প্রকাশিত : শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪, খ্রিষ্টাব্দ।। ৬ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ(হেমন্তকাল)।।১৭ জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরী।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক :
একটা গান লিখো আমার জন্য
স্বর্ণযুগের কিন্নরকণ্ঠী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর জীবনের গানগল্পে চিরশ্রী মজুমদারসসাগরা ভারতের গীতি-অধীশ্বরের এমন বিশাল সার্টিফিকেটের পরেও প্রতিমার দিকে প্রচারের সার্চলাইট ঘোরেনি! কিন্তু তাতে তাঁর প্রবাদ হয়ে ওঠা আটকাল কই?
এমন একটি বিপদসঙ্কুল প্রশ্নের উত্তর যে তিনি দেবেন, কেউ আশা করেননি। কিন্তু তিনি যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সঙ্গীতের মতোই তাঁর মনটাও আকাশসম বড়। তাই এক সাংবাদিক যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, গায়িকাদের মধ্যে কার গলাটি তাঁর সবচেয়ে সুরেলা লাগে, তিনি এক ঝটকায় বলে দিলেন, ‘‘প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’ সাংবাদিক এ বার বিস্মিত, ‘লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের চেয়ে আপনি প্রতিমাদিকে এগিয়ে রাখছেন!’ সোনা বাঁধানো স্বরযন্ত্রে হাসি আলতো ঢেউ তুলল। ‘‘প্রতিমার গানের কলি লতা নিজের বিশেষ সংগ্রহে রেখেছে। ওরা বলে, প্রতিমা মানুষই নয়। ও তো পাখি!’’
সুরদুহিতা বা গানের পাখি
গানের টানে তাঁর বাঁধা পড়া যে জন্মেরও বহু আগে! বাংলাদেশের বিক্রমপুর জেলার বাহেরক গ্রামের চট্টোপাধ্যায় পরিবারটি বরাবরই সঙ্গীতে অনুরক্ত। সেই পরিবারের ছেলে মণিভূষণ কলকাতার ‘কক্স অ্যান্ড কিং’-এ চাকরি করতেন, সপরিবার থাকতেন ভবানীপুরে। অসীম প্রতিভাধর মানুষ। বছর দুই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। অন্য দিকে গানের জন্য লোকে তাঁর নাম শুনলে মাথা আপনি নত করে। তিনি উস্তাদ বদল খানের শিষ্য অর্থাৎ পণ্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের গুরুভাই। মণিভূষণ চট্টোপাধ্যায় গজল, ঠুমরি, দাদরায় ছিলেন ওস্তাদ। প্রতিমা যে বছর জন্মালেন, সেই ১৯৩৪-এই তাঁর গানের রেকর্ড বার হয়েছিল। অজয় ভট্টাচার্যের কথায় ও শচীন দেববর্মণের সুরে ‘যৌবনে হায় ফুলদলে পায়’, হিমাংশু দত্তের সুরে ‘স্বপনে কোন মায়াবী’। কিন্তু বিধি বাম! প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠার সেই দিনগুলিতেই হঠাৎ মারা গেলেন মণিভূষণ। তখন তাঁর বয়স সবে সাতাশ। স্ত্রী কমলা আঠেরো। শিশু প্রতিমা তো মাত্র এক!
