আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর; যে ঝড় কেড়ে নিয়েছে লক্ষাধিক প্রাণ!

0
10
আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর; যে ঝড় কেড়ে নিয়েছে লক্ষাধিক প্রাণ!

প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার,১২ নভেম্বর ২০২০ইং ।। ২৭শে কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)।। ২৫শে রবিউল আউয়াল,১৪৪২ হিজরী।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : আজ ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এই দিনে ভোলাসহ উপকূলবাসীর বিভিষীকাময় এক দুঃস্বপ্নের দিন। এদিন উপকূলীয় জেলা ভোলার ওপর দিয়ে বয়ে যায় সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস গোর্কি। যার নাম ছিলো ‘ভোলা সাইক্লোন’। এই ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দেয় ঘোটা উপকূলকে। প্রান হারান কয়েক লাখ মানুষ। তাই নভেম্বর আসলে এখনো আতকে ওঠেন বেঁচে যাওয়ারা।

তখনও জন্ম হয়নি বাংলাদেশের। বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের পরিচয় পূর্ব পাকিস্তান নামে। ভারত- পাকিস্তান দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কে চলছে চাপা উত্তেজনা। ফলশ্রুতিতে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান অনেকটা বন্ধই থাকে দু’দেশের আবহাওয়াবিদদের মধ্যে।

উইকিপিডিয়া বলছে, ঢাকায় অবস্থিত তৎকালীন পাকিস্তান আবহাওয়া কর্তৃপক্ষও আগে থেকে নেয়নি যথাযথ পদক্ষেপ। শুধু ঘটনার দিনই আসছে ঘূর্ণিঝড়কে ‘ভয়ানক’ বলে খবর প্রচার করে পাকিস্তান রেডিও। ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে অনেক। খবরটাকে খুব বেশী গুরুত্ব দেয়নি উপকূলের সাধারণ মানুষজন। ভয়াবহতা ঠেকাতে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও তেমন ছিল না।

মুষলধারে বৃষ্টি আর প্রচণ্ড ঝড় আগে থেকেই জানান দিচ্ছিল ভয়াবহতার। ১২ তারিখ মধ্যরাতে চট্টগ্রাম, ভোলা, চরফ্যাসন, মনপুরা, সন্দ্বীপ, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, বোরহানুদ্দিন, চর তজুমদ্দিন, দক্ষিণ মাঈজদী, হারিয়াঘাটা এলাকার ওপর দিয়ে ২২২ কিলোমিটার বেগে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়। সাথে ছিল ১৪ ফুট জলোচ্ছ্বাস।

রাতভর ধ্বংসযজ্ঞের পর, দিনের বেলা বেঁচে থাকা মানুষজন খুঁজে ফিরে হারানো স্বজন। নদী পাড়ে মিলে ভেসে যাওয়া মানুষের মৃতদেহ।

জলোচ্ছ্বাসে নিখোঁজ হয়েছিল ২০ হাজার জেলে নৌকা। মারা গিয়েছিল ১০ লক্ষাধিক গবাদিপশু।

বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছিল চার লাখের বেশি। ঝড়ের পর দুর্যোগ মোকাবেলা, ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি সহায়তার অপ্রতুলতা ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানে।

বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, যিনি কিনা ভোলা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “অসংখ্য লোকের মৃতদেহ আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। আমরা দিশাহারা হয়ে গেলাম। এখনো স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে শিবপুর ইউনিয়নের রতনপুর বাজারের পুকুর পাড়ে শত শত লোককে দাফন করার দৃশ্য! এত মৃতদেহ যে দাফন করে আর কুলাতে পারছিলাম না।”

“দাসেরহাটের বড় বড় ব্যবসায়ীরা হলেন সর্বস্বান্ত। চিত্ত বাবু নামে এক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তার গুদামঘরে চাল, ধান, সুপারি ছিল। তিনি একেবারে রিক্ত।”

এত মৃত্যু আর ভয়াবহতার পরও সরকারি সহায়তা আসে চারদিন পর।

ভয়াল ১২ নভেম্বর। ৫০ বছর আগে ১৯৭০ সালের এ দিনে দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির পর উপকূলের ওপর দিয়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঝড় আর ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস কেড়ে নেয় কয়েক লাখ মানুষের প্রান। পাশাপাশি কেড়ে নেয় পশুপাখির প্রাণও। এ রাতের জলোচ্ছ্বাসে নিজের সন্তান ও পরিবারের নিকটাত্মীয়সহ ৩৫ জনকে হারিয়ে বেঁচে আছেন মনপুরায় মফিজা বেগম। স্বজন হারানোর সেই স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় ।

মফিজা বেগম জানায়, ’৭০-এর ১২ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডবে প্রবল স্রোত ভাসিয়ে নেয় তাকে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কোলে থাকা একমাত্র কন্যা সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে গাছের ডাল ছেড়ে দেন। তাতেও হয়নি শেষ রক্ষা- সন্তানও হারান, নিজেও ভেসে যান এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়। ভেসে আসা কাঠ ধরে বেঁচেছিলেন। এরপর ওঠেন মরা গরুর পিঠে। এভাবে সাতদিন। ধুঁকে ধুঁকে বাঁচার পরে স্টিমারের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে পারেন তিনি। স্টিমার থেকে আসা স্পীডবোটটি মফিজার খুব কাছে চলে আসে। একজন তার কাছে এগিয়ে আসে।

