বড় সাধ জাগে

0
3
বড় সাধ জাগে

প্রকাশিত : শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪, খ্রিষ্টাব্দ।। ৬ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ(হেমন্তকাল)।।১৭ জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরী।

বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : তিনি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি’-র প্রতীক্ষাই হোক, কিংবা ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’-র আকাঙ্ক্ষা, ‘তোমায় কেন লাগছে এত চেনা’-র আবিষ্কার, বা ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই’-এর খোঁজ – আপাত নির্লিপ্ততার মধ্যেও ওঁর গানে ধরা দিয়ে যায় পরম মমত্বের স্পর্শ।

আকুল স্বরে প্রতিমা যখন গান, ‘দরস বিন দুখন লাগে ন্যায়ন, যবসে তুম বিছুরে প্রভু মোরি তবহু না পায়ো চৈন’, তখন যে আত্মহারা সমর্পনের সুর শোনা যায়, ভাওয়াইয়াতে ‘বগাকে দেখিয়া বগী কান্দে রে, বগীকে দেখিয়া বগা কান্দেরে’-তে বগা-বগীর বিচ্ছেদব্যথায় যেন সেই একই সুর বাজে ওঁর কন্ঠে। যেন ধ্বনিত হয় সেই চিরন্তন কান্না – ‘কেন মেঘ আসে হৃদয়আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না।’ নচিকেতা ঘোষের সুরে ‘সুজাতা’ ছবিতে প্রতিমা গান ‘চাঁদ বললে ভুল হয়, ফুল বললেও ভুল হয়’। এ গানে বাৎসল্যের ভাবটিও প্রকাশিত হয় এক বিশেষ মাত্রায় -যেন মায়ের আত্মসমর্পনেরই ছবি ফুটে ওঠে, তাঁর ‘ইচ্ছে দিয়ে সৃষ্টি’ খুকুর নির্মলতার কাছে। আবার ‘ও গঙ্গা অঙ্গে তোমার কত না তরঙ্গ’ গানে গঙ্গাস্রোতের মুক্তির হাতছানিতে ‘মনের প্রদীপটি’ ভাসান প্রতিমা। সে গঙ্গাই হয়ে ওঠে পরম-চাওয়া, যখন, ‘নেই কেউ দরদী, এ ব্যথা বোঝে না, মায়া-শিকল বাঁধা এ দুটি পায়ে।’ করুণ অনুরোধে বলেন প্রতিমা – ‘নাও না গো সঙ্গে মিনতি জানাইলাম, সেই আলোর দেশে মিনতি জানাই।’ সমর্পনের উদ্দেশ প্রভুই হোন বা প্রেমিক, সন্তান কিংবা অজানা আলোর দেশ – প্রতিমা অদ্বিতীয়া।
১৯৬৮ সালের পুজোর রেকর্ডে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় গেয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত ‘আঁধার আমার ভালো লাগে’ গানটি। সে গানে আঁধারকে ভালোবেসে প্রতিমা বলেন, ‘তারা দিয়ে সাজিও না আমার আকাশ, আঁধার আমার ভালো লাগে।’ এর মধ্যে নিবিড় প্রত্যাশা রয়েছে – ‘রাতের গভীরে আজ বঁধুয়ার পরশে হাজার প্রদীপ যাবে জ্বলে, বঁধুয়ার পরশেতে জ্বলে যাবে এই রাত রাগে-অনুরাগে-ভালোবাসাতে।’ কী অনায়াসে আত্মমগ্ন প্রতিমা সেই প্রত্যাশার সুরটি ফুটিয়ে তোলেন! তারপরেই শুনি, ‘জানি না তো বঁধু ওগো মরণ রয়েছে লেখা, ভালোবেসে আজি এই রাতে।’ এমন বাঁধভাঙা আত্মসমর্পণ একমাত্র প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠেই ফুটে উঠতে পারে! এই সুরই আবার শোনা যায় ‘স্ত্রীর পত্র’ ছবিতে, যখন তিনি গান – ‘ছোড় চলি অব মহল অটারি, মাতা-পিতা-ভ্রাতা কোই না হামারি, রানাজি ভেজা জহর কি প্যায়ালা মৌৎ কা সঙ্গ সঙ্গাতি।’ রাধাকান্ত নন্দীর অপূর্ব শ্রীখোল সঙ্গতে, সাধিকা মীরার আর্তি কী অবলীলায় প্রতিভাত হয় প্রতিমার গায়নে!