সেই সময়ে দক্ষিণ কলকাতার মিলনচক্র ক্লাবে প্রতি মাসে ঘরোয়া অনুষ্ঠান হত। সেখানে গান শুনতে আসতেন নক্ষত্রেরা। ঊষারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, শৈলেন মুখোপাধ্যায়রা ছিলেন নিয়মিত মুখ। একদিন দর্শকাসনে বসে ছিলেন গায়ক-সুরকার ও শিল্পীস্রষ্টা সুধীরলাল চক্রবর্তী, যিনি শ্যামল মিত্র, উৎপলা সেন, নীতা সেন প্রমুখ অগণিত শিল্পীকে তালিম দিয়েছিলেন। প্রতিমার গায়কিতে তিনিও চমৎকৃত। সেই যোগাযোগের ফুল ফুটল আরও দু’বছর পার করে। ১৯৫১-য় ‘সুনন্দার বিয়ে’তে প্রথম বার সুরারোপ করলেন সুধীরলাল। তাঁর ডাকেই ‘উছল তটিনী আমি সুদূরের চাঁদ’ গানে নেপথ্যগায়িকা রূপে আত্মপ্রকাশ করলেন প্রতিমা। গান শুনে অন্য সুরকাররাও প্রতিমার খোঁজ করতে শুরু করলেন। তবে প্রতিমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের ‘ঢুলি’ ছবিটি। ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ঢুলি’ ছিল তখনকার দিনের মাল্টিস্টারার, মিউজ়িক্যালি হিট ছায়াছবি। ছবি বিশ্বাস, সুচিত্রা সেন, অনিল চট্টোপাধ্যায়, মালা সিনহার অভিনয়ে ঋদ্ধ এই ছবিটি ‘পথের পাঁচালী’রও আগে বাঙালি গ্রামের নিসর্গ ও জীবনযাত্রাকে নায়কের আসনে বসিয়েছিল। সেই ছবির টিকিট কাটতে যে দীর্ঘ লাইন পড়ত, তারই দর্শক মোহাবিষ্টের মতো সিনেমাশেষে বেরিয়ে আসতেন রাজেন সরকারের সুরে অনবদ্য গানগুলি গাইতে গাইতে। ‘ঢুলি’র রেকর্ড বিকিয়েছিল মুড়ি-মুড়কির মতো। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, যূথিকা রায়ের মতো বাঘা শিল্পীর পাশে চমকে দিলেন প্রতিমা। ডুয়েট ‘চুপি চুপি এল কে’ গানে পাতিয়ালা ঘরানার ওস্তাদ গাইয়ে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিলেন এই নবীনা। আর নিজের জাত চিনিয়ে দিলেন ‘নিঙাড়িয়া নীল শাড়ি শ্রীমতী চলে’ গানটিতে। মালা সিনহার লিপে এই গানে প্রতিমা তাঁর রাগের যে ছোট ছোট ঘূর্ণন তুলেছিলেন, তা শুনে ছিটকে গিয়েছিলেন হেমন্ত। তাঁর অস্ফুট জিজ্ঞাসারই প্রতিধ্বনি উঠেছিল সেই সময়ের তাবড় সঙ্গীতকুলে। এই শ্রীকণ্ঠী কে?
প্রতিমার সঙ্গে হেমন্ত, আলপনা, সন্ধ্যা ও হেমন্ত-জায়া বেলা
তর্কযোগ্য ভাবে, ১৯৫২ থেকে ’৫৪র মধ্যে বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের শুরু। এই সময়েই একের পর এক মনভুলানো গান গেয়ে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রতিমা। ‘ঢুলি’র পরের বছর এল উত্তম-সুচিত্রা জুটির ‘শাপমোচন’। হেমন্তের সুরে ‘ত্রিবেণী তীর্থপথে কে গাহিল গান’-এ মাত করলেন প্রতিমা। আচার্য চিন্ময় লাহিড়ীর কুশলী গায়নের পাশে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল তিনি। সকলে একমত, এ গানের সূক্ষ্ম কারুকাজে তাঁর বিচরণ বড় সহজ। তাতে বিন্দুমাত্র কালোয়াতি আড়ম্বর নেই, নেই নিজেকে জাহির করার প্রচেষ্টা। এমন শক্ত গানকে প্রতিমা নিজ নির্মলতার গুণে মধুরকোমল করে তুলেছেন। এই গানে লিপ দেওয়াও ছিল কঠিন। তাই বারবার প্রতিমার সাহানগরের বাড়িতে চলে আসতেন সুচিত্রা সেন। যেখানে নাকি দিবারাত্র রেওয়াজে ডুবে থাকেন গায়িকা। সেতারের