প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ২৬মে ২০২০ ইং ।। ১২ই জ্যৈস্ঠ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ।।
বিক্রমপুর খবর : সাইদ আহমেদ বাবু : বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাসের তীব্র প্রাদুর্ভাবের কারণে সারা বিশ্বে আজ যে হাহাকার নেমে এসেছে।মানব সভ্যতার জন্য এমন মহাবিপদ আর কখনও আসেনি। গোটা বিশ্বে যে লাশের মিছিল ও শোকের ভয়াবহতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে মারাত্মকভাবে। পৃথিবীটাই যেন একটা মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এর মাঝে এসেছে পবিত্র ঈদ।বিশ্বব্যাপি মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উতসব হলেও ঈদ আমাদের সমাজে সার্বজনীন উতসব। ঈদ মানে খুশি। সকল ভেদাভেদ ভূলে আনন্দের এই উতসব করোনা ভাইরাসের কারণে আজ ম্লান হয়ে গেছে।
এমনিতে আমাদের দেশ করোনায় বিপর্যস্ত, আবার প্রকৃতিও ছোবল মেরেছে। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আম্পান গরিবের ঘর বাড়ি ফসল ধ্বংস করেদিয়েছে অনেক জেলায়।। আর এই দুই দানবের অত্যাচারে যখন জনজীবন জর্জরিত, ঠিক তখন এসেছে ঈদ। এমন দিনে কী ঈদ করা যায় ?
এমনই এক ঈদ এসেছিলো আমার জীবনে ১৯৭১ সালে মহান ম্যক্তযুদ্ধের সময়। তখন আমি ছোট। তারপরও স্মৃতি উজ্জ্বল। ৭১সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রমজানের ঈদ ঢাকায় করেছিলাম, ৭১সালে ২৫মার্চ রাতে পাকিস্তানি আর্মির গণহত্যার পর, বাচাঁর জন্য বাবা মা ভাই বোন সহ গ্রামের বাড়ি বাঞ্ছারামপুর গিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের গ্রামের উপর দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা চলাচল করত। আবার পাক আর্মি ও রাজাকারদের নৌকা যাতায়াত করত। এ অবস্থায় দাদার বাড়ি থেকে নানির বাড়ি ঝগড়ারচর চলে গেলাম।কিছুদিন ভালই ছিলাম, তারপর ঘাগুইটা ও উজানচরে পাক আর্মিরা আক্রমন করলে কতবার যে দিনে রাত্রে বাড়ির পাশে পাট-ধান ক্ষেতে গিয়ে পানির মধ্যে নাক ভাসিয়ে লুকিয়ে ছিলাম। সেখানেও নিরাপদ নয়, চলে এলাম আবার দাদা বাড়ী ধারিয়ারচর গ্রামে। কিছুদিন পর ধারিয়ারচর বাজারে, দক্ষিণ দিক দিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে প্রায় ২০টি নৌকায় পাকসেনারা, কল্যাণপুর গ্রামে নৌকা গুলি রেখে, সেখান দিয়ে পাক বাহিনি এবং রাজাকাররা পিছন দিক দিয়ে প্রায় ২ কিলো হেটে যেয়ে উজানচর গ্রামে যুদ্ধরত মুক্তিসেনাদের অতর্কিত আক্রমন করেছিলো। সে আক্রমনে অনেক জান মালের ক্ষতি হয়েছিলো। উজানচর বাজার এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর সহ পুর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাক হানাদাররা। পিছনদিক দিয়ে যেন পাক হানাদাররা আর আক্রমন করতে না পারে তার জন্য আমার মেঝো ভাই মুক্তিযোদ্ধা ফারুকসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বল নিয়ে ধারিয়ারচর গ্রামে আমাদের বাড়িতে আশ্রয়নিলো। গ্রামের বাজারে রাজাকাররা ছদ্মবেশে খবর নিত মুক্তি যোদ্ধাদের। আমাদের গ্রামে ফারুক ভাই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি আমাদের বাড়িতে। গ্রামে পাকসেনাদের আবার আক্রমন হতে পারে তাই, এমনাবস্থায় নিরাপত্তা সংকট, আমাদের পরিবার আবার ঢাকায় চলে আসে। তাই ৭১ এর ২০শে নভেম্বরের ঈদ ঢাকাতেই পালন করি, এখনকার মত তখনও ঘরে ঈদ করেছিলাম।
ঈদ সারাজীবন দিয়েছে আনন্দ, অতীতের সব দুঃখ-গ্লানি মুছে দিয়ে বয়ে আনতো আনন্দের বার্তা; ১৯৭১’র ২০ নভেম্বরের সেই ঈদ ছিল তার উল্টো। এমন বিবর্ণ, নিরানন্দ-বেদনা বিধুর ঈদের চাঁদ ও ঈদ আমার জীবনে আর কখনোই আসেনি। ঈদের দিনের আনন্দের সকালটি ছিল বেদনার । নতুন কাপড় নেওয়াত দুরের কথা ঠিকমত রান্না করা হয় নাই, তবে সেমাই রান্না করা হয়েছিল। আমরা যারা ছোট তাদের জন্য, তবে সেদিন আম্মা সেমাই খাননি, কারন তার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে, আজ ঈদ, এই প্রথম ছেলে কাছে নেই, কেমন আছে – কি খাচ্ছে, এগুলো চিন্তা করে কোনকিছু মুখে দেননি। আব্বা বলেন, মন খারাপ করোনা লক্ষ লক্ষ মায়ের সন্তানেরা যুদ্ধে আছে। আল্লাহর কাছে দোয়া কর যেন তাড়াতাড়ি দেশটা স্বাধীন করে ফিরে আসতে পারে। পাকিস্তানি হানাদারদের হত্যাযজ্ঞ, নিপীড়ন-নির্যাতনে বিপর্যস্ত পুরো দেশ। মুক্তিকামী বাঙালীদের মনে সেদিন ঈদের খুশির চাঁদ এসেছিলো এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গানের মাধ্যমে চাঁদকে ফিরিয়েও দেওয়া হয়েছিলো কেবল একটি স্বাধীন দেশ পাওয়ার স্বপ্ন পূরণের আশায়। অবশেষে সে প্রত্যাশার সূর্য উঠে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।
৭১’এর ঈদের মত আজ বিশ্বব্যাপি করোনা যুদ্ধে ২০২০এর ঈদ, সেদিনের ঈদের মতই নিরানন্দ-বেদনা বিধুর।তাই মনে হচ্ছে না আজ ঈদ। আজ প্রতিটা গ্রামে করোনায় আক্রান্ত, ও প্রিয়জন হারানোর শোকে মানুষের দু’চোখে নেমেছে অশ্রুর ঢল।চারদিকে যেন করুণ সুর বাজছে। আজ করোনায় দেশ-বিদেশে কত সন্তানহারা মা চোখের জল ফেলছে নীরবে। মাতৃহারা বোন কাঁদছে। স্বামী-পুত্র-কন্যাহারা নারীর করুণ আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভরে উঠছে। এ সময় করোনায় মারা গেলে কেউ লাশের কাছে আসতেও নিষেধ রয়েছে।যখন কেউ তার প্রিয়জনকে হারায়, সেই কষ্ট সামলানো প্রত্যেকের জীবনের কঠিন সময়গুলোর একটি। কিন্তু এখন স্বজনকে বিদায় জানানোর সেই ব্যাপারটিকে আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব,পাড়া প্রতিবেশি,সান্তনা যানাতে ও দেখতে আপনজনও কাছে যাচ্ছে না, মাটি দেওয়ার জন্য, প্রিয়জনরা কাছে নেই, অজানা সাহসী সেচ্ছাসেবকরা কাফন-দাফন করছে, সন্তান তার পিতা-মাতার কবরে নেমে মাটি দিয়ে, দোয়াকরে শেষ বিদায় দিবে তাও পারছেনা, এর থেকে কি দু:খ কষ্ট পৃথিবিতে আছে বলে আমার যানা নেই। দূরে থেকেই অন্তরের কষ্ট নিজের ভেতরে সামলাচ্ছে আপনজনরা। শিল্পী হায়দার আলির গানের কথায়- “যার চলে যায় সেই বোঝে যে হায়/বিচ্ছেদে কি যন্ত্রণা/অবুঝ শিশুর অবুঝ প্রশ্ন/কি দিয়ে দেব সান্ত্বনা”।
আজ দেশের ভেতরও এক জেলা থেকে অন্য জেলা প্রায় বিচ্ছিন্ন,যাকে বলা হচ্ছে ‘লকডাউন’। ব্যক্তি পর্যায়ে এ ‘জীবনের মায়া’ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ‘জীবন বাচাঁনোর তাগিদ’ সকল মানুষকে ঘরে অন্তরীণ রাখতে বাধ্য করছে। যেহেতু করোনাভাইরাস চরিত্রগতভাবে ‘সাম্যবাদী’ অর্থাৎ এটা ধনী- দরিদ্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেনা। এ অনিশ্চিত জীবনের বাঁকে এ বিষয়ে কারো কোনো হিসাব থাকে না। তবে এ করোনাকালে অনেকের মনে এ হিসাব জেগেছে। তাই আতঙ্ক, শঙ্কায় দিনযাপন করছে সকলে। প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু ভয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত থাকতেই হচ্ছে জনগণকে, সেই ৭১এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মত এই বুজি পাকসেনা এলো।
প্রায় দশ কোটি শ্রমিক যারা এখন কর্মহীন আছেন। তাই তাদের কাছে উৎসব, আনন্দ নয়, কষ্ট ও বেদনা নিয়ে আসছে ঈদুল ফিতর।করোনা পরিস্থিতি মধ্যে ঈদ তাদের কষ্ঠ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। জানি না কতজনই-বা ঈদেরদিনে প্রিয় জনকে নিয়ে ঈদের সেমাই খেতে পারবে। একথা ভেবে মানুষের দু:খে মনটা খারাপ হয়ে যায়। লকডাউন থাকায় ঈদের দিনে ১৬ কোটি মানুষ ঘরে, প্রতিটি মুখে আজ নিরানন্দের সুস্পষ্ট ছাপ।
আজ শাওয়ালের ঈদের চাঁদ দেখে মনে হচ্ছে এযেন একাত্তরের বাংলার সেই বেদনার্ত নীল বাঁকা চাঁদ আবার ফিরে এসেছে- ঈদের দিন একাত্তরের মতো বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, আবার কেন ২০২০ এ ঈদের বাঁকা নিল চাঁদ ফিরে এলো বাঙালীর জীবনে? ‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও!তুমি কি দেখতে পাওনা বাংলার মানুষের করোনার মৃ্ত্যুর হাহাকার!’ মৃত্যুনিয়ে কত কথা ও গান লিখা হয়েছে। জানি ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’। তারপরও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাষায় বলতে চাই, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই/…মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত/ যদি গো রচিতে পারি অমর-আলয়/ তা যদি না পারি তবে বাঁচি যত কাল/ তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই/ তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল/ নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই।’
৭১-এ দেশমাতাকে মুক্ত করার জন্য পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। আজ স্বাধীনদেশের মানুষ বাঁচানোর যুদ্ধে রয়েছেন চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন, তারাও করোনা মুক্তিযোদ্ধা, এই সংকটের দিনে তোমাদের জানাই ঈদ মোবারক ও শুভেচ্ছা।
আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে মাফ করে পৃথিবীটাকে সুস্থ করে দিন, আল্লাহ আপনি আমাদের উপর এমন গজব দিয়েননা যা আমাদের দেশ ও জনগণ বহন করতে পারবেনা্, ঈদের দিনে সেই প্রার্থনাই করি। এমন অসুস্থ পৃথিবীতে ঈদ পালন করতে হবে কখনো ভাবতেও পারিনি। এখন আমরা ঘরে নিরাপদ, তাই অন্যবারের মতো আনন্দের সাথে ঈদ পালন করতে না পারলেও সকলের সুস্থতা কামনা করে সাধারণ ভাবেই ঘরে ঈদ পালন করবো। সবাই সুস্থ থাকি, নিরাপদ দূরত্ব বজায় থাকি।
বাঞ্ছারামপুরবাসী সহ দেশবাসীকে জানাই ঈদ মোবারক ও শুভেচ্ছা।
সাইদ আহমেদ বাবু
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক উপ-কমিটির সদস্য,ও দলীয় মুখপত্র ‘উত্তরণে’র কর্মাধ্যক্ষ।
নিউজটি শেয়ার করুন..