প্রকাশিত: রবিবার, ২৭ডিসেম্বর ২০২০ইং।। ১২ই পৌষ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ(শীতকাল)।। ১১ই জমাদিউল-আউয়াল,১৪৪২ হিজরী।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : বাংলা নাটকের জনপ্রিয় মুখ আবদুল কাদেরের নাটকের প্রতি নিবেদনের কথা উঠে এসেছে তার দীর্ঘ দিনের সহকর্মীদের কণ্ঠে।
আবদুল কাদের যে মঞ্চ নাটকের দলে অভিনয় করতেন, সেই ‘থিয়েটার’-এর সভাপতি ফেরদৌসী মজুমদারের মতে, এ রকম গুণী অভিনেতা হয়ত আর আসবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ার সময় থেকেই নাট্যচর্চায় যুক্ত ছিলেন আবদুল কাদের। স্বাধীনতা পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার সাথে একসঙ্গে কাজ করেছেন ঢাকা থিয়েটারের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু।
তার মতে, আবদুল কাদেরের মতো সুশৃঙ্খল অভিনেতা ‘মঞ্চে বিরল’।
ছবি: ফেইসবুক থেকে নেওয়া।
নাটক অন্তঃপ্রাণ কাদের কর্মজীবনে গিয়েও অভিনয়ের পাশাপাশি নাটকের জন্য বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছিলেন, তাও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন বাচ্চু।
মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকে সমান সক্রিয় আবদুল কাদেরকে বিপুল জনপ্রিয়তা দিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের টিভি সিরিজ ‘কোথাও কেউ নেই’র বদি চরিত্র।
ক্যান্সারের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শনিবার সকালে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা গেছেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।
হাসপাতাল থেকে আবদুল কাদেরের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুর ডিওএইচএসের বাসায়। মিরপুর ডিওএইচএস জামে মসজিদে জানাজা শেষে বিকাল ৩টার দিকে মরদেহ আনা হয় শিল্পকলা একাডেমিতে।
অভিনেতা আবদুল কাদেরের কফিন শনিবার শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অস্থায়ী বেদীতে তোলা হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার স্ত্রী খাইরুন্নেছা কাদের।
একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সামনে অস্থায়ী বেদিতে রাখা হয় মরদেহ। সেখানে একে একে শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, নাটকের দল ঢাকা থিয়েটার, থিয়েটার, সুবচন, সময়, ডিরেক্টরস গিল্ড। আবদুল কাদেরকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন তার সহকর্মীরা।
শ্রদ্ধা নিবেদন শুরুর আগে অভিনেতা আবদুল কাদেরের স্ত্রী খাইরুন্নেছা কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছেলে-মেয়ের প্রতি ভীষণ অন্তঃপ্রাণ ছিলেন তিনি। শেষ কথায় তিনি বলেছিলেন, আমি তো আমার পরিবারের প্রতি শেষ দায়িত্বটুকু পালন করে যেতে পারলাম না। আমার কত কাজ বাকি থেকে গেল!
“অভিনয় জীবন, চাকরি জীবনের বাইরে তিনি তার পরিবারকে কতটা গুরুত্ব দিতেন, সে তো আমি জানি। সবাই দোয়া করবেন তার জন্য।”
ব্যক্তিগত জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা আবদুল কাদের। তার হাত ধরেই অভিনয়ে এসেছে নাতনি সিমরিন লুবাবা।
অভিনেতা আবদুল কাদেরের কফিন শনিবার শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অস্থায়ী বেদীতে তোলা হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার স্ত্রী খাইরুন্নেছা কাদের।
শিশু অভিনেত্রী লুবাবা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “আমার দাদা আমাকে দোয়া করে বলে গেছেন, আমি যেন বড় হয়ে বড় সংগীত শিল্পী হই। বড় মনের মানুষ হতে বলে গেছেন। বলেছেন, সব সময় যেন সিনিয়রদের সম্মান করে কথা বলি। সবাই দোয়া করবেন আমার দাদার জন্য।”
১৯৫১ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ী থানার সোনারং গ্রামে জন্ম নেওয়া কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর সিঙ্গাইর কলেজ ও লৌহজং কলেজে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। পরে বিটপী বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেন। বিটপী ছেড়ে পরে তিনি বাটায় যোগ দেন ১৯৭৯ সালে; সেখানে ছিলেন ৩৫ বছর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে নাট্যচর্চায় জড়িয়ে পড়া আবদুল কাদের শুরুতে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা থিয়েটারে, এর প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
অভিনেতা আবদুল কাদেরকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন প্রবীণ অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার।
তার স্মৃতিচারণ করে ঢাকা থিয়েটারের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, “১৯৭২ সালে আমাদের বয়স যখন ২২ তখন ঢাকার নাট্যমঞ্চে একইসঙ্গে আমাদের যাত্রা শুরু। কাদের ভাই ভালো বন্ধু ছিলেন, তার মতো সুশৃঙ্খল অভিনেতা মঞ্চে বিরল। তিনি ছিলেন ভীষণ নাট্য অন্তঃপ্রাণ, অজাতশত্রু।”
