অনুজপ্রতীম সাথী মাহবুবে আলমের মৃত্যুর খবরটা বন্ধু রাজনীতিক মুকুল চৌধুরীর কাছ থেকে শোনার পর থেকেই মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। এক বেদনা আরো আরো বেদনাকে ডেকে আনে। সব জমাট হয়! নিস্তব্ধ-অন্ধকার বলে রাতেই সব বেদনা যেন মনে জমাট বাঁধে।
সেই অমায়িক শুচিস্নিগ্ধ মিষ্টি হাসিটা, যাতে মাথাটা ডানদিকে নুয়ে পড়তো, সেটাই প্রায়ান্ধকার ঘরে অঘুমে থেকে চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল। কখনও তার নির্ভিক চেহারা, যা ছিল আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে জীবন্ত-উদ্যোগী, তা আধোঘুমের মধ্যে ভেসে যাচ্ছিল। কখনো স্বপ্নে দেখেছি, এটর্নী জেনারেল অফিসে কাজের মধ্যে তিনি ডুবে আছেন। সকালে ঘরের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর একনিষ্টতা-একাগ্রতার দিকটা ভেবে মনে স্বস্তি পেলাম এই ভেবে যে, এমন একটা ভালো ও কর্মবীর মানুষের সাথে আমার সংযোগ ঘটেছিল। সংগ্রাম-আন্দোলনের সাথী হতে পেরেছিলাম।
গতকাল মৃত্যুর খবর শুনে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ক্ষণে ক্ষণে আমার স্ত্রী আভা ও আমি -আমরা দুজন মাহবুবে আলম ও ভাবীসহ পরিবারের কথাই আলোচনা করেছি। বিনতাভাবী ,কন্যা শিশিরকনা ও ছেলের কথা ভেবে মনটা বিষন্নতায় ভরে গেছে। আমরা দুই পরিবার ছিলাম প্রতিবেশি। মিরপুরে। কাছাকাছি থাকায় পারিবারিক বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছিল।
আমি মাসে দু-একবার যেতাম তাঁর বাসায়। যখনই গিয়েছি খেয়ে আসতে হয়েছে। সপরিবারে মাহবুবভাইও আমাদের বাসায় এসেছেন। পারিবারিক আয়োজনে তিনি ও ভাবী যে কতটা আপন হতে পারেন, তা ভাবাই যায় না।
আর আভা! খুব, খুবই পছন্দ করতেন এই দম্পতিকে। মহিলাদের স্টাইলের নেশার শখে পড়ে ভাবী একটা শাড়ির দোকান ‘গাঁথন’ দিয়েছিলেন মিরপুরে বাসার নিচ তলায়। বিনতাভাবীর টানে সময়-সুযোগ পেলেই আভা চলে যেতো সেখানে। ভাবী দোকানে গেলে আভাকে বাসায় নিবেনই। কাল মৃত্যুর খবরটা শোনার পর শোকে মূহ্যমান আভার প্রথম মন্তব্য ছিল: এমন সুন্দর-পরিশীলিত একটা জীবন-জুটি ভেঙে গেল! করোনা রাক্ষুসী! মনোবেদনা মন থেকে মুছে ফেলা যাবে না।
যদি পারিবারিক সখ্যাতা গড়ে না উঠতো, তবে জানতামই না এই জুটির রবীন্দ্রপ্রীতির কথা। মিরপুরের লাল ইটে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন বাসায় খুবই উপযুক্ত স্থানে তারা গড়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্র কর্ণার। অপূর্ব মোহময় ও উপযুক্ত আলোর ব্যবস্থা ছিল সেখানে। আর ঘরবাড়ি! এতটা পরিচ্ছন্ন-ঝকমকে খুব কমই দেখা যায়। বাস্তবে পরিশীলিত হলে মানুষ সবদিক থেকেই হন। মাহবুবে আলম কেবল চেহরায়-ব্যবহারে সুন্দর-ভদ্র-পরিশীলিত ছিলেন না, অন্তরে-বাহিরে তেমনটাই ছিলেন। মাহবুব শব্দের অর্থ প্রিয়; নামটি আসলেই সার্থক।
এক সময় দুরত্বের কারণে অসুবিধা হওয়ায় আমরা দুই পরিবারই মিরপুর ছাড়লাম। কিন্তু ওই দিনগুলোতে এবং পরে কিছুকাল পারিবারিক আয়োজনে যখন দেখা ও কথা হতো মহাবুবে আলমের সাথে, তখন সবটা জুড়ে থাকতো দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা। তখন তার অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা আমাকে অনুপ্রাণীত করতো। তাঁর ছিল বিক্রমপুর নিয়ে গর্ব। পাশে সোনারগাঁয়ে আমার আদিবাড়ি। তাই এক অর্থে পাশাপাশি এলাকার মানুষ।
তাঁর মুখে সংখ্যালঘু মানুষদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় গল্প মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। এনিয়ে গভীর বেদনাবোধ ছিল তাঁর। গরীব মানুষের প্রতি ছিল অপরিসীম টান। ঐতিহ্যের প্রতি ছিল তার গভীর দরদ। জগদীশ বসু, প্রফুল্ল সেন, সত্যজিৎ রায়, সুচিত্রা সেন, ইলা মিত্র, সত্যেন সেন প্রমুখ বাঙালি গুণিদের সাবেক বাড়ি ও স্মৃতিরক্ষা নিয়ে তাঁর ছিল দারুণ আগ্রহ।
এমন দেশপ্রেমিক-জনদরদী-ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল-বন্ধু বৎসল-অসাম্প্রদায়িক মানুষ সমাজে এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে বলেই দেশ-বিশ্বের
মানুষ যখন কালের পরিক্রমায় ডানদিকে ঝুঁকে, তখন মনে ভরসা পাই।
কমিউনিস্ট পার্টির জমিজমা সংক্রান্ত কাজে অনেক গিয়েছি তার কাছে। কখনও ফরহাদভাই গেছেন। তখন তিনি পুরানো ঢাকায় থাকতেন। পরিবারিক আইনী সমস্যায়ও গিয়েছি পুরানা পল্টনের চেম্বারে। আভাসহ গিয়েছি বিপদে পড়ে খালেদা জিয়ার আমলে। গতকাল রাতে এই নিয়ে স্মৃতিচারণ হচ্ছিল আমাদের দুইজনের।
১৯৯২ সাল। আভা তখন শিল্প ঋণ সংস্থায় (বিএসআরএস)-এর প্রথম মহিলা এজিএম। হঠাৎই খবর রটলো জিয়া-পুত্র তারেক রহমান পানির দামে ওই প্রতিষ্ঠানটি কিনে নিবে। ৭ সেপ্টেম্বর ওই প্রতিষ্ঠানটি ‘উন্নয়ন ব্যাংক লিমিটেড’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে। কার্ডও ছাপানো শেষ, কেবল বিতরণ বাকী। স্বাভাবিকভাবেই ওই অফিসে আন্দোলন শুরু হলো। অন্যায়ের প্রতিবাদে আভা সবসময়েই অগ্রণী।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে আভা কয়েকজন অফিসার নিয়ে দেখা করলেন সহপাঠী সাথী-বন্ধু, তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে। সংসদে প্রতিবাদ ওঠায় ওটা আর কেনা হলো না ‘তরুণ তুর্কী’ তারেকের। এরই জের ধরে ১৯৯৩ সালে অন্যায়ভাবে আভার চাকরি চলে যায়। এনিয়ে সংসদে প্রতিবাদ তোলেন পারিবারিক অগ্রজ বন্ধু সামসুদ্দোহা এমপি। খালাম্মা কবি সুফিয়া কামাল প্রথম মহিলা এজিএম-এর বিরুদ্ধে এই শাস্তির প্রতিবাদে পত্রিকায় বিবৃতি দেন এবং এমডিকে টেলিফোন করেন।
প্রচণ্ড চাপে পড়ে বিএসআরএস কর্তৃপক্ষ আভাকে টেলিফোনে জানালেন আবার জয়েন করতে। এবারে আমরা দুজনে গেলাম আইনজ্ঞ মাহবুব আলমের কাছে। করনীয় কি? জয়েন করা? নাকি অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুত করার জন্য মামলায় লড়াই? মাহবুব ভাই জানতেন, আমি কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক এবং আভার আয়ের ওপর সংসার চলে। তাই খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তবুও বললেন, জয়েন করা ঠিক নয়। অন্য অভিযোগে ফাসিয়ে দিতে পারে। আর মামলায় কোনো ফল হবে না। বরং মামলাবাজ বলে অন্য কোথাও চাকুরি পেতে অসুবিধা হবে। তার পরামর্শই আমরা মেনে নিয়েছিলাম।
বড় ছেলে শান্তনু একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে চাকরি ছেড়ে যাবে অন্য একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। মাত্র কয়েকদিন আগে চাকরি ছাড়ার বিষয়টি বলায় ব্যাংকে তার কিছু সমস্যা হলো। গেলাম মাহবুবভাইয়ের কাছে আইনী পরামর্শ নিতে। তার পরামর্শ মতোই সব করা হলো। মাহবুবভাই-এর প্রয়াণে আমরা একজন অকৃত্রিম পারিবারিক বন্ধুকে হারালাম।
এক সময় দূরে বাসা হওয়ায় পারিবারিক যোগাযোগ আর তেমন থাকলো না। তবে নানা আইনী পরামর্শ নিতে যেতাম তার কাছে। মণি সিