প্রকাশিত: বুধবার,৫ জানুয়ারি ২০২২ইং।। ২১ই পৌষ ১৪২৮ বঙ্গাব্দ (শীতকাল)।।৩১জামাদিউল আউয়াল ১৪৪৩ হিজরী।।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও প্রগতিশীল আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারীদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব সত্যেন সেন। ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ বিক্রমপুর জেলার সোনারং গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন ধরণী মোহন সেন ও মাতা মৃণালিনী সেন।
ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক, বিপ্লবী কৃষকনেতা, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী’র প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ, বাম রাজনীতিবিদ, শিল্পী সংগ্রামী কমরেড সত্যেন সেন এর আজ প্রয়াণ দিবস। ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ছোটবেলায় তার ডাক নাম ছিল লস্কর। তার পিতা ধরনীমোহন সেন এবং মা মৃণালিনি সেন। চার সন্তানের মধ্যে সত্যেন কনিষ্ঠ। ইন্দুবালা সেন, প্রতিভা সেন, জিতেন্দ্র মোহন সেন (শঙ্কর) ও সত্যেন সেন (লঙ্কর)। শিল্প-সাহিত্যে আগ্রসর এই পরিবারে ছিল কয়েকজন খ্যাতিমান সাহিত্যিক। সত্যেনের পিতৃব্য ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তাঁর কাকা মদনমোহন সেন ছিলেন খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক। খুড়তুতো ভাই মুরারীমোহন সেন ও সত্যেনের দুই বোন ইন্দুবালা এবং প্রতিভা সেন সাহিত্যচর্চায় নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন। সেনবাড়ির আলমিরাগুলো ছিল কাব্য, উপন্যাস ও জীবনী গ্রন্থে ভরা।
পরিবারেই সত্যেন সেনের পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়। প্রাইমারি থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা সম্পন্ন করেছিলেন পরিবার ও গৃহ শিক্ষকের কাছে। অন্যদিকে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয় ১৯১৯ সালে, মুন্সীগঞ্জের সোনারঙ হাইস্কুলে। ১৯২১ এ সোনারঙ হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে সত্যেনের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উšে§ষ ঘটে। তিনি টঙ্গীবাড়িতে একটি রাজনৈতিক সভায় যোগ দিয়েছিলেন। কংগ্রেসের সেই সভাটি ছিল সত্যেনের জীবনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সেদিনের বক্তার বলিষ্ঠ আহ্বানÑ তিনি যেন বারবার শুনতে পাচ্ছিলেন ঘর-ফিরতি পথে। এই সভা থেকে ফেরার কিছুদিন পরই তিনি কংগ্রেসের হয়ে কাজ শুরু করেন।
১৯২৪ সালে সত্যেন সেন মাধ্যমিক পাস করেন সোনারঙ স্কুল থেকে। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য চলে যান কলকাতায়। সেখানে যাওয়ার পর তিনি যুক্ত হয়েছিলেন বিপ্লবী দল যুগান্তরের সঙ্গে। ওই দলের সংগঠক ছিলেন জীবন চ্যাটার্জি। ছাত্রাবস্থায় বোনের উৎসাহে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন স্বদেশী বিপ্লবী কাজে। তখন থেকে সত্যেনের সাহিত্য চর্চার শুরু। তাঁর কবিতা ছাপা হতো ‘নবশক্তি’ পত্রিকায়। কলেজের ছাত্রাবস্থায় সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য ১৯৩১ সালে গ্রেফতার হয়ে বহরামপুর কারাগারে একটানা পাঁচ বছর বন্দী থাকেন। জেলে বসেই তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ১৯৩৮-এ বহরামপুর কারাগার থেকে মুক্তির পর গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য। তিনি গবেষণায় প্রবেশ না করে মার্কসবাদী রাজনীতি চর্চায় মগ্ন থাকেন। আসলে জেল জীবনই তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা আমূল পাল্টে দিয়েছিল।
সত্যেন সেন ছড়িয়ে আছেন, জড়িয়ে আছেন বিশালসংখ্যক মানুষের কাছে। আমাদের চেতনায় ও বোধে। তিনি তারুণ্যের শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করতে চাইতেন সমাজ পরিবর্তনের কাজে। কখনও সাহিত্যসংগঠন গড়ে, কখনও গানের দল গড়ে। আর এজন্য তিনি কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন ঢাকেশ্বরী কটন মিল, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিল, চিত্তরঞ্জন কটন মিল ও ঢাকা নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পাটকলে। ট্রেড ইউনিয়নের লক্ষ্য ছিল শ্রমিকশ্রেণীর ন্যায্য মজুরি, দাবি-দাওয়া আদায়। সামাজিক কুসংস্কার ও রাজনৈতিক অবদমন থেকে মানুষের মুক্তির জন্য সত্যেন সংগঠিত করেছিলেন বৃহৎ এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন। চল্লিশ দশকে তাঁর উদ্যোগে ঢাকায় গড়ে ওঠে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’। ১৯৪২ সালে ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির প্রচার সপ্তাহ উপলক্ষে তিনি প্রথম গান রচনা করেনÑ ‘লীগ-কংগ্রেস এক হও।’ তখন এই গান বাংলাদেশের সর্বত্র গাওয়া হতো এবং বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এছাড়া ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারত সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৪৮ সালে মিলের শ্রমিকদের নিয়ে কবিগানের দল গঠন করেছিলেন।
১৯৪৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হলে কিছুদিন শান্তিনিকেতনে আত্মগোপনে ছিলেন প্রতিভা সেনের বাড়িতে। তারপর সমাজতন্ত্রের পক্ষে মেহনতি মানুষকে সংগঠিত করার জন্য ফিরে আসেন সোনারঙ গ্রামে। পুনরায় কৃষক আন্দোলনে যোগদান। প্রখ্যাত কৃষক নেতা জীতেন ঘোষের সাথে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ লক্ষ্যে তিনি ঢাকা, রায়পুরা, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে কাজ করেন। নেতৃত্ব দেন ঢাকা জেলা কৃষক সমিতির। এরমধ্যে সত্যেনের মা বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। মায়ের অসুখের চিঠি গিয়ে পড়ে পুলিশের হাতে। পুলিশ তাকে বিপ্লবী কর্মকা- পরিচালনা করার দায়ে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেফতার করে। ১৯৪৯ সালে জেলে থাকাকালে তাঁর মা মারা যান। সত্যেন বন্দী ছিলেন ঢাকা ও রাজশাহী জেলে। ওই সময় কারাগারে বসে তিনি অনশন করেন একাধারে ৪০ দিন। দীর্ঘ কারাভোগ ও নির্যাতনে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। প্রায় চার বছর কারানির্যাতন ভোগের পর ১৯৫৩-তে মুক্তি লাভ। আবারও ফিরে আসেন সোনারঙ গ্রামে। তখন নানা প্রতিকূল পরিবেশের জন্য তাঁদের পরিবার কলকাতায় চলে যায়।
১৯৫৪ সালের ৩০ মে পূর্ব বাংলায় ৯২-ক ধারা জারি হলে আবার গ্রেফতার হন তিনি। কিছুকাল পর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। শুরু হয় সাংবাদিকতা জীবনের নতুন পথচলা। ১৯৫৮-এর ৭ আগস্ট দেশে সামরিক আইন জারি হলে পুনরায় গ্রেফতার। দীর্ঘ পাঁচ বছর জেলে থাকার পর ১৯৬৩-এর শেষ দিকে মুক্তিলাভ। পুনরায় দৈনিক সংবাদে যোগদান। ১৯৬৫-র আগস্ট থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত ফের কারাবাস। মুক্তি পাওয়ার পর আবার যুক্ত হন ‘দৈনিক সংবাদ’-এ। তাঁর জীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে সাংবাদিকতায়। সেখানে তিনি নিয়মিত কলাম ও অনুসন্ধানী নিবন্ধ লিখতেন। এ পত্রিকায় যুক্ত থাকাকালেই তিনি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে কৃষক আন্দোলনের অনেক তথ্য সমৃদ্ধ কাহিনী জানতে পারেন। যা পরে তার বিভিন্ন বইতে স্থান পেয়েছে।
সত্যেন সেন রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধঘোষিত তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কৃষক সংগঠন গড়লেও সে পরিচয় তার মুখ্য হয়ে ওঠেনি। ১৯৬৮ সালের ২৯ আগস্ট তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’। শিল্পী সাইদুল ইসলামের নারিন্দার বাসায় সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, কামরুল আহসান, মোস্তফা ওয়াহিদ খানকে নিয়ে গঠিত হয় উদীচী। সত্যেন সেন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এ সংগঠনের উদ্দেশ্য মেহনতি মানুষকে গানের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে উদ্ধুদ্ধ করা। ১৯৭১ সালে বাঙালীর সার্বিক মুক্তির চেতনাকে ধারণ করে উদীচী গড়ে তোলে এক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। এ সংগ্রাম বাংলার পথে-ঘাটে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সত্যেন সেনের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের পর থেকে উদীচী স্বয়ং দেশব্যাপী এক দুর্বার আন্দোলন হিসেবে দেখা দেয়। ’৭২-এর আগে উদীচী তার একটি গণসঙ্গীতের স্কোয়াড নিয়ে গর্ব করত। বর্তমানে ৩১৫টি শাখা সংগঠন এবং দেশের বাইরে ৫টি শাখা রয়েছে। প্রতিটি শাখায় গানের দল রয়েছে। রয়েছে সঙ্গীত, নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি, চারুকলা, পাঠাগার ও সাহিত্য বিভাগ। ২০১৩ সালে ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘একুশে পদক’ লাভ করেছে।
সত্যেন সেন সাহিত্যচর্চা শুরু করেন পরিণত বয়সে। তখন তিনি পঞ্চাশ অতিক্রান্ত। তাঁর কাছে সাহিত্যই ছিল সংস্কৃতির প্রাণ। তাঁর ভাষায়Ñ ‘মানুষের কাছে যে কথা বলতে চাই, সে কথা অন্যভাবে বলতে পারব না, সে জন্যই সাহিত্যের আশ্রয়।’ বাংলা কথাসাহিত্যের জনজীবনমুখী, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার সাহিত্য নির্মাণের পথিকৃৎ লেখক তিনি। তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে সমাজ, রাজনীতি, সমকালীন ও অতীত ইতিহাস। সত্যেন সেন রচিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় চল্লিশ। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : উপন্যাস : ভোরের বিহঙ্গী (১৯৫৯), রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ (১৯৬৩), অভিশপ্ত নগরী (১৯৬৯), পাপের সন্তান (১৯৬৯), সেয়ান (১৯৬৯), পদচিহ্ন (১৯৬৯), পুরুষমেধ (১৯৬৯), আলবেরুনী (১৯৭০), সাত নম্বর ওয়ার্ড (১৯৭০), বিদ্রোহী কৈবর্ত্য (১৯৭০), কুমারজীব (১৯৭০), অপারেজয় (১৯৭০), মা (১৯৭০), উত্তরণ (১৯৭০), একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে (১৯৭১)। বিজ্ঞান ও ইতিহাস আশ্রিত গল্প-উপন্যাস-সাহিত্য : মহাবিদ্রোহের কাহিনী (১৯৫৮), গ্রামবাংলার পথে পথে (১৯৬৬), আমাদের এই পৃথিবী (১৯৬৭), মসলার যুদ্ধ (১৯৬৯), এটোমের কথা (১৯৭০), অভিযাত্রী (১৯৭০), মানবসভ্যতার উষালগ্ন (১৯৭১), মনোরমা মাসিমা (১৯৭১), প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ (১৯৭১), বিপ্লবী রহমান মাস্টার (১৯৭৩), সীমান্ত সূর্য আবদুল গাফফার (১৯৭২), বাংলাদেশের কৃষকের সংগ্রাম (১৯৭৬), জীববিজ্ঞানের নানা কথা (১৯৭৭), ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা (১৯৮৬) ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখিত গল্প : পাতাবাহার (১৯৬৮), অভিযাত্রী (১৯৬৯) অন্যতম। তার সাহিত্য সাধনার উৎস প্রগতিশীল ও গণমুখী চেতনা। ১৯৬৯ সালে ‘পাপের সন্তান’ উপন্যাসের জন্য তিনি ‘আদমজী সাহিত্য পুরস্কার’ ও ১৯৭০-এ ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ পান। ১৯৮৬-তে তাকে ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর) দেয়া হয়।
সত্যেন সেনের সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। মানুষের জন্য সবকিছু উজার করে দিয়ে যারা চলে যায় না ফেরার দেশে, সত্যেন সেন তেমনি একজন মানুষ ছিলেন।
(বিজ্ঞাপন) https://www.facebook.com/3square1
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com