নাসিরউদ্দিন ইউসুফ জানান, আশির দশকে যখন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন গঠিত হয়নি, তখন বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনেও অগ্রণী এক সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিলেন আবদুল কাদের।
বাটার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা হিসেবে কাদের মঞ্চনাটকের দলগুলোর বিজ্ঞাপনও কীভাবে এনে দিতেন, সেই কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, “অভিনেতা হিসেবে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন আবদুল কাদের। বহুমাত্রিক এ অভিনেতা ছিলেন দারুণ এক নাট্য সংগঠক।”
১৯৭৩ সাল থেকে থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর সদস্য এবং চার বছর যুগ্ম-সম্পাদকের ও ছয় বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন আবদুল কাদের। পরে তিনি থিয়েটারের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
অভিনেতা আবদুল কাদেরের জন্য দোয়া চাইছেন তার নাতনি শিশু অভিনেত্রী সিমরিন লুবাবা।
থিয়েটার সভাপতি নাট্য ব্যক্তিত্ব ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, “টিভি নাটকে কাদের মজার সব চরিত্রে অভিনয় করলেও মঞ্চে ছিল তার একদম বিপরীত। সব সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয় করতেন কাদের। পুরো নাটকের সবার সংলাপ তার মুখস্ত থাকত। ভীষণ রসবোধ ছিল তার। তার মতো গুণী অভিনেতা হয়ত আর আসবে না।”
তার অভিনীত মঞ্চনাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই, স্পর্ধা’, ‘দুই বোন’, ‘মেরাজ ফকিরের মা’।
এছাড়া দেশের বাইরে জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কলকাতা, দিল্লি, দুবাইয়ের মঞ্চেও তিনি বাংলা নাটকে অভিনয় করেছেন আবদুল কাদের।
অভিনেতা আবদুল কাদেরের জন্য দোয়া চাইছেন তার নাতনি শিশু অভিনেত্রী সিমরিন লুবাবা।
বিটিভিতে শিশুকিশোরদের জন্য নাটক ‘এসো গল্পের দেশে’ র মাধ্যমে টিভি নাটকে অভিনয় জীবন শুরু করেন তিনি। মঞ্চে ৩০টি ও টিভি নাটকে তিনি তিন হাজারের মতো নাটকে অভিনয় করেছেন। বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তেও নিয়মিত মুখ তিনি।
আবদুল কাদের বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাট্যশিল্পী ও নাট্যকারদের একমাত্র সংগঠন টেলিভিশন নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার সংসদের (টেনাশিনাস) সহ-সভাপতি ছিলেন।
আবদুল কাদের অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘মাটির কোলে’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘শীর্ষবিন্দু’, ‘সবুজ সাথী’, ‘তিন টেক্কা’, ‘যুবরাজ’, ‘আগুন লাগা সন্ধ্যা’, ‘এই সেই কণ্ঠস্বর’, ‘আমার দেশের লাগি’, ‘সবুজ ছায়া’, ‘দীঘল গায়ের কন্যা’, ‘ভালমন্দ মানুষেরা’, ‘দূরের আকাশ’, ‘ফুটানী বাবুরা’, ‘এক জনমে’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘ফাঁপড়’, ‘চারবিবি’, ‘সুন্দরপুর কতদূর’, ‘ভালোবাসার ডাক্তার’, ‘চোরাগলি’, ‘বয়রা পরিবার’ ইত্যাদি।
শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষে অভিনেতা আবদুল কাদেরের মরদেহ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স রওনা হয় বনানী কবরস্থানে। সেখানেই মায়ের কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি।
২০০৪ সালে আবদুল কাদের অভিনয় করেন ‘রং নাম্বার’ চলচ্চিত্রে। অভিনয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু বিজ্ঞাপনের কাজও করেছেন এ সফল অভিনেতা।
দীর্ঘ অভিনয় জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে টেনাশিনাস পদক, মহানগরী সাংস্কৃতিক ফোরাম পদক, অগ্রগামী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পদক, যাদুকর পি.সি. সরকার পদক, টেলিভিশন দর্শক ফোরাম অ্যাওয়ার্ড, মহানগরী অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কিছু পদকও পেয়েছেন আবদুল কাদের।
তাকে নিয়ে থিয়েটার-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, “থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘ দিন দায়িত্ব পালন করেছে কাদের। তার মতো ধীমান অভিনেতা বাংলা নাটকে খুব কম।
“কাদের যখন চেন্নাই হাসপাতালে, তখন সে ভিডিওকলে আমাকে বলত, সে কখন দেশে ফিরবে। সে চেয়েছিল দেশের মাটিতেই তার মৃত্যু হোক। সবার সঙ্গে কথা বলে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল তার। বাঁচার আকুতি ছিল তীব্র।”
অভিনেতা আবদুল কাদেরের প্রয়াণে নাট্যাঙ্গনের কলাকুশলীরা এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।
অভিনেতা ঝুনা চৌধুরী বলেন, “মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বড় মনের। তিনি কত বড় অভিনেতা ছিলেন, সেটা তো তার জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে দেয়।”বিকালে বনানী কবরস্থানে আবদুল কাদেরকে তার মায়ের কবরে সমাহিত করা হয়েছে বলে স্ত্রী জানিয়েছেন।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর–আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন–বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’