ব্যক্তিগত স্মৃতিতে ধরা দিয়ে যায়, শৈশবে, দূরদর্শনের পর্দায় প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রথম দেখার ছবি। সে অনুষ্ঠানের প্রথমার্ধে বেজেছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ডিং। তাঁর অপূর্ব গায়নে, অননুকরণীয় ভঙ্গিতে, আর সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের তবলাসঙ্গতে ‘এই মৌসুমী মন শুধু রং বদলায়’, ‘আহা না রয়না বাঁধা রয়না থৈথৈ মন’ শুনে যখন মনে রীতিমত বিদ্যুৎশিহরণ খেলে চলেছে, ঠিক তখনই শুরু হল প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান। লাল-কালো শাড়ি, মাঝকপালে সিঁদুরের বড়ো টিপ পরে গান গাইছেন প্রতিমা। মাঝেমধ্যে ঝিলিক দিচ্ছে নাকছাবিটি। ভাবলেশহীন মুখ, শরীরেও বিশেষ নড়াচড়া নেই। একভাবে বসে কী অবলীলায় গেয়ে চলেছেন – ‘কুসুমদোলায় দোলে শ্যামরাই তমালশাখে দোলা ঝুলে ঝুলনে’, ‘সাতরঙা এক পাখি পাতার ফাঁকে ডালে ডালে করছে ডাকাডাকি’, ‘আমার সোনা চাঁদের কণা ভুবনে তুলনা নাইরে!’ অথচ চোখেমুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই! পান-খাওয়া লাল ঠোঁটদুটি শুধু নড়ে চলেছে। কী গভীরভাবে আত্মমগ্ন! ততক্ষণে আমি স্থির হয়ে গিয়েছি। ডুব দিয়েছি প্রতিমার মগ্নতার রহস্যময় গভীরে… এই রহস্যই যেন বারবার, ফিরে ফিরে শুনতে বাধ্য করেছে ওঁর গান। কেন এ রহস্য? কার জন্য গান প্রতিমা? মনে জেগেছে এমনই সব প্রশ্ন। তাঁর গান এবং গায়নই আভাসে পথ দেখিয়েছে প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের।
প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকাশবিহ্বলতা-বিমুখ, অন্তর্মুখী গায়নে, এক অন্তহীন খুঁজে চলা রয়েছে। এক আকুল অনুসন্ধান। কিন্তু সে খোঁজা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত। সেখানে আর কারও স্থান নেই। যাঁকে খুঁজে চলে প্রতিমার গান, গান তাঁরই। শ্রোতা সেই অনুসন্ধানদৃশ্যের সাক্ষীমাত্র। হয়তো তাই প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানে কোথাও এক দুর্ভেদ্য রহস্য থেকে যায়। তবু জল যত স্থির, তাতে প্রতিবিম্ব তত স্পষ্ট। প্রতিমার অচঞ্চল, বিকারহীন স্বচ্ছ কন্ঠে কি তাই সেই গভীর রহস্যময়ের ছবি এমনভাবে ফুটে উঠতে পারে?
‘ছুটি’ ছবির ‘আমার জীবন নদীর ওপারে এসে দাঁড়ায়ো বঁধূ হে’ গানে যখন শুনি, ‘দিনের আলোটি নিভে যাবে, আঁধার আসিবে ধীরে, তুমি নয়নের কোনে সোহাগের দীপ জ্বালিয়া রেখো হে ধীরে’ – সমস্ত অন্তর উজাড় করে সেই উদ্দিষ্টকে পরম-পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে ইচ্ছা করে। ‘আপনা হারায়ে নিজে হারা’ হয়ে যেমন অদ্বৈততায় উপনয়ন, তেমনই সেই সত্তাকে ভক্তির কুসুমে বিকশিত করে যখন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় গেয়ে ওঠেন, ‘আমি তোমার দীপ নিভালে অভিমানে, মোর প্রাণের বীণা দিওগো ভরি গানে/তোমারই প্রেম আমারই প্রাণে সাধা/আমারে বেঁধে পড়েছ তুমি বাঁধা’ – তখন সত্যই মনে হয়, এ ‘অদ্বৈতাদপি সুন্দরম্!’
যে কোনও শিল্পীর সত্তার প্রকাশ যেমন থাকে তাঁর শিল্পে, তেমনই থাকে জীবনধারাতেও। গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “মানুষ প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কত বড়ো আপনারা ভাবতেও পারবেন না। বিরাট মন ছিল ওর। ওকে কারও সমালোচনা করতে শুনিনি।” নির্মলা মিশ্র বলেন, “রুনিদি কম কথা বলতেন ঠিকই। তবে মনের মতো পরিবেশ পেলে এমন মজার মজার কথা বলতেন যে আমরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তাম। কোনও ছল-চাতুরি ছিল না।” বাণী ঘোষাল সেকালে এম.এ. পাশ ছিলেন, আবার আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালো ইংরাজি বলতে পারতেন – এ নিয়েও যেন গর্বই ছিল প্রতিমার।
এক সাক্ষাৎকারে, দুই শিল্পীবন্ধুর এই গুণের কথা বলেই, নিজের ইংরাজি না জানার কথা, এবং ইংরাজি না জানায় এক অনুষ্ঠানে লজ্জায় পড়ার ঘটনা তিনি উল্লেখ করেছিলেন মজার সুরে। দূরদর্শনের সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ উস্তাদ আলি আকবর খানের সুরে ‘ক্যায়সে কাটে রজনী ইয়ে সজনী’ রেকর্ডিংয়ে নাকি সবাইকে বড়ই ভুগিয়েছিলেন। অথচ একটিবারও সেখানে উল্লেখ করেননি, ওস্তাদ আমীর খাঁ’র সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে সে গানের রেকর্ডিং-এর পর, খাঁ সাহেবের উচ্ছসিত প্রশংসার কথা!
প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানে শুধু না, চরিত্রেও এক অপূর্ব নিরাসক্তি লক্ষ করা যায়। এ যেন পূর্ণ হয়েও শূন্য হয়ে থাকা, আবার শূন্যেও পূর্ণতার আভাস পাওয়া। গভীরভাবে আত্মমগ্ন সাধিকার এক অপূর্ব ভাব প্রতিমার সামগ্রিক সত্তার মধ্যে বর্তমান। সে ভাবটির হাত ধরেই এগিয়েছে ওঁর অন্তর্জীবন, বহির্জীবন। ‘সারেগা’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিমা-কন্যা রাইকিশোরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাতেও মেলে সেই কথারই আভাস। তাঁর লেখাতেই জানা যায়, একরকম জোর করেই প্রতিমাদেবীকে মুম্বই নিয়ে গিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ‘সাহারা’ ছবিতে মীনাকুমারীর লিপে গানও গাইয়েছিলেন। সে গান জনপ্রিয়ও হয়েছিল। লতা মঙ্গেশকর থেকে গীতা দত্ত, সকলে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন মুম্বইতে থেকে যেতে। কিন্তু মাত্র মাসখানেক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মুম্বইের বাড়িতে থাকার পরেই কলকাতায় ফিরে আসেন প্রতিমা। নিজের ছোট দুই সন্তান-স্বামী-সংসার ফেলে থাকতে পারেননি। বলিউডের আলোর ঝলকও ভেদ করতে পারেনি তাঁর নির্লিপ্ত নিরাসক্তিকে। প্লেনে চড়তে ভয় লাগত বলে ফিরিয়ে দিয়েছেন বিদেশের অজস্র অনুষ্ঠানে গান করার সুযোগ। একবার মাত্র গিয়েছিলেন পড়শি দেশ বাংলাদেশে।
রাইকিশোরী দেবীর লেখাতেই পাই, ১৯৮৬ সালে স্বামী অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণে খুব ভেঙে পড়েন প্রতিমাদেবী, কারণ তাঁর সঙ্গীতজীবনে অমিয়কুমারের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। শোকের অভিঘাতে শরীর-মন ভেঙে পড়তে থাকে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। চলৎশক্তি হারান। রাইকিশোরীর কথায়, “লেখাজোকা তো দূরের কথা, যে কোনও ঘরের কাজেও মা এখন অক্ষম, সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার, গানের সঙ্গে মায়ের সেই ছেলেবেলার বন্ধনটা কিন্তু এখনও তেমনি আছে। গান মাকে ছেড়ে যায়নি বা মা গানকে। হারমোনিয়মটা কোলের কাছে এগিয়ে দিয়ে ধরে-বেঁধে বসিয়ে দিলে এখনও, এই অবস্থাতেও একটার পর একটা গান মা গেয়ে যেতে পারেন অক্লেশে।”
হয়তো তাই শেষ জীবনেও তিনি বলেছিলেন – “প্রাপ্যের চেয়ে প্রাপ্তি আমার ঢের বেশি।”
_______________________
কলমে: শৌণক গুপ্ত।
তথ্য সূত্রঃ কিছু কথা।। কিছু সুর।।

নিউজটি শেয়ার করুন .. ..           

‘‘আমাদের বিক্রমপুরআমাদের খবর

আমাদের সাথেই থাকুনবিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’

Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com

আমাদের পেইজ লাইক দিন শেয়ার করুন

জাস্ট এখানে ক্লিক করুন। https://www.facebook.com/BikrampurKhobor

email – bikrampurkhobor@gmail.com

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন