ইংল্যান্ডের মুদ্রায় আসছে বিক্রমপুরের বিজ্ঞানীর ছবি

0
30
ইংল্যান্ডের মুদ্রায় আসছে বিক্রমপুরের বিজ্ঞানীর ছবি

প্রকাশিত:  রবিবার, ১মার্চ ২০২০।। ১৭ই ফাল্গুন,১৪২৬ বঙ্গাব্দ।

বিক্রমপুর খবর:  অনলাইন ডেস্ক:  জগদীশ চন্দ্র বসু। আপাদমস্তক নিরহংকারী বাঙালী বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুই আবিষ্কার করেছিলেন বেতার তরঙ্গ।জগদীশ চন্দ্র বসুই বিশ্ববাসীকে প্রথমবারের মত জানিয়েছিলেন উদ্ভিদের মধ্যে প্রাণশক্তি আছে।এটি প্রমাণের জন্যে তিনি ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ নামক একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন,যা উদ্ভিদদেহের সামান্য সাড়াকে লাখোগুণ বৃদ্ধি করে প্রদর্শণ করে।

কিন্তু পেটেন্টের প্রতি অনুরাগী ছিলেন না জগদীশ। তাইতো টেলিগ্রাফের আবিষ্কারক হিসেবে লিপিবদ্ধ গুলিয়েলমো মার্কোনির নাম। তবে সম্মানটা ঠিকই পাচ্ছেন বাংলাদেশি এই বিজ্ঞানী। এবারে সেই জগদীশ্চন্দ্র বসুর ছবিযুক্ত মুদ্রা প্রচলিত হতে পারে ইংল্যান্ডে।

ইংল্যান্ডের বাজারে ২০২০ সালে আসছে নতুন ৫০ পাউন্ডের নোট। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সেই নোটে বাংলাদেশি এই বিজ্ঞানীর মুখ ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।

এর আগে নোটে ছাপানোর জন্য একশ’ জন বিজ্ঞানীর নাম উঠে আসে। এই নামগুলোর মধ্যে প্রাথমিকভাবে জগদীশ চন্দ্র বসু এগিয়ে আছেন।

নিজেদের ওয়েবসাইটে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড জানিয়েছে, ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত তাদের কাছে ১ লাখ ৭৫ হাজার মনোনয়ন জমা পড়েছে। এরমধ্য থেকে বেছে নেয়া হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার নাম। যার মধ্যেই রয়েছেন জগদীশ চন্দ্র বসু। আধুনিক বিজ্ঞানের পথিকৃত তিনি। তার ছাড়া যে যোগাযোগ রক্ষা করা যায় তা প্রথম আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুই দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আবিস্কার করেছিলেন আধুনিক বেতার তরঙ্গ। যা ছাড়া ওয়্যারলেস কমিউনেকশন সম্ভব ছিল না।

জগদীশ চন্দ্র তার নিজের করা গবেষণা বা আবিষ্কারের জন্য জীবদ্দশায় কোনো পেটেন্ট গ্রহণ করেননি, কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞানী সমাজ রেডিও তরঙ্গের ক্ষেত্রে তার অবদান স্বীকার করেন অম্লানবদনে। তাকে আখ্যা দেয়া হয় বেতার যোগাযোগের জনক হিসেবে। মিলিমিটার তরঙ্গ আবিষ্কার করে তিনি বেতার যোগাযোগের ক্ষেত্রে একজন অগ্রপথিক হিসেবে আজ গণ্য হন।

তার আবিষ্কৃত অনেক যন্ত্র আজও ব্যবহার হয়ে আসছে যাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার এন্টেনা, পোলারাইজার এবং ওয়েভগাইড উল্লেখযোগ্য। যদিও এখন এদের আধুনিকায়ন করা হয়েছে।

জগদীশ চন্দ্র বসু শ্রীনগরের রাঢ়ী খাল গ্রামে ১৮৫৮ সালে ৩০ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম ভগবান চন্দ্র বসু (জেলার তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট) এবং মায়ের নাম বামা সুন্দরী দেবী।

তাঁর শিক্ষাজীবনের ধাপগুলো শুরু হয় ফরিদপুরে,তারপর ১৮৬৯ সালে হেয়ার স্কুল,সেখান থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল। তিনি ১৮৭৫ ষোল বছর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উর্ত্তীণ হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হোন। সেখান থেকে ১৮৭৭সালে অনার্স এবং ১৮৭৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি .এস.সি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৮৮০ সালে ভারত ছেড়ে লন্ডনে ডাক্তারি পড়ার জন্য মেডিকেল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হলেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তা বাদ দিয়ে ১৮৮১ সালে লন্ডন ত্যাগ করে কেম্ব্রিজে যান। ১৮৮৪ সালে কেম্ব্রিজ ক্রাইস্ট কলেজ থেকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিষয়ে ট্রাইপোস (কেম্ব্রিজের বিশেষ কোর্স) এবং একই সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেন।

