প্রকাশিত : বুধবার, ২২ এপ্রিল ২০২০ ইং ।। ৯ বৈশাখ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। ২৭ শাবান ১৪৪১
বিক্রমপুর খবর : শ্রীনগর প্রতিনিধি : গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বিক্রমপুরের বিখ্যাত আড়িয়াল বিলে আনুষ্ঠানিক ধান কাটা শুরু হয়। অনিশ্চয়তা আর শঙ্কা কেটে অবশেষে আড়িয়লবিলের শ্রীনগর অংশে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে ধান কাটা শুরু হয়েছে। চলতি মৌসুমে ধান কাটার পর ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ২১ হাজার টন ধান উৎপাদন হয়েছে এই বিলে।
মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো.মনিরুজ্জামান তালুকদার আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিলের ধান কাটার উদ্বোধন করেন। স্থানীয় কৃষাণ কৃষাণীর সাথে যুক্ত হয় ধান কাটার অত্যাধুনিক কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার যন্ত্র। যোগ হয় ফরিদপুর, শীরয়দপুরে শ্রমিক। সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু। জমির ধান খাটায় ব্যস্ত কৃষকদের চোখে মুখে সস্থির চিহ্ন দেখা গেছে। এর আগে বিল পাড়ের কৃষকরা করোনা মোকাবেলায় শ্রমিকের অভাবে জমির পাকা ধান কাটা নিয়ে দুশ্চিান্তায় পরেছিলেন। পরে সমস্যা সমাধানে সরকারি অর্থায়নে অত্যাধুনিক কম্বাইন্ড ও রিপার মেশিন আনা হয়। অন্যদিকে এক হাজার শ্রমিক আনার ব্যবস্থা করা হয়।প্রথম দিনেই ৫৫১ জন শ্রমিক একটি ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টার’ ও একটি ‘রিপার মেশিন’ ব্যবহার করা হয়। মুখের হাসি ফিরে এসেছে ধান কাটা নিয়ে অনিশ্চয়তা আর শঙ্কা কেটেছে অনেকটা মনে হচ্ছে। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে ধান কাটা শুরু হয়ে তা ১৫ দিনের মধ্যে শেষ করতে হয়। তা না হলে বৃষ্টি শুরু পর বিলের অধিকাংশ জমির ধান পানিতে তলিয়ে যায়।
মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদারবলেন, সরকার ইতিমধ্যেই কৃষকদের ধান ঘরে তুলতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। কৃষকদের এখানের কোনও রকমেরই কষ্ট বা দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। আমরা আশা করছি কৃষকরা সুন্দরভাবে তাদের ফসল ঘরে তুলতে পারবে। বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কাটার জন্য শ্রমিক আসে। এবছরও ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ি থেকে শ্রমিক আসছেন। এছাড়াও উত্তর বঙ্গেও যে সমস্ত শ্রমিকরা আছেন তাদেরকেও আনার বিষয়েও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের সাথে যোগাযোগ করছি তারাও শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা করবেন। ডিসি মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার আরো বলেন, করোনা মোকাবেলায় বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করছি। কারণ দূর থেকে যারা আসবেন আমাদের নির্দেশনা রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিয়ে আসবেন। যাদের করোনা উপসর্গ নেই তাদেরকেই এখানে পাঠাবেন। আর এখানে যারা আসবেন সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়াও শ্রমিকদের পৃথক পৃথক থাকার ব্যবস্থা করেছি। এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ধান কাটার জন্য বলা হয়েছে। তিনি বলেন, কৃষকদের বাড়তি সুবিধার জন্য কৃষকদের একটি উন্নত প্রযুক্তিসম্পর্ন কম্বাইন্ড হারভেস্টার দেওয়া হয়েছে। এতে করে কৃষকরা শান্তিতে ও সুন্দরভাবে ধান ঘরে তুলতে পারবেন।
উপস্থিত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডিএ) শাহ আলম বলেন, আশা করছি আড়িয়লবিলে প্রতি হেক্টর জমিতে সাড়ে ৬ টন ধান ফলন হবে। প্রায় ২০ ভাগ জমির ধান পেকে গেছে। আপনার জানেন যে গত সোমবার একটি নতুন কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও একটি রিপার অলরেডি জমিতে ধান কাটছে। এর পাশাপাশি এখনও পর্যন্ত ৫০০ ধান কাটার শ্রমিক এখানে এসেছেন। বাকি শ্রমিকরাও আসবেন। বিলের ধান কাটতে এখানকার কৃষকদের স্থানীয় কৃষি অফিস সার্বিক সহযোগিতা করছেন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন শ্রীনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মসিউর রহমান মামুন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোসাম্মৎ রহিমা বেগম, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াহিদুর রহমান জিঠু, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রেহেনা বেগম, শ্রীনগর থানার অফিসার ইনচার্জ মো.হেদায়াতুল ইসলাম ভূঞা, শ্যামসিদ্ধি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ কাইউম রতন, উপজেলা কৃষি অফিসার (অতিরিক্ত) মো. জাহাঙ্গীর আলম, কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার রুনা লায়লা, স্থানীয় ইউপি সদস্য মামুন বেপারী, শাহাবুদ্দিন বেপারীসহ উপজেলা কৃষি অফিসের বিভিন্ন ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাবৃন্দ।
ধান কাটার শুরুতেই লক্ষ্য করা গেছে,অনেক জমিতে ধান কাটছেন কৃষাণ কৃষাণী। বিলের মাঝখানে প্রায় দেড় দুই কিলোমিটার ভিতরে নিচু জমির ধান কেটে কৃষাণরা নৌকা বা বড় ট্রলারে করে লোকালয়ে আনছেন। এছাড়ার বিল পাড়ে কিংবা রাস্তার পাশে কৃষাণ কৃষাণি ধান মারাইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। এছাড়াও অন্য জেলা থেকে আগত শ্রমিক তাদের থাকার জন্য আবাসন তৈরী করছেন বিলের উচু জমি গুলোতে। সব মিলিয়ে এখানকার সবাই এখন ধান নিয়ে খুবই ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। লক্ষ্য করা গেছে করোনা রোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পরিকল্পিতভাবে টিন ও বাঁশ দিয়ে অস্থায়ীভাবে আবাসন তৈরী করছেন তারা।
জেলা প্রশাসক মোঃ মনিরুজ্জামান তালুকদার আরো জানান, ৭ দিন থেকে ১০ দিনের মধ্যে পাকা সব ধান কেটে ফেলা যাবে। কারণ, আমাদের শ্রমিক আছে। কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার মেশিন আছে। জনপ্রতিনিধিসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সব ধান কেটে ঘরে তুলতে পারলে খুব ভালো একটি কাজ হবে।
তিনি আরও জানান, আমরা এখানে ধানের খুব ভাল একটি বাম্পার ফলন আশা করছি। ইতোমধ্যে সরকারীভাবে ধান ক্রয় শুরু হয়েছে। কৃষকের যেন সুবিধা হয় সেজন্য ন্যায্যমূল্য দিয়ে মাঠ থেকে ধান ক্রয়ের ব্যবস্থা করেছি।
এসময় আড়িয়লবিলের কৃষক সেলিম প্রধান বলেন, অন্য জেলা থেকে শ্রমিক এনেছি।আমার এখানে ৩০ জন শ্রমিক আছেন। শ্রমিকরা আসতে চাইছিলোনা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় শ্রমিকরা এসেছেন। অন্য অন্য বছরের তুলনায় এবছর একটু শ্রমিকদের ডিমান্ড ব্যতিক্রম। এবছর করোনার প্রভাবে তাদের সাথে কথা হয়েছে ৩ বেলা খাবার,যাতায়াত ভাড়াসহ থাকার ব্যবস্থা করছি। এছাড়াও দৈনিক একজন শ্রমিককে ১ মন করে ধান দিতে হবে। কৃষক জাহাঙ্গীর বলেন,তিনিও প্রায় ৪০০ শতাংশ জমিতে ধানের আবাদ করেছেন।সরকার ধান কাটার মেশিন দেওয়ায় অনেক কৃষকের দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় এখানকার কৃষকদের চোখে মুখে আশার আলো ফিরে এসেছে।
শ্রীনগর উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি অফিসার মো.জাহাঙ্গীর আলম বলেন,শ্রীনগরে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। এরমধ্যে আড়িয়লবিল এলাকার শ্রীনগরের প্রায় ৭টি ইউনিয়নের ৫ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ করা হয়েছে। করোনার প্রভাবে পাকা ধান নিয়ে বিল পাড়ের কৃষকরা দুশ্চিন্তায় পরেছিলেন।আশা করছি প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে কৃষকরা শান্তিতে ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।
কৃষি বিভাগ জানায়, প্রায় ২৬ হাজার একর আয়তনের আড়িয়ল বিলের অন্তত ২৪ হাজার একরে ধান চাষ হয়। প্রতিবছর ধান উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন।