প্রকাশিত: রবিবার ৭ নভেম্বর ২০২১ইং।।২২শে কার্তিক ১৪২৮বঙ্গাব্দ(হেমন্তকাল)।।৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩ হিজরী।।
বিক্রমপুর খবর : অফিস ডেস্ক : অমর একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র রচয়িতা কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। পরাধীন জাতিকে যেমন উদ্বেলিত করেছিলো রবীন্দ্রনাথের গান ‘আমার সোনার বাংলা;’ নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ তেমনি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কবিতাটিও বাঙালি জাতিকে অগ্নি শিখার মত প্রজ্জ্বলিত করেছিলো। পাকিস্তানি শাসকদের ফাঁসির দাবি করা মোটেও সহজ কথা নয়। একটি মাত্র কবিতা শাসক গোষ্ঠীকে এতটা তীব্রভাবে চিনিয়ে দিয়েছিলো যা শত শত পৃষ্ঠা গবেষনা দিয়েও সম্ভব হয়নি। এটা আকস্মিক ভাবে হয়নি, এই অমর কবিতার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর চেতনার মধ্যে। সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্ধুদ্ধ মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছোটকাল থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। তিনি বিপ্লবী কবি সুকান্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ‘চট্টগ্রামের ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক উদ্যোগও সাংস্কৃতিক কর্মধারার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। ১৯৫২ সালে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম প্রাদেশিক ভাষা আন্দোলন কমিটির সদস্য। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এসবই তাকে প্রতিবাদী করেছে। কোনো দুষ্কালের নির্মম প্রহারও তার চেতনা থেকে বাঙালি ঐতিহ্যের বিচ্যুতি ঘটাতে পারেনি। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তার মত লড়াকু কবির ওপর চড়াও হতে কুন্ঠিত হয়নি। তিনি নিজে বলেছেন, ‘এক সময় রাজনীতি করতাম- এই অজুহাতে এই দেশে যখনই রাজনৈতিক দুর্যোগ নেমে এসেছে তখনি আমার বাসস্থান বার বার পুলিশ কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছে। আর আমার বইপত্র, মূল্যবান রাজনৈতিক দলিল ও পান্ডুলিপি গুলো হয়েছে এই আক্রমণের শিকার।’ আজ কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ৯৫তম জন্মদিন। ১৯২৭ সালের আজকের দিনে তিনি চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার গহিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অমর একুশের প্রথম কবিতার কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী জন্মদিন ফুলেল শুভেচ্ছা।
কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ১৯২৭ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার এক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আহমদুর রহমান চৌধুরী এবং মাতা রওশন আরা বেগম। ১৯৪৭ সালে গহিরা হাইস্কুল হতে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। তরুণ বয়সে মাহবুব উল আলম চৌধুরী ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সমাজতন্ত্রের সাড়া জাগানো ভাবাদর্শের প্রভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের জীবনে সোনালি ভবিষ্যৎ রচনার সংগ্রামী মন্ত্রে। এ সবই তাঁকে প্রণোদিত করেছিল বামপন্থী আন্দোলনে শামিল হতে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর কলেজ পরিদর্শনে এসে ছাত্রদের উদ্দেশে বক্তৃতা প্রদানকালে আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করলে মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রতিবাদে সোচ্চার হন এবং শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখেই কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র রাজনীতির সংস্পর্শে এসেছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে। ক্রমেই হয়ে উঠেছিলেন বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় কর্মী এবং বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তিনি রাজনীতির গণ্ডিতেই জীবনকে আবদ্ধ রাখেননি। বরং দীর্ঘ কর্মজীবনে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মধ্যে মেল-বন্ধন রচনায় সচেষ্ট ও ব্রতী হয়েছিলেন। ১৯৫০ সালে পাকিস্তান মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে রিপোর্টে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা এ অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। মাহবুব উল আলম চৌধুরী ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালেল ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনার খবর পেয়ে চট্টগ্রামে জ্বরাক্রান্ত অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখে “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি” কবিতাটি রচনা করেন। এ কবিতাটি ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত প্রথম কবিতা হিসেবে স্বীকৃত। কবিতাটি প্রকাশের পর পরই বাজেয়াপ্ত হয়। দীর্ঘকাল নিষিদ্ধ থাকার কারণে এক সময় কবিতাটি হারিয়ে যায়। কারো কাছ থেকেই কবিতাটির পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায় নি। এমনকি কবি নিজেও তা দিতে পারেন নি। দীর্ঘদিন পরে ১৯৯১ সালে অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হকের গবেষণায় কবিতাটি সম্পূর্ণ রূপ পায়।
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। ১৯৫৩ সালে গণতন্ত্রী পার্টি গঠিত হলে তিনি তার কেন্দ্রীয় কমিটির সভ্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করেন। ১৯৬৫-৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির দুটি অংশের মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে দলটি দ্বিখন্ডিত হয়ে যাবার পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করেন এবং শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত থাকেন। ১৯৫৩ সালে তিনি কবি নজরুল নিরাময় সমিতি গঠন করেন এবং এ সমিতির অর্থায়নে অসুস্থ কবি নজরুলকে চিকিৎসাকল্পে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৬৬ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ফাদার পীয়ের সহায়তায় গ্রামের উন্নতি সাধনের জন্যে নিজ গ্রামে শান্তির দ্বীপ প্রকল্প শুরু করেন। ১৯৭২ সালে তিনি চট্টগ্রাম হতে প্রকাশিত দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন।১৯৫৪ সালে ঢাকার কার্জন হলে প্রগতিশীল লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং সংস্কৃতিসেবীদের উদ্যোগে চার দিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে মাহবুবুল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে শতাধিক লেখক-সংস্কৃতিসেবী চট্টগ্রাম থেকে এ সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী আয়োজিত টাঙ্গাইলের কাগমারী সম্মেলনেও তাঁর নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক স্কোয়াড অংশগ্রহণ করে।
রাজনীতি-সচেতন সাংস্কৃতিক কাজে বিপুল ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝে-মধ্যে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর লেখালেখি অব্যাহত থেকেছে। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কবিতার সংখ্যাই বেশি। ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ (১৯৮৮/২০০২/২০০৫) তাঁর সাড়া জাগানো কাব্যগ্রন্থ। এর আগে চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় বলে জানা যায়। সেগুলো হলোঃ চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘আবেগধারা’, কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘ইস্পাত’ ও ‘অঙ্গীকার’। এছাড়া ‘দারোগা’ এবং ‘আগামীকাল’ নামে তিনি দুটো নাটকও লিখেছিলেন। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘বিপ্লব’ নামের পুস্তিকাটি তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৫৬ সালে ‘মিশরের মুক্তিযুদ্ধ’ নামে আর একটি পুস্তিকা চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। শিশু কিশোরদের জন্য ‘ছড়ায় ছড়ায়’ নামের একটি ছড়ার বই ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে। একই বছর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘সূর্যাস্তের রক্তরাগ’। তাঁর জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরে এছাড়াও কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়। সেগুলো হলো- কাব্যগ্রন্থ: সূর্যের ভোর ২০০৬, গরাদভাঙার সংগ্রামীরা জাগো ২০০৭, অদর্শনা ২০০৮, ক্লান্ত বাঁশির সুর ২০০৮, এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে ২০০৮; প্রবন্ধগ্রন্থ: সংস্কৃতি: জাতীয় মুখশ্রী ২০০৬, গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র: স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্র ২০০৬, আলোর সন্ধানে দেশ ২০০৮, সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি ২০০৮ এবং আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ: স্মৃতির সন্ধানে ২০০৮। কর্মকীর্তির জন্য ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি তাঁকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। ২০০১ সালে তাঁকে একুশে পদক ও সংবর্ধনা প্রদান করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেপশন। ২০০৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করে। এছাড়া তিনি বহু স্বর্ণপদক ও সংবর্ধনা লাভ করেন।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী আমৃত্যু অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী চিন্তা-চেতনার মশাল বয়ে গেছেন। ২০০৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হন। পাঁচদিন কোমায় থাকায় পর মাহবুব উল আলম চৌধুরী মাটি ও মানুষের মায়া কাটিয়ে ২৩ ডিসেম্বর গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো একাশি বছর। নামাজে জানাযার পরে বনানী গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। মুত্যুর পরে অবসান হয়েছে তাঁর বর্ণাঢ্য, কর্মময় ও সংগ্রামী জীবনের। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জীবন ও চিন্তা, কর্ম ও অবদান আমাদের কাছে প্রেরণা-উজ্জীবক। একুশের প্রথম কবিতার এই কবির নাম বাংলার ইতিহাস ও বাঙালির হৃদয় থেকে মুছে যাওয়ার নয়। আজ কবি ও ভাষাসৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ৯০জন্মদিন। মৌলবাদ আক্রান্ত বাংলাদেশে লড়াকু কবি- যোদ্ধা, ভাষাসৈনিক মুক্ত বুদ্ধির আপোসহীন চিন্তানায়কের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।