ঝঙ্কারের সঙ্গে মিলিয়ে গানের ওঠানামা, কণ্ঠভঙ্গিমা আয়ত্ত করতে মহানায়িকার বেশি সময় অবশ্য লাগল না। তিনি নাকি কেবলই প্রতিমার কাছে আবদার করতেন ‘যদুভট্ট’ ছবির ‘বাবুল মোরা নৈহার ছুটো হি যায়’ গানটি শোনাতে। নবাব ওয়াজ়িদ আলি শাহের হৃদয়ের রক্তে লেখা এই গানটিতে যুগে যুগে সেরা শিল্পীরা কণ্ঠদান করেছেন। বেগম আখতার, কুন্দনলাল সায়গল, গিরিজা দেবী, ভীমসেন জোশি, জগজিৎ সিংহ সকলেরই সেরা অ্যালবামে এই ভৈরবী-ঠুমরি থাকবেই। এমন গানটি গাইবার বরাত পেয়েই প্রতিমা তাতে ঢেলে দিয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত ইনোসেন্স। এই রাগসঙ্গীতটিই তাঁকে প্রথম বার বিএফজেএ সম্মান এনে দেয়। কয়েক বছর পরে তিনি ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ কিংবদন্তি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতসাধক উস্তাদ আমীর খানের সঙ্গে গাইবার সুযোগ পেলেন। ‘ক্যায়সে কাটে রজনী ইয়ে সজনী’তে ক’টিমাত্র পঙ্ক্তি তাঁর। তাতেই ইতিহাস।
প্রতিমা শুধু রাগনির্ভর সঙ্গীতে শ্রেষ্ঠ ছিলেন না। ভক্তিরসাত্মক গান, অতুলপ্রসাদী, নজরুলগীতি, লোকায়ত গান, আধুনিক রম্যগীতি সবেতেই মুক্তো ছড়িয়েছেন। পঞ্চাশের দশক থেকেই তিনি এইচএমভি-র আর্টিস্ট। দীর্ঘ বাস্তবগীতি ‘হায়, আমার যে ঘর ছিল, ঘরে ভাত কাপড় ছিল’ বা অপত্যরসে জারিত গান ‘আমার সোনা চাঁদের কণা’… যে গানই তিনি গাইতেন, মুখে মুখে ফিরত। ‘চৌরঙ্গী’র রবীন্দ্রসঙ্গীতটি এত জনপ্রিয় হল যে, ভক্তের মন রাখতে সেই বছরই তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আলাদা রেকর্ড বার করতে হল। নিজে জানিয়েছিলেন, ‘ছুটি’ ছবিতে অরুন্ধতী দেবীর সঙ্গীত পরিচালনায় গাইতে পেরে ভারী তৃপ্তি পেয়েছিলেন। ছবিতে ভ্রমর নামে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত একটি মেয়ের গলায় প্রতিমার দু’টি গান রেখেছিলেন অরুন্ধতী দেবী। রিহার্সালে অরুন্ধতী-প্রতিমা মিলে ঠিক করলেন যথাসম্ভব সফ্ট করে গাইতে হবে। এই সূক্ষ্ম অবজ়ার্ভেশনের ফসল ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা’ এবং ‘আমার জীবননদীর ওপারে’। গান দুটো যেন সময়কে থামিয়ে দেয়। এই কথাটা এক বার প্রতিমাকে বলেছিলেন কেউ। উনি বলেছিলেন, ‘‘আঙুরবালা দেবীর গান। গাইতে খুব ভয় লেগেছিল। তার পরে একটু নিজের মতো করে নিলাম। ‘চৌরঙ্গী’র পর তাতেই তৃতীয় বার বিএফজেএ এসেছিল।’’ হেসেছিলেন শিল্পী। তার পরে বললেন, ‘‘তবে সবচেেয় বেশি ফ্যান-লেটার কোন গানে পেয়েছিলাম, জানো তো?’’
বিষের বাঁশি
সব গোত্রের গানে প্রতিমা সফল তাঁর অপাপবিদ্ধ কণ্ঠের ঐশ্বর্যে। হেমন্তের স্নেহধন্যা তো তিনি ছিলেনই, কাজ করেছেন সে দিনের সমস্ত বরেণ্য সঙ্গীতকারের সঙ্গে। আলি আকবর খান, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, শ্যামল মিত্র, ভূপেন হাজারিকা, সুধীন চট্টোপাধ্যায়, মানস চক্রবর্তী— কে নেই সে গুণিজন সমাবেশে! শিল্পীর অন্য রকম গলা মনে রেখে এঁরা দিগ্বিজয়ী গান তৈরি করেছিলেন শুধু তাঁর জন্য। কিন্তু কালে কালে তাবড় শিল্পীদেরও খুঁত বার হয়েছে। অনেকেই সমালোচনা করেন, শ্যামল মিত্রের উচ্চারণে ত্রুটি ছিল। হেমন্ত নাকি হায়ার অক্টেভে একটু ন্যাজ়াল হয়ে যেতেন বলেও ভুরু কোঁচকান অনেকে। তেমনই প্রতিমার বিরুদ্ধেও অভিযোগ যে, তাঁর কণ্ঠবীণা, স্বরক্ষেপণ নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু নায়িকা নয়, পার্শ্বচরিত্রে প্লেব্যাকের জন্যই তাঁকে ভাবা হত। কারণ তাঁর আবেগ নিয়ে নাকি সংশয় আছে। প্রতিমা যে সব সময়ে এক্সপ্রেশন দিতে পারতেন না, তা নিয়েও এক গল্প চালু। দেবকীকুমার বসু পরিচালিত ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ ছবিতে বিষ্ণুপ্রিয়ার গলায় দরদের গান ছিল। দৃশ্যটি হল নিমাই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রেকর্ডিং রুমে সেটা প্রতিমার গলায় পছন্দ হচ্ছিল না দেবকীবাবুর। সকলের সামনে ঠাস করে এক চড় মেরে দিলেন। প্রতিমা পূর্ববঙ্গীয় টানে বললেন, ‘আমারে আপনে মারলেন!’ ইন্ডাস্ট্রির কানাঘুষোয় হাসিঠাট্টায় এই গল্প তো এখানেই শেষ। কিন্তু সত্য জানতে বাকি অংশটা পাওয়া যায় প্রতিমার স্মৃতিচারণায়— ‘সকলের সামনে চড় খেয়ে খুব মানে লেগেছিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। বললাম, করুন টেক। তার পর দেখি দেবকীবাবু ছুটতে ছুটতে আসছেন। ভাবলাম, এবারও মার খেতে হবে। কিন্তু তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি তোকে মারলাম— কারণ আমি তোর বাবার মতো। আমি ওটাই চাইছিলাম। ভীষণ ভাল হয়েছে।’ প্রতিমার কথায়, এটিই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
তাঁকে নিয়ে এ হেন অস্বচ্ছ ধারণার অন্যতম কারণ, ব্যক্তি প্রতিমার সম্পর্কে জানাশোনা বড় কম। যাঁরা তাঁকে জেনেছেন, তাঁরাই বলেছেন, এমন এক নিপাট মানুষের জীবনপাত্রটা ছিল গরলে ভরা। ছেলেবেলার স্মৃতি রোমন্থনে প্রতিমা কেবলই বলতেন, ‘‘বড় অভাব ছিল আমাদের।’’ আর দুঃখ করেছেন, ‘‘কোনও দিন বাবা ডাকের স্বাদ পাইনি!’’ শৈশবের সেই বেদনা জীবনের শেষেও পিছু ছাড়েনি। বাংলার স্বর্ণযুগের মধুকণ্ঠী তিনি, অথচ তাঁরই দাম্পত্যের তারটি ছিঁড়ে গিয়েছিল বড় অকালে। সেই ভাঙা সম্পর্কের ধারালো টুকরোগুলো ভিতরে বয়ে বেড়িয়েছেন। ওই যে সকলে বলত, কাঠের মতো গায়— আসলে হয়তো কষ্ট পেতে পেতে পাথরই হয়ে গিয়েছিলেন এক সময়ে। অন্তরাত্মায় হাসি-কান্না বইত ঠিকই, কিন্তু কে জানে কোন অভিমানে তিনি তাদের প্রকাশ করাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। জমাটবাঁধা বেদনা দিয়েই সঙ্গীতের নৈবেদ্য সাজাতেন। চড়ায় সুর চড়ত, নামত খাদেও। মুখবিবরে কোনও রেশ পড়ত না। আর তাকেই লোকে ম্যাজিক বলত। জীবন সায়াহ্নে, বিশেষত আশির দশকে স্বামীর মৃত্যুর পরে, তাঁর গানের কথা নিয়ে নাকি খুব চিন্তায় থাকতেন পরিজনরা। বারবার দেখে নিতেন, যে গান গাইবেন, তাতে মৃত্যু, ঘুম এই জাতীয় বিধুর শব্দ আছে কি না! এমন শব্দ থাকলে তিনি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তেন। কতখানি ব্যথার সাগর বুকে মোচড় দিলে মানুষ এতখানি সংবেদনশীল হয়। এর পরেও তাঁকে আবেগবিহীনা বললে যে অবিচার করা হয়!
হেমন্ত তাঁকে বম্বেতে নিয়ে গিয়ে ‘সাহারা’ ছবিতে গান গাইয়েছিলেন। মীনাকুমারীর লিপে সে গান প্রশংসিত। কিন্তু সংসার ছেড়ে বম্বেতে থাকতে চাইলেন না প্রতিমা। আমন্ত্রণেও বিদেশে গিয়ে গাইলেন না। ‘‘বললেন, প্লেনে উঠতে বড় ভয়। আর ওখানে পান পাওয়া যায় না। রয়্যালটি বাবদ কত টাকা পাবেন, মনে রাখতেন না। ওই জন্যই শেষ জীবনে আবার অভাবের গ্রাসে,’’ সজল চোখে বলছিলেন প্রতিমার সহযন্ত্রী, গিটারিস্ট ও সুরকার বুদ্ধদেব গঙ্গোপাধ্যায়।
খুব খাওয়াতে ভালবাসতেন, উত্তর কলকাতার দিকে গেলে অ্যালেন কিচেনের সামনে দু’বার গাড়ি দাঁড় করাতেন। যাওয়ার সময়ে আর আসার সময়ে। এখনও ও দিকে গেলে ওঁর জন্য মনটা টনটনিয়ে ওঠে। আশির দশক থেকেই ভীষণ মুডি হয়ে গিয়েছিলেন। লাইভ ফাংশনে এক গানের মুখরা গেয়ে অন্য গানের অন্তরা গেয়ে ফেলতেন। লোকে কিছু মনে করত না, তা-ই শুনত। ওই কণ্ঠে দু’টি কলি শুনতে পাওয়াও যে কত ভাগ্যের! এক বার হল কী, সাত তলায় অনুষ্ঠান, এ দিকে উনি লিফ্টে চড়তে ভয় পান। বললেন, সিঁড়ি দিয়ে উঠবেন। তিন তলা পর্যন্ত উঠে তো আর পারেন না, ওখান থেকেই ব্যাক করলেন। অনুষ্ঠান পড়ে রইল। এমনটা কিন্তু বহু বার করেছেন, ’’ হেসেও আবার নিভে যায় হৈমন্তীদেবীর গলা। ‘‘বড্ড একলা হয়ে পড়েছিলেন মানুষটা। সে বার শৈলেন মুখোপাধ্যায় মারা যাওয়ার খবর ওঁকে জানাতে গেছি, বললেন, কে বলেছে তিনি মারা গিয়েছেন?’’ মানসিক ভাবেও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তখন উনি।
বুদ্ধদেব গঙ্গোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘একটু সুস্থ হলেই বলতেন, ‘অরে, গান দে! গান ছাড়া আমার কে আছে!’ তা ওঁর নাম করলেই অনুষ্ঠান, রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থাও হয়ে যেত। কিন্তু কত বার যে হলের দরজায় এসে ‘আজ আর গাওনে কাম নাই’ বলে বাড়ি চলে গেছেন, ইয়ত্তা নেই। বললাম, বড়মা তোমাকে গাইতে হবে না। শুধু গিয়ে বলো আমি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা হলেও হবে। যাননি!’’
বাড়িতে রেওয়াজ
আশি-নব্বইয়ের দশকে কয়েকটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বা বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠানে তাঁকে কালেভদ্রে দেখা যেত। নির্মলা মিশ্র প্রৌঢ় শিল্পীকে হাত ধরে এনে মঞ্চে বসাতেন। হয়তো আঙুল বসাতে পারছেন না হারমোনিয়ামের রিডে, কিন্তু গলাটি তখনও খাস ভীষ্মদেবের ছাত্রীর। সে রকমই মিহি, এতটুকু বেসুরো, বেতালা নন। তাঁর হারমোনিয়াম তখনও অন্যদের থেকে এক পর্দা উঁচুতে।
তাঁর অন্তরালে যাওয়া, ক্রমে ক্ষয়ে যাওয়া নিয়ে এমন কত দীর্ঘশ্বাস। কেউ দোষারোপ করে তাঁর আত্মীয়দের, কেউ অদৃষ্টের। কেউ বলে, সরলসিধে মানুষটি জীবনের জটিল ফাঁস থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারেননি। কে জানে, কোনটা সত্যি আর কোনটা নিয়তি! গোনাগুনতি যে ক’বার নিজের সম্পর্কে বলেছেন প্রতিমা, তাতে একটি স্বগতোক্তিই ঠোকর মারে বারে বারে। ওটুকুই বুঝি তাঁর না লেখা আত্মকথন, ঐশ্বরিক ওই গীতিশক্তির উৎসবিন্দু!
ঋণ: গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু: গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়,
কথায় ও সুরে: কলকাতা দূরদর্শন, স্বপন সোম
তথ্য সূত্র – আনন্দ বাজার
‘‘আমাদের বিক্রমপুর–আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন–বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com
আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।
জাস্ট এখানে ক্লিক করুন। https://www.facebook.com/BikrampurKhobor
email – bikrampurkhobor@gmail.com