প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার,২২ অক্টোবর ২০২০ইং ।। ৬ই কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)।। ৪ঠা রবিউল আউয়াল,১৪৪২ হিজরী
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : বিংশ শতাব্দীর আটচল্লিশ সাল। মাত্র কয়েকমাস হল, বড় একটা দেশকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। দুটোই এখনো অগোছালো। আলাদা পরিচয়ে নিজেদের ভাগে যত মানুষ পড়েছে, সেগুলো নিয়েই নিজেদের মতো সীমানা আর সংসার পাতায় ব্যস্ত নতুন ভূখণ্ড দুটি। কে কোথায় থাকবে সেই সিদ্ধান্তটা যে মানুষের মন মতো হয়েছে তা বলা যাবে না। বাপ-দাদার দেয়া বহু পুরনো সেটআপ ভেঙে নতুন সেটআপে যেতে অনেকেরই অনীহা। মূলত ধর্মের ভিত্তিতেই এই ওলটপালট। হিন্দু-মুসলিম দ্বৈরথের ফলই ছিল এ পুনর্গঠন।
আজকের গল্পটা শুরু করা যাক ওই ওলটপালট সময়ে ঢাকার সূত্রাপুরের একটা হিন্দু পরিবার দিয়ে। দুই ভাই হরিপদ ঘোষ আর দয়াল ঘোষ। দেশ ভাগটাগ হয়ে একাকার কিন্তু এই দুই ভাই তখনো ভাগ হননি। তারা ঠিক করেন যেখানে তাদের বাপ-দাদার বেড়ে ওঠা সেখানেই থাকবেন। তবে কি করে পরিবার চালাবেন তা ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না তারা! বাবার ইচ্ছে ছিল ইসলামপুরে থান কাপড়ের পাইকারি দোকান দেবেন, কিন্তু দু’ভাইয়ের আগ্রহ ছিল না এ ব্যবসায়। কারণ, এমন দোকান পুরান ঢাকায় অহরহ। এমন পরিস্থিতিতে খুব একটা লাভজনকও নয়।
‘তাহলে কী করা যায়?’ হরিপদের প্রশ্নের বিপরীতে খানিকটা সময় নিলেন দয়াল। সপ্তাহখানেক পর জানালেন নিজের উত্তর। তার উত্তরে হরিপদও খুশি। বাতির ব্যবহার পুরান ঢাকায় নাই বললেই চলে। প্রতিদিনইতো কত অনুষ্ঠান লেগে থাকে, এ পাড়ায়-ওপাড়ায়। আর পুরার ঢাকার মানুষের শখ তো আশি টাকারও বেশি তোলা! অতি অল্পতেই তারা উত্সবে গা ভাসিয়ে দিতে চায়। তুচ্ছ বিষয়েও অনুষ্ঠানের ডাক দেয় তারা। ভাবে কয়দিন আর বাঁচবে? দিন থাকতে জাঁকজমক-ফুর্তি যত দূর করা যায়। হরিপদ ভাবেন, এই ব্যবসাই চালু করা যায়, বেশ মুনাফা আসবে।
কথা মতো মাসখানেকের মধ্যে ব্যবসা শুরু করেন। কয়েক মাইল মরিচবাতি, পাঁচ-ছয়টি হ্যাজাগ, কটা রেভলবিং লাইট, আর কয়েকজন কর্মচারী। ব্যস আর কি! ঠিকানা লক্ষ্মীবাজার মনুর গলি। নাম দিলেন ‘আরজু লাইট হাউস’। মহল্লার মুরুব্বিদের ডেকে এনে প্রাসাদ খাওয়ালেন দুই ভাই। সেদিনই অর্ডার আসলো একই পাড়ার শ্যামলকান্তি বড়ালের বাড়ি থেকে। বিয়ে বাড়ি সাজাতে হবে হরেক রকমের বাতি দিয়ে, হরিপদ ৩ টাকা অগ্রিম নিয়ে অর্ডারটা বুকিং নেন। তারপর থেকে কয়েকমাস বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু তাদের দেখাদেখি আরো বেশ কিছু বাতি দোকান হয়ে যায় পুরান ঢাকায়। ‘ইদ্রিস ডেকোরেটর’, হিরণবাবুর ‘লতামোহিনী লাইটিং’সহ আরো কত কি নামি-বেনামি প্রতিষ্ঠান! তারপরই ব্যবসায় নেমে আসে লাল বাতি! দুভাই ভাবলেন, এভাবে চলতে থাকলে তো আর খেয়ে বাঁচা যাবে না।
হটাৎ একদিন হরিপদের মাথায় একটি আইড়িয়া এল, পুরান ঢাকায় লাইট আর সাউন্ডের দোকান নেই খুব একটা। তার এই ভাবনা জানান ভাই দয়ালকে। তারপর দুই ভাই মিলে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য বৃদ্ধ পিতার অনুমতি নেন। লাইটের পাশাপাশি গ্রামোফোনও ভাড়া দেয়া শুরু করলেন তারা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লাইটের সঙ্গে গ্রামোফোন ভাড়া নিতে থাকে লোকজন। তারপর দোকানটি পরিচিত হয়ে ওঠে অল্পদিনেই। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভারত থেকে কয়েকটি মাইক নিয়ে আসেন দুই ভাই। তাতেও যেন চাহিদা মেটাতে পারছিলেন না তারা। কোনো কূল না পেয়ে হরিপদ ঘোষ যন্ত্রপাতি কিনে এনে নিজে কয়েকটি হ্যান্ডমাইক তৈরি করেন। তার আগে বলে রাখা ভালো, তিনি মাইকের কাজ শিখে এসেছিলেন ভারত থেকে মাইক কেনার সময়। এমনিতেই তারা মানুষের চাহিদা ঠিকমতো মেটাতে পারছিলেন না তার ওপর পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। আন্দোলনের নেতাকর্মীরা মাইক ভাড়া নিতে শুরু করেন এই দোকান থেকে। চাহিদা বাড়তে থাকে দিনদিন। সময় যত বাড়ে, বাড়তে থাকে আন্দোলন। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মাই সার্ভিসের চাহিদা।
পরের মাসেই ভারত থেকে আরো ৯টি মাইক কিনে আনেন। এবার তারা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবসাকে আলাদা নাম দিতে চান। হরিপদ ভাবেন এমন একটা নাম দরকার যে নামটা বলতে সহজ, কিন্তু তার মধ্যে ‘সদা প্রস্তুত’ ভাবটা থাকবে। এই দায়িত্ব দেয়া হয় পাশের জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্র-ছাত্রীদের। যার নাম পছন্দ হবে তার জন্য পুরস্কারেরও ব্যবস্থা করেছিলেন তারা। অবশেষে তারা নাম পেলেন। জগন্নাথ কলেজের এক ছাত্রের বুদ্ধিতে নতুন নাম রাখেন ‘কল-রেডি’। যে কেউ যেকোনো সময় ডাকলে যাতে প্রস্তুত থাকতে পারে, এমন মাইক কোম্পানিই বানাতে চান হরি আর দয়াল। বলা তো যায় না বাংলার মুখ্যমন্ত্রীরা যদি ঢাকায় এসে সমাবেশ করতে চান! তখনও যাতে কল-রেডি হাতের নাগালে থাকে, যেন তখন তাদের জাদুকরী কণ্ঠের সামনে এই মাইক ধরা যায়।
ভালো সেবা দেয়ার সুনাম থাকায় যেকোনো সভা-সমাবেশ ও বড় বড় অনুষ্ঠানে ডাক পড়তে থাকে কল-রেডির। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির কর্মী ছিল ২০ জন। সভা-সমাবেশ সুনামের সঙ্গেই সম্পন্ন করতেন হরিপদ ও দয়াল ঘোষ। মাঝেমধ্যে তাদের ছোট দুই ভাই গোপাল ঘোষ ও কানাই ঘোষও সাহায্য করতেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশেও যোগ দিয়েছে কল-রেডি। তাদের মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানের বাঘা বাঘা নেতা।
১৯৭১, হাটে-মাঠে-ঘাটে সব জায়গায় তখন স্বাধিকারের চেতনায় ফুঁসছে মানুষ। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকে সারা দেশের মানুষ ভোট দিয়েছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। দফায় দফায় মিটিং করেও হচ্ছে না সুরাহা। চলে এল মার্চ। কল-রেডির মালিক হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষকে ধানমণ্ডির বাসায় ডেকে পাঠালেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) মাইক লাগাতে। কাজে নেমে পড়েন হরিপদ ও দয়াল ঘোষ। তখন রেসকোর্সে মাইক লাগানো সোজা ছিল না-শাসকগোষ্ঠীর চোখ ছিল সদা সতর্ক। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে মাইক লাগাতে লাগলেন দুই ভাই। ৭ই মার্চের বাকি আর ৩দিন। মাইক লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন হরিপদ আর দয়াল ঘোষ। কিছু বাড়তি মাইক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মজুদ রাখেন যেন সমাবেশের দিন তাৎক্ষণিকভাবে লাগিয়ে নিতে পারেন। তিন দিন ধরে ৩০ জন কর্মী নিয়ে বাঁশ, খুঁটি গাঁথার কাজ করেন ঘোষেরা। তারপর সেই দিনটি আসে-৭ই মার্চ। কবি গিয়ে দাঁড়ান জনতার মঞ্চে। মুখের সামনে কল-রেডি। বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণকালে যেন কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি না হয়, সে জন্য নিজে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দিয়েছিলেন হরিপদ ঘোষ। অতিরিক্ত তিনটি মাইক্রোফোন সঙ্গে রেখেছিলেন দয়াল ঘোষ।
এত বড় একটি সমাবেশে মাইক সার্ভিস দিয়ে কত টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছিল কল-রেডি? জানতে চাইলে হরিপদ ঘোষের ছেলে কল-রেডির বর্তমান পরিচালক সাগর ঘোষ জানান, সেই সময় পারিশ্রমিকের কথা চিন্তা করার সুযোগ বাবা ও জ্যাঠা মশাইয়ের ছিল না। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন সেটাই বড় কথা। আর তা ছাড়া দেশের পরিস্থিতি তখন সবাই কম-বেশি জানতেন। আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাবা-কাকার ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে বাবা শুধু খরচটাই নিতেন। সেদিন সেই সমাবেশে আমার বাবার হাতে তৈরি অনেক হ্যান্ড মাইক ব্যবহৃত হয়েছিল।’ তিনি বলেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে কল-রেডির যে মাইক্রোফোনে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই মাইক্রোফোন, মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ড আজও কল-রেডিতে সংরক্ষণ করা রয়েছে।
এরপর বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আবারো কল-রেডির মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন।’ দেশ-বিদেশের অনেক বিখ্যাত মানুষ কল-রেডির মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, শেখ হাসিনাসহ আরো অনেকে আছেন এই তালিকায়। বিদেশের নেতাদের মধ্যে আছেন ভারতের ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে এসে তার জন্য গড়া ইন্দিরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে কল-রেডির মাইক্রোফোনে ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। এরপর ১৯৯৬ সালে ইয়াসির আরাফাত এবং নেলসন ম্যান্ডেলা কল-রেডির মাইক্রোফোনে ভাষণ দেন। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়িও কল-রেডিতে কথা বলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি সমাবর্তনে মাইক সার্ভিস দেয় কল-রেডি। ১৯৮১ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি সভা-সমাবেশে মাইক সার্ভিস দিয়েছে কল-রেডি। বর্তমানে ৩৬, এইচকে দাস রোড, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর থেকে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে সেবা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
এখনো ঢাকায় কল-রেডির ডাক পড়ে। মাইক শব্দটি কানে এলেই সবার মনে পড়ে কল-রেডির কথা। বর্তমানে কল-রেডির মালিকসহ ২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে সাগর ঘোষ বলেন, ভালো সেবা দেওয়ার সুনাম থাকায় যেকোনো সভা-সমাবেশ, সামাজিক ও ধর্মীয় বড় বড় অনুষ্ঠানে কল-রেডির ডাক পড়ে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের প্রতিটি বড় সভা-সমাবেশে তাদের ডাকা হয়। গতকাল আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রায় ৪০০ মাইক লাগিয়েছে কল-রেডি।
কল-রেডির বয়স এখন ৭২ বছর। শুরুর সেই জায়গায়ই আছে কল-রেডি। একটি মাইকের দোকানের এই দীর্ঘ পথ চলাকে কিভাবে দেখেন জানতে চাইলে সাগর বলেন, অনেক পথ কল-রেডী পাড়ি দিয়েছে এটা সত্য। তবে এতটা পথ পাড়ি দেয়া খুব একটা সহজ ছিল না। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের এই অবস্থানে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখনো সারা দেশের মানুষ এক নামে কল-রেডিকে চেনে। দেশে বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজকরা এখনো অনুষ্ঠানের জন্য প্রথমে কল-রেডিকেই ডাকে। সুন্দর-সুষ্ঠু এবং যথাযথ সেবা দানের কারণে মানুষের এই আগ্রহ বলে আমি মনে করি। আমার জানা মতে, কখনো কল-রেডি সেবাদানের সময় বড় কোনো যান্ত্রিক গোলযোগের মুখোমুখি হয়নি। এর কারণ সব সময় আমাদের সঙ্গে একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার থাকেন।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’