১৮৮৫ সালে জগদীশ বসু প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা জীবন শুরু করলেন। তিনি তাঁর মৌলিক গবেষণা কলেজের ল্যাবরেটরিতে শুরু করলেন। প্রথম জীবনে তিনি ইথার তরঙ্গ ও বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। তাঁর গবেষণার প্রথম সাফল্য ছিল বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের সাহায্যে সংকেত বা সংবাদ প্রেরণের সম্ভাবনা আবিষ্কার,যা এখন থেকে দেড়শত বছর আগের কথা !

আমরা যে এফএম বা রেডিওতে গানের মূর্ছনায় হারিয়ে যাই তার আবিষ্কারক হিসেবে কিছুদিন আগেও পুরো বিশ্ববাসী ইটালির বিজ্ঞানী মার্কোনিকেই জানত। কিন্তু ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত IEEE (Institute of Electrical and Electronics Engineers)এর প্রসিডিঙ্গে আমাদের জগদীশ বসুকে রেডিওর প্রকৃত আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কারণ,মার্কোনি তার আবিষ্কারে অনেক সূক্ষ্র যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছিলেন যার মধ্যে একটি হচ্ছে কোহেরার(২টি ধাতব পাতের মাঝে খানিকটা পারদ),যা ছিল রেডিও বা তারহীন সংকেত পাঠানোর প্রক্রিয়ার মূল বিষয়। মজার ব্যপার হচ্ছে এই কোহেরার এর প্রকৃত আবিষ্কারক স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, যা মার্কোনি বা তার সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা কেউ স্বীকার করেনি। মার্কোনি বসুর তৈরি কোহেরারটি সামান্য পরিবর্তন করেছিলেন। বসুর কোহেরারটি ছিল U আকৃতির মত আর মার্কোনিরটি ছিল সোজা।

১৮৯৬ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু অদৃশ্য আলোক সম্পর্কে লিভারপুলের ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের বক্তৃতা দেন। ঐ সময় যদি তিনি নিজের নামে বেতার যন্ত্র পেটেন্ট করতেন,তাহলে মার্কোনি না,তিনিই হতেন বেতার যন্ত্রের সর্বপ্রথম আবিষ্কারক। এরপর লন্ডনে রয়েল ইনস্টিটিউটে তাঁকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে আহবান করা হয়। তিনি তাঁর কোহেরারটি নিয়ে একটি নিবন্ধ রয়েল সোসাইটিতে পড়েছিলেন। তাঁর এই কোহেরারটি দিয়ে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এক মাইল দূরের বাসভবনে সাংকেতিক চিহ্ন প্রেরণ করেছিলেন। ১৮৯৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় মৌলিক গবেষণার জন্য তাঁকে ডি .এস.সি উপাধি প্রদান করে।

এখন প্রশ্ন হল জগদীশ চন্দ্র বসু  নিজের নামে পেটেন্ট করেননি কেন ? ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথকে লিখা একটি চিঠিতে বলেন যে, ‘আমি যদি একবার টাকার মোহে পড়ে যাই তাহলে আর কোনদিন আর বের হতে পারব না।’ টাকার প্রতি তাঁর লোভ ছিল না বলেই তিনি পেটেন্ট নিজের নামে করেননি।

১৯৩৭ সালের ২৩ শে নভেম্বর জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর কর্মময় জীবন থেকে চিরবিদায় নিলেন। আমরা তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরাধিকার সূত্রে পেলাম ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির।’ তিনি একজন সাহিত্যিকও ছিলেন। তাঁর লেখা ‘অব্যক্ত’ বাংলা ভাষায় একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়াও আমরা যে সায়েন্স ফিকশানগুলো পড়ে বিজ্ঞানকে নিয়ে প্রতিনিয়ত নতুনভাবে চিন্তা করি,তার জনক হলেন জগদীশ চন্দ্র বসু। ১৮৯৬ সালে তাঁর লেখা প্রথম সায়েন্স ফিকশানটির নাম ছিল ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’।

স্যার নেভিল মট ১৯৭৭ সালে বসু সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেন,”জগদীশ চন্দ্র বসু  তার সময় অপেক্ষা ৬০ বছর এগিয়ে ছিলেন”।বিজ্ঞানে তাঁর অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আজ তিনিও রেডিও আবিষ্কারের অন্যতম জনক।

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন