প্রকাশিত : বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪, খ্রিষ্টাব্দ।। ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ(শরৎকাল)।। ২৪ জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক :
স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের নাট্য-সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কারিগর মুনীর চৌধুরী। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, শিক্ষক, ভাষা সৈনিক, সংস্কৃতি সংগ্রামী ও রাজনীতিক। বাংলা আর বাঙালির প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদে সারা জীবন সোচ্চার ছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে সরকার যখন রেডিও আর টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তার প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন মুনীর চৌধুরী। ক্লাসরুম থেকে সাহিত্যসভা সব জায়গাতেই সমান জনপ্রিয় ছিলেন মুনীর চৌধুরী।
এক সাহিত্য-সভায় কবি আব্দুল কাদির চৌধুরী তাকে আগেই বলে নিয়েছিলেন, ‘ও মুনীর স্যার, আপনি কিন্তু পরে বলবেন, আমরা আগে বলে নিই। আপনি আগে বললে আমাদের কথা শোনার জন্য কোনো শ্রোতা থাকবে না।’ তুমুল জনপ্রিয়তা আর অসামান্য মেধার কারণেই হয়ত পাক-দোসরদের নীল নকশায় মুনীর চৌধুরীর নামটি ছিল প্রথম সারিতে।
আজ ২৭ নভেম্বর ভাষা সৈনিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, শিক্ষাবিদ ও লেখক শহীদ মুনীর চৌধুরীর ৯৬তম জন্মদিন। ১৯২৫ সালের এইদিনে পিতার কর্মস্থল মানিকগঞ্জে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতৃভিটা বৃহত্তর নোয়াখালীতে। শহীদ মুনীর চৌধুরীর পিতার নাম খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী, মাতা উম্মে কবীর আফিয়া।
ইংরেজ আমলের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল হালিম ছিলেন ইংরেজি আর আরবির পণ্ডিত। চৌদ্দজন ছেলেমেয়ের সবাইকে রীতিমত হাতে ধরে প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছেন তিনি। চাকরির বেতন পেয়ে মাসে মাসে বই কিনেছেন, বাড়ি জুড়ে গড়ে তুলেছেন বইয়ের সাম্রাজ্য। সন্তানদেরকে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা বইয়ের রাজ্যে ডুবে থাকার প্রেরণা দিয়ে গেছেন তিনি। আর এই অনুপ্রেরণা পেয়েই হয়ত একই পরিবার থেকে বেরিয়ে এসেছেন জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী, অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার আর নাট্যকার মুনীর চৌধুরী।
চল্লিশের দশকে স্টাইলিশ বলতে যা বোঝায় তার ষোলআনা একদম রপ্ত করে নিয়েছিলেন আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী। শুধু স্টাইল কিংবা বাইরের চাকচিক্য দিয়েই নয়, এই যুবকের জ্ঞানের ধারও ছিল বেশ প্রখর। শেক্সপিয়র, বার্নার্ড শ’কিংবা ভিক্টর হুগো সবই পড়া হয়ে গেছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যিক অঙ্গনে এসে আড্ডা জমাতে বেগ পেতে হয়নি তার।
তিনি ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। স্কুল জীবনে তার হাতে পাঠ্য বইয়ের বাইরে হাজারো রকমের বই দেখে স্কুলের সহপাঠীরা তার নাম দিয়ে দিলো ‘চালিয়াত’। পরবর্তীতে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। ধীরে ধীরে যুক্ত হয়ে পড়লেন বামপন্থি আন্দোলনের সাথে।
অনলবর্ষী বক্তা হিসেবে মুনীর চৌধুরীর খ্যাতি তখন পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঢেউও তখন একটু একটু আছড়ে পড়ছিল পূর্ব বাংলার বেলাভূমিতে। লেখালেখি করবেন বলে তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে খুলনার একটি কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে শিক্ষক জীবন শুরু করেন।
এরপর জগন্নাথ কলেজ এবং পরে (১৯৫০ সালে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বাম রাজনীতি করার অভিযোগে তাকে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
মুনীর চৌধুরী ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং গ্রেফতার হয়ে দুই বছর জেলে বন্দি ছিলেন (১৯৫২-৫৪)। জেলখানায় তিনি ‘কবর’নাটক রচনা করেন। তিনি ছিলেন ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক (১৯৫২)। ষাট দশকের প্রথম দিকে পাকিস্তান সরকার বেতার-টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করলে যে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু হয়, মুনীর চৌধুরী তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭০ সালে ঢাবিতে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।
তিনি ১৯৭০ ও একাত্তর সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন। মুনীর চৌধুরী রচিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- চিঠি (১৯৬৬),পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য ( ১৯৬৯ )। তার অন্যতম ও অনন্য সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে বাংলা টাইপরাইটার কি-বোর্ড ‘মুনীর অপটিমা টাইপরাইটার কি-বোর্ড’।
তিনি বাঙালির প্রেরণার অনন্য সূতিকাগার। বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ‘মীর মানস’গ্রন্থের জন্য ১৯৬৫ সালে দাউদ পুরস্কার, পাক-ভারত যুদ্ধ নিয়ে তার রচনা সংকলন ‘রণাঙ্গন’এর জন্য ১৯৬৬ সালে তিনি লাভ করেন ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’। ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ বাঙালিদের প্রতি অবিচার আর অনাচারের প্রতিবাদে ডাক দেয়া অসহযোগে সাড়া দিয়ে এই সম্মান বর্জন করেন মুনীর চৌধুরী।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাসা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের দোসর আল-বদরের সদস্যরা। বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দেয়ার মহাযজ্ঞে তাকেও জীবন বলি দিতে হয়েছিল। রায়েরবাজারের সেই বধ্যভূমি থেকে অন্য আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতোই আলাদা করে সনাক্ত করা যায়নি মুনীর চৌধুরীকে। ‘কবর’-এর স্রষ্টা হয়তো ঘুমিয়ে আছেন সেই গণকবরেই। কিন্তু তার অসামান্য কীর্তি আজীবন তাকে জ্বলজ্বল করে রাখবে বাঙালির চেতনায়-প্রেরণায়।
(বিজ্ঞাপন) https://www.facebook.com/3square1
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com
আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।
জাস্ট এখানে ক্লিক করুন। https://www.facebook.com/BikrampurKhobor