উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার মৃত্যুদিবস আজ

0
15
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার মৃত্যুদিবস আজ

প্রকাশিত:বৃহস্পতিবার,৫ নভেম্বর ২০২০ইং ।। ২০শে কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)।। ১৮ই রবিউল আউয়াল,১৪৪২ হিজরী।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : বাংলা সঙ্গীতে জীবনমুখী গানের অন্যতম পথপ্রদর্শক ভূপেন হাজারিকার মৃত্যুদিবস আজ। ২০১১ সালের এই দিনে মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানী হাসপাতাল ও চিকিৎসা গবেষণা ইনস্টিটিউটে মৃত্যুবরণ করেন ভারতীয় এ কণ্ঠশিল্পী। তার গানে উঠে এসেছে মানবতা, অসাম্প্রদায়িকতা, শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ।

অত্যন্ত দরাজ গলার অধিকারী এই কণ্ঠশিল্পীর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। অসমিয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে গানের জগতে প্রবেশ করেন তিনি। পরবর্তীকালে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় গান গেয়ে ভারত এবং বাংলাদেশে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার পিতার নাম নীলকান্ত হাজারিকা, মায়ের নাম শান্তিপ্রিয়া হাজারিকা। পিতা-মাতার দশ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।

তিনি মাত্র ১০ বছর বয়স থেকেই গান লিখে সুর দিতে থাকেন। আসামের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে তার সম্পর্কের সূচনা হয় এক শিশুশিল্পী হিসেবে। ১৯৩৯ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি অসমীয়া ভাষায় নির্মিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা পরিচালিত ইন্দুমালতী সিনেমাতে ‘বিশ্ববিজয় নওজোয়ান’ শিরোনামের একটি গান গেয়েছিলেন। পরে তিনি অসমীয়া চলচ্চিত্রের একজন নামজাদা পরিচালক হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশ, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে তার জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক ও বিশাল।

ভূপেন হাজারিকা ছিলেন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। তিনি ছিলেন পিএইচডি ডিগ্রিধারী। নিজেকে তিনি ‘যাযাবর` ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাভাষীদের কাছে তার জনপ্রিয়তা প্রবাদতুল্য। অসংখ্য জনপ্রিয় গানের কারিগর এই শিল্পীর দরাজ কণ্ঠে গাওয়া গানগুলো সব প্রজন্মের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।

গান যে শুধু শোনারই জিনিস নয়, উপলব্ধির ও বোঝার উপকরন-এটা বুঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন ভূপেন হাজারিকা। তার কিছু সৃষ্টি অবিস্মরণীয়। গভীর মন্দ্রস্বর ও কেতাদুরস্ত শব্দচয়ন এর জন্য তিনি পৃথিবী বিখ্যাত। ভূপেন হাজারিকা তার ব্যারিটোন কণ্ঠস্বর ও কোমল ভঙ্গির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার রচিত গানগুলি ছিল কাব্যময়। গানের উপমাগুলো তিনি প্রণয়-সংক্রান্ত, সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয় থেকে তুলে আনতেন। তিনি আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে লোকসঙ্গীত গাইতেন।

বাংলাদেশ, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়। অসমীয়া ভাষা ছাড়াও বাংলা ও হিন্দি ভাষাতেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন এবং অনেক গান গেয়েছেন। ভূপেন হাজারিকার গানে মানবপ্রেম, প্রকৃতি, শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী সুর উচ্চারিত।

তার গানগুলোর মধ্য, ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি’, ‘আমি এক যাযাবর’, ‘আমায় ভুল বুঝিস না’, ‘একটি রঙ্গীন চাদর’, ‘ও মালিক সারা জীবন’, ‘গঙ্গা আমার মা’, ‘প্রতিধ্বনি শুনি’, ‘বিস্তীর্ণ দুপারে’, ‘মানুষ মানুষের জন্যে’, ‘সাগর সঙ্গমে’, ‘হে দোলা হে দোলা’, ‘চোখ ছলছল করে’ ইত্যাদি খুব জনপ্রিয়।

শেষ জীবনে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপিতে যোগদান করেন ভূপেন হাজারিকা। রাজনীতির মাঠে অবশ্য খানিকটা বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েন তিনি।

পুরস্কার

ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’ পদকে সম্মানিত হয়েছেন ভূপেন হাজারিকা। ২৩ তম জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে (১৯৭৫) শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক চলচ্চিত্র ‘চামেলী মেমসাহেব’ ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি। পদ্মশ্রী লাভ করেন ১৯৭৭ সালে।

শ্রেষ্ঠ লোকসংগীত শিল্পী হিসেবে অল ইন্ডিয়া ক্রিটিক অ্যাসোসিয়েশনের পুরস্কার পান ১৯৭৯ সালে, আসাম সরকারের শঙ্করদেব পুরস্কার (১৯৮৭), দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (১৯৯২), জাপানে এশিয়া প্যাসিফিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে রুদালী ছবির শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচাকের পুরস্কার অর্জন। তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই পুরস্কার পান ১৯৯৩ সালে।

এছাড়া পেয়েছেন পদ্মভূষণ (২০০১), আসামরত্ন (২০০৯), সংগীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার (২০০৯) ও ভারতরত্ন (২০১৯)।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর তার গাওয়া ‘জয় জয় নবজাত বাংলাদেশ,/জয় জয় মুক্তিবাহিনী/ভারতীয় সৈন্যের সাথে রচিলে/মৈত্রীর কাহিনি।’ গানটি সবার হৃদয় জয় করে। বাংলাদেশ সম্বন্ধে ভূপেন হাজারিকা বলেছিলেন, তিনি ঢাকায় দেখেছেন বঙ্গ সংস্কৃতির স্ফূরণ। তিনি বাংলাদেশেই বঙ্গ সংস্কৃতির গভীরতা দেখেছেন।

অসম প্রেম

প্রিয়ংবদার সঙ্গে তার বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি। কিন্তু তারা আর একসঙ্গে থাকেননি। ভূপেন আরেকটি বিয়ে করতে ভয় পেতেন। তবে কল্পনা লাজমির সঙ্গে তার ছিল অসমবয়সী প্রেম। কল্পনার মামা গুরু দত্ত ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার। কিশোর বয়স থেকেই কল্পনা লাজমি ভক্ত ছিলেন ভূপেন হাজারিকার। ব্যক্তিজীবনে অগোছালো, বেহিসাবি ভূপেনকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনেন কল্পনা। তিনি তার ম্যানেজারও হন। ১৯৭৬ সালের দিকে কল্পনা সরাসরি ভূপেনের ফ্ল্যাটে চলে যান এবং একত্রে বাস করতে থাকেন। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে ভূপেন কল্পনাকে তার সঙ্গী বলে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন। অনেক ছবির মধ্যে কল্পনা লাজমি রুদালি নামের ছবিটিও পরিচালনা করেছিলেন। তার সংগীতের দায়িত্বে ছিলেন ভূপেন। একমাত্র সন্তান তেজ হাজারিকা নিউইয়র্কে বসবাস করছেন।

প্রিয়ংবদার সঙ্গে যে কারণে বিচ্ছেদ

১৩ বছর সংসার করার পর ১৯৬৩ সালে প্রিয়ংবদা প্যাটেল ও ভূপেন আলাদা হয়ে যান। কেন তারা আলাদা হয়ে গেলেন, সে কথা ভূপেনের মৃত্যুর এক বছর পর কানাডা প্রবাসী প্রিয়ংবদা বলেন আসামের একটি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেন, লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ভূপেনের প্রণয়ের কারণেই নাকি তারা আর একসঙ্গে বসবাস করেননি। লতা মঙ্গেশকর কিন্তু তাতে খুব বিরক্ত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন ভূপেনের ৩৯ বছরের সঙ্গিনী কল্পনা লাজমি।

ভূপেন হাজারিকাকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানী হাসপাতাল ও চিকিৎসা গবেষণা ইন্সটিটিউটের আইসিইউতে ৩০ জুন, ২০১১ সালে ভর্তি করা হয়। অতঃপর তিনি কিডনী বৈকল্যসহ বার্ধক্যজনিত সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ৫ নভেম্বর, ২০১১ সালে ধরাধাম ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে এই গুণী শিল্পীর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।

অসমে জন্ম হলেও তিনি ছিলেন বাঙালির ঘরের ছেলে। তিনি ভূপেন হাজারিকা। সারা জীবন ধরে আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন একের পর এক অসাধারণ বাংলা গান। তাই তিনি চিরকাল রয়ে গেছেন বাঙালির মনের মণিকোঠায়।

নিউজটি শেয়ার করুন .. ..

‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন