিমাণ ছিল মাত্র ৯২৩ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার ব্রডগেজ এবং এক হাজার ৯৩৪ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার মিটারগেজ। ১৯৯৯-২০০০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় প্রায় ২ হাজার ৭৩৩ দশমিক ৫১ কিলোমিটার এবং ২০২০ সাল পর্যন্ত দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় প্রায় ২ হাজার ৯০০ কিলোমিটার।
এর মধ্যে ব্রডগেজ ৮০১ দশমিক ০৯ কিলোমিটার এবং মিটারগেজ ১ হাজার ৮৩২ দশমিক ৪২ কিলোমিটার। রেলওয়েতে বর্তমানের ২৫ হাজার ৮৩ জন নিয়মিত কর্মচারী রয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন কারিগরি পদে চুক্তিতে কাজ করেন কয়েক হাজার মানুষ। বর্তমান সরকার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত রেল-সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্তও রেলপথ হবে।
স্বাধীনতার পর অবহেলিত বাংলাদেশ রেলপথে অবকাঠামো উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য কাজ শুরু হয় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ সাল থেকে। এখন বছরে প্রায় ১০ কোটি যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। নিরাপদ যাতায়াতের জন্য যাত্রীরা রেলের দিকেই ঝুঁকছে। কারণ সড়ক ও মহাসড়কে বিশৃঙ্খলায় প্রাণহানি বাড়ছে।
একনজরে বাংলাদেশের রেলওয়ে : মাত্র কয়েকটি পণ্যবাহী ওয়াগন দিয়ে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬২ সালে বাংলাদেশে সূচনা হয় রেল যুগের। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ২৭৮টি লোকোমোটিভ, এক হাজার ৬৫৬টি মিটারগেজ ও ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ এবং আট হাজার ৬৮০টি পণ্যবাহী ওয়াগন আছে।
বর্তমানে ‘ব্রডগেজ’ এবং ‘মিটারগেজ’ এই দুই ধরনের রেলপথ চালু রয়েছে। দেশের পূর্বাঞ্চলে রয়েছে মিটার ও ব্রডগেজ রেলপথ। পূর্বাঞ্চলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব স্টেশন থেকে ঢাকা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ রয়েছে। আগে ন্যারোগেজ রেলপথ চালু থাকলেও এখন আর তার ব্যবহার নেই।
১৯৮২ সালের ২ জুন পর্যন্ত একজন চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য নিয়ে রেলওয়ে বোর্ডের মাধ্যমে রেলপথের ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। ১৯৮২ সালের ৩ জুন রেলওয়ে বোর্ড বিলুপ্ত করে এর কার্যক্রম যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের রেলওয়ে বিভাগের আওতায় নেওয়া হয়। তখন থেকে এই বিভাগের সচিব রেলওয়ের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করতেন। পরে রেলওয়েকে পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে ভাগ করা হয়।
১৯৯৫ সালের ১২ আগস্ট রেলপথের দৈনন্দিন কার্যক্রম যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা করে মহাপরিচালকের হাতে ন্যস্ত করা হয়। তবে নীতিনির্ধারণের জন্য যোগাযোগমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে গঠন করা হয় নয় সদস্যের বাংলাদেশ রেলওয়ে অথরিটি।
২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করে আদেশ জারি করে। বর্তমানে সচিবালয় সংলগ্ন রেলভবনে এই মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পঞ্চগড় স্টেশন পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব প্রায় ৫০৫ কিলোমিটার, এটিই দেশের সবচেয়ে বেশি দীর্ঘ রেলরুট। এই রুটে ‘দ্রুতযান’ ও ‘একতা এক্সপ্রেস’ চলাচল করে। বাংলাদেশ রেলওয়ে কয়েক বছর আগে ই-টিকিটিং চালু করে।
এ ছাড়া যাত্রীরা অনলাইনে তাদের অভিযোগও জানাতে পারেন। রাজধানী ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলের সবুজ ঘেরা রেলপথকে সবচেয়ে সুন্দর রেললাইন হিসেবে অভিহিত করেছে টেলিগ্রাফ।
শুধু রেল নয়, রাজধানীবাসীর জন্য কাজ চলছে স্বপ্নের মেট্রেরেলের। এই মেট্রোরেলের কাজ কয়েক বছর আগে শুরু হলেও ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই রেল সার্ভিস চালু হতে পারে। মেট্রোরেল চালু করতে রেলপথ স্থাপনের কাজও অনেক দূর এগিয়েছে।
এদিকে রেলে ভ্রমণকারীর সংখ্যা বাড়লেও এর সেবার মান উন্নতি না হওয়ায় লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না রেলওয়ে। ২০১৭ সাল থেকে ২০১৮ সালে রেলের যাত্রী বেড়েছে এক কোটিরও বেশি; কিন্তু ২০১৭ সালে রেলে এক হাজার ২০০ কোটি এবং ২০১৮ সালে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. হাসিব মোহাম্মদ আহসান বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিপুল বিনিয়োগে হলেও সে তুলনায় যাত্রীসেবা কম। যাত্রীসেবা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নীত না হলে রেলপথ বাড়িয়ে, ট্রেন বাড়িয়ে কোনো সুফল মিলবে না। তাই সেবার মান বৃদ্ধিসহ সঠিক সময়ে প্রকল্পের কাজগুলো রেলের উন্নতি চোখে পড়বে। কঠোর তদারকি ও নজরদারির আওতায় আনলে রেল হবে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় খাত।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী রেলে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তবে তা সন্তোষজনক নয়। রেলপথ ও রেলসেতু নির্মাণ ছাড়াও যাত্রীসেবা বাড়িয়ে রেলকে বদলে দিতে হবে। কারণ রেল বদলে গেলে দেশের অর্থনীতি আরো ইতিবাচকভাবে বদলে যাবে। গত ১০ বছরে ৮১টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এখন সোয়া লাখ কোটি টাকার ৪৮টি প্রকল্পের কাজ চলছে। বিপুল বিনিয়োগ হলেও গতি আসেনি ট্রেনে। কারণ ঢাকায় ব্রডগেজ ও মিটার গেজের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ট্রেন চলে গড়ে ২০ কিলোমিটার গতিতে।
কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর রেল স্টেশন পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার পেরোতেই লাগে প্রায় আধঘণ্টা। সরকার দেশের সব রেলপথ ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন করার নীতি গ্রহণ করেছে। তবে তাতেও গতি বাড়ছে না। তার ওপর এখন ৬৮ শতাংশ রেল ইঞ্জিনের আয়ুও নেই। ট্রেন চলার সময় লাইন থেকে পড়ে যায় ইঞ্জিন। ইঞ্জিন বিকল হয়ে বা রেলপথে ত্রুটির ফলে ট্রেনের চাকা পড়ে যায়। ৭৩ শতাংশ ট্রেন দুর্ঘটনার বড় কারণ লাইন থেকে চাকা পড়ে যাওয়া। রেলসেবা বাড়াতে হলে ট্রেন বাড়াতে হবে। তবে তা বাড়ানোর আগে খতিয়ে দেখতে হবে তা লাভজনক হবে কি না। বিনা টিকিটে যাত্রী পরিবহন বন্ধ করতে হবে।
ঢাকা-রাজশাহী রুটের নতুন ট্রেন চালুর পরও তাতে লাভ হচ্ছে না। আবার ঢাকা কুড়িগ্রাম রেলপথে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেন চালুর প্রস্ততি চলছে। এসব কার্জক্রম বৈজ্ঞানিক উপায়ে হচ্ছে না বলে অগ্রগতি কম। রেলকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিচালনা করলে রেল হবে একটি সম্ভাবনাময় সেবা খাত।
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, ‘দুর্নীতিমুক্ত রেলওয়ে গড়ে তোলার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত কাজ করছি। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৮৬টি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এডিপিতে রেলওয়েতে ৩৩টি বিনিয়োগ প্রকল্প ও ৩টি কারিগরি সহায়তা প্রকল্পসহ মোট ৩৬টি উন্নয়ন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত রেলের ৭৭টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। ফলে রেলপথ সম্প্রসারিত হয়েছে এবং রেলের যাত্রীসেবার মান বেড়েছে।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর–আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন–বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com
আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।