মফিজা তাকে বলেন, “তুমি আমার ভাইয়ের মত। আমার গায়ে তেমন কোন কাপড় নেই। আমাকে তুমি বাঁচাও।” ঘূর্ণিঝড়ের পর পুরো সাত সাতটি দিন বেশ চেতনা থাকলেও স্পীডবোটে আসা বাবুল নামের ব্যক্তিটি বোটে তুলতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মফিজা। অজ্ঞান অবস্থায় কেটে যায় আরও একদিন।

জ্ঞান ফিরলে মফিজা নিজেকে আবিস্কার করেন হাসপাতালের বেডে। কিছুই বুঝতে পারেন না। দায়িত্বরত নার্সদের জিজ্ঞেস করেন- “আমি কোথায়? আমার কী হয়েছিল?” নার্সরা তখন মফিজাকে জানান- “আপনি হাসপাতালে আছেন। ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে আপনি কর্ণফুলি নদীতে আটকা পড়েছিলেন। সেখান থেকে আপনাকে এখানে আনা হয়েছে।”

নার্সের কথা শুনে মফিজার সব মনে পড়তে থাকে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে যে কাঁটা বিধেছিল- তা তখন টের পেতে থাকেন। সারা শরীর ব্যথা। সেদিনে কথা মনে পড়লে আজও আতঁকে উঠেন মফিজা।

১২ নভেম্বরের রাতে প্রলয়ংকরী “ভোলা সাইক্লোন” তান্ডবে ভোলার সদর উপজেলা ছাড়াও দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, তজুমদ্দিন, মনপুরা, চর নিজাম, ঢালচর ও চর কুকরি-মুকরিসহ গোটা উপকূলীয় এলাকা পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। সেই প্রলয়ংকরী তান্ডবে ভোলার ৩ লক্ষাধিক মানুষ প্রান হারায়। পরিণত হয় মানুষ আর গবাদিপশুর মরদেহের স্তুপে। সত্তরের সেই যন্ত্রণাময় স্মৃতি নিয়ে এখনো দিন কাটছে ভোলাবাসীর।

মনপুরার হাজিরহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দিপক চৌধুরী বলেন, “৭০ এই ঘূর্নিঝড়ের পরেও এখনও উপকূলীয় জেলায় টেকসই বেড়িঁবাধ নির্মাণ হয়নি। বেড়িঁবাধগুলো সম্পূর্নরুপে সংস্কার করে টেকসই করার আহবান জানাই।”

ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) এর উপ-পরিচালক সাহাবুদ্দিন মিয়া বলেন, “ঘূর্নিঝড় নিয়ে ৭০ এর মানুষের মধ্যে অসচেতনতার অভাবে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বর্তমান সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ভোলার প্রশাসনের সক্ষমতা আগের তুলনায় বেড়েছে। এছাড়া অনেক সেচ্ছাসেবী দল রয়েছে। মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে।” তবে আরো আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হলে ক্ষয়-ক্ষতি কমে আসবে বলে জানান তিনি।

পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এ যাবত যত ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রানহানি ঘটে ৭০-এর ১২ নভেম্বরে। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজার। ১৯৭০ এর পরে শুধু নভেম্বর মাসেই সিডর, আইলা সর্বশেষ বুলবুলের মতো বড় ৩টি ঘূর্ণিঝড় ভোলায় আঘাত হানলো।

বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়টি পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঝড় হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। চলতি বছরের ১৮ মে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতী আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকা প্রকাশ করে।

তালিকার শীর্ষ প্রাণঘাতী ঘটনা হিসেবে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ ঝড়টিকে পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এতে বলা হয়, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নবেম্বর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে সর্বকালের ভয়াবহ প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে। সরকারি হিসেবে এতে তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষ মারা যান। তবে বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি ছিল।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ‘৭০-এর আগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন’-এ প্রায় ২ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এরমধ্যে এক লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জ তথা বর্তমান বরিশাল অঞ্চলে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানা যায়। ওই ঘূর্ণিঝড়েও ২ লাখ লোক প্রাণ হারান।

১৯৭০-এর পরের ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ছিল ভয়াবহ। এতে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর, ২০০৮ সালের ৩ মে নার্গিস, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর নিলোফার, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানুসহ বেশকিছু ছোট-বড় ঘূর্ণিঝড়
উপকূলে আঘাত হানে।

এদিকে ১৯৭০ সালের এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কয়েক বছর ধরে স্থানীয় সংবাদকর্মীসহ দশমিনার সচেতন নাগরিকরা ১২ নভেম্বর উপকূল দিবসের দাবিতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এ বছর দশমিনায় মানববন্ধন ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন .. ..

‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন