বিক্রমপুর খবর : শ্রীনগর প্রতিনিধি : বিক্রমপুর খ্যাতি অর্জন করেছে তার , কৃতী সন্তান এবং প্রাচীন বাংলার রাজধানীর কারণে। প্রাচীন কাল থেকেই রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিক্রমপুর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিক্রমপুরের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে নতুন করে প্রজন্মকে সচেতন করা, সমুন্নত ও গৌরব পুনরুদ্ধার এবং আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে গঠিত হয় অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন। এই সংগঠনটির একটি কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়াও রয়েছে মুন্সীগঞ্জ সদর, লৌহজং, শ্রীনগর, সিরাজদিখান এবং টঙ্গীবাড়ি উপজেলা কেন্দ্র। এই কেন্দ্রগুলো প্রতিবছর উপজেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের কৃতী শিক্ষার্থী এবং গুণীজন সম্মাননা প্রদান করে আসছে। কেন্দ্রগুলোর রয়েছে নিজস্ব পাঠাগার। এছাড়া সকল জাতীয় দিবস এবং অন্যান্য উৎসবে রচনা প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য, উপস্থিত বক্তৃতা, উচ্চারণ ও বানান বিশুদ্ধকরণ, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। বেশ কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তিত্বের জন্মশত বার্ষিকী পালন করেছে। কেন্দ্রের রয়েছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক দল।
মাসিক ভিত্তিতে সাহিত্যসভা করে আসছে। লৌহজং এর কনকসারে এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এখানে বঙ্গীয় গ্রন্থ জাদুঘর, সংগ্রহশালা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে। মুন্সীগঞ্জের মালপাড়ায় রয়েছে গবেষণা কেন্দ্র। নাটেশ্বর ও রঘুরামপুর খননস্থলের নিকট সাইট জাদুঘর নির্মাণের চেষ্টা চলছে। এজন্য জমি কেনা হয়েছে। অগ্রসর বিক্রমপুরের মূল শ্লোগান হল- আমরা আলোর পথযাত্রী। ২০০৯ সালে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন শ্রীনগরের বালাশুরে ৫.৭১ একর জমি লিজ নিয়ে অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নেয়। বর্তমানে দুটি পুকুরসহ লীজ নেয়া জমির পরিমাণ ১৩.৫০ একর। এই বাড়িটি ভাগ্যকুলের বিখ্যাত জমিদার যদুনাথ রায়ের।
বিক্রমপুর জাদুঘর
তিনি ১৯৬৭ সালে দেশত্যাগ করে সপরিবারে ভারত চলে যান। এর পরে এখানে ভাগ্যকুল শিশুসদন প্রতিষ্ঠা করা করা হয়। ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ও বসবাসের অনুপোযোগী হলে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয় এবং শিশুদের ১৯৯০ সালে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হলে এটি অব্যবহৃত ও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছিল। এর মধ্যেই দুস্কৃতকারীরা বহু মূল্যবান সামগ্রী হাতিয়ে নিয়ে গেছে। বিক্রমপুরের প্রতিটি জমিদার বাড়িই বেহাত হয়েছে। এটি রক্ষার জন্য এগিয়ে আসে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন। ইতোমধ্যেই যদুনাথ রায়ের পরিত্যাক্ত বাড়িতে বিক্রমপুর জাদুঘর, একটি নৌ-জাদুঘর এবং একটি পান্থশালা নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১০ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং ২০১৩ সালে জাদুঘরটি চালু করা হয়।
ঢাকার কাছাকাছি পূর্বপুরুষের কৃষ্টি ও কীর্তিময় সময়কে জানতে চলে আসুন “বিক্রমপুর জাদুঘর”-এ
ঘুরে আসুন বিক্রমপুর জাদুঘর
শত ব্যস্ততার শহরে একটু খোলামেলা জায়গায় দম ফেলার যেন ফুসরত নেই। কাজের ফাঁকে একটু ছুটি পেলেই তাই অনেকেই ছোটেন একটু বিনোদনের জন্য কিংবা ছুটির দিনে নিরিবিলি পরিবেশে ঘুরে বেড়াতে, প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে রাজধানীর খুব কাছেই বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেস ওয়েতে (ঢাকা-মাওয়া হাইওয়েতে) মাত্র ৫০ মিনিটে পৌঁছে যাবেন ভাগ্যকূল জমিদার বাড়ি “বিক্রমপুর জাদুঘর”। বালাসুর চৌরাস্তা থেকে ডানে ঢুকে যাবেন বিলের ধারে প্যারিস শহর জমিদার যদুনাথ রায়ের পরিত্যক্ত বাড়িতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন নামের একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলেছে তিন তলা বিশিষ্ট এই “বিক্রমপুর জাদুঘর” এবং একই প্রাঙ্গণে তিন তলা বিশিষ্ট একটি ‘গেস্ট হাউস’।
তিনতলা ভবনের এ জাদুঘরে প্রবেশ করতেই একটি ঢেঁকিশালা এবং দু’পাশে দুটি বড় মাটির পাতিল বা মটকা দেখতে পাবেন।
মোট ৭টি গ্যালারিতে রাখা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব নির্দশন।
নিচতলার বাম পাশের গ্যালারি যদুনাথ রায়ের নামে। এ গ্যালারিতে বিক্রমপুরের প্রাচীন মানচিত্র, বিক্রমপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া মাটিরপাত্র, পোড়া মাটির খেলনাসহ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শন আছে।
নিচতলার ডান পাশের গ্যালারিটি স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে। এ গ্যালারিতে আছে ব্যাসাল্ট পাথরের বাটি, গামলা, পাথরের থালা, পোড়া মাটির ইট, টালি ইত্যাদি এছাড়া বিক্রমপুরের নানা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার ছবিসহ বিভিন্ন নিদর্শন।
দ্বিতীয় তলার বাম পাশের মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি, ইতিহাস, দলিল, বই ও বিভিন্ন নমুনা। আর ডান পাশের গ্যালারিতে আছে বিক্রমপুরে জন্ম নেয়া মনীষীদের জীবন ও কর্মের বৃত্তান্ত। আরও আছে কাগজ আবিষ্কারের আগে প্রাচীন আমলে যে ভূর্জ গাছের বাকলে লেখা হতো সেই ভূর্জ গাছের বাকল।
তৃতীয় তলায় তালপাতায় লেখা পুঁথি, পুরাতন খাট পালং, চেয়ার, টেবিল, আলমারী,কাঠের সিন্দুক, আদি আমলের মুদ্রা, তাঁতের চরকা, পোড়া মাটির মূর্তি, সিরামিকের থালাসহ প্রাচীন আমলে স্থানীয় মানুষদের ব্যবহার্য বিভিন্ন নিদর্শন।
মাটি খুঁড়ে পাওয়া ১০০০ বছর আগের বিক্রমপুরের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস
বিক্রমপুরের হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল এতদিন। তা এখন অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রায় দেড় হাজার বছর আগের বৌদ্ধনগরী সহ বেশ কিছু প্রত্ননিদর্শন সন্ধান পায় মাটি খুঁড়ে বিভিন্ন পর্যায়ে এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সভ্যতা গড়ে উঠেছে তার প্রমান করে মাটির নিচে প্রাচীন নগরসভ্যতার আবিষ্কার। ২০১২ সালে রামপালের রঘুরামপুরে বৌদ্ধবিহার আবিষ্কার, টঙ্গিবাড়ীর নাটেশ্বরে এক থেকে দেড় হাজার বছরের পুরোনো একটি বৌদ্ধনগরী আবিষ্কার করা হয়েছে। এর নির্মাণশৈলী শুধু বাংলাদেশের নয়, মানবজাতির ইতিহাসে বিশ্বের ঐতিহ্যের অংশ হবে। এক সময় ইউনেস্কো এই প্রাচীন নিদর্শনকে বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করবে। এটা প্রত্নতাত্ত্বিক পার্কে রূপ নিবে। গতবছর বাংলাদেশ সকারের সাথে এবং চীন সরকারের সাথে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর হয়েছে।
মাটি খুঁড়ে পাওয়া বিক্রমপুরের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস ঐতিহ্যর নিদর্শন নিয়ে একটি গ্যালারীতে নতুন মাত্রায় যোগ হয়েছে। রঘুরামপুর ও নাটেশ্বর থেকে প্রাপ্ত কিছু মহামূল্যবান নির্দশন/ছবি এই গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে। এসব নির্দশন বিক্রমপুরের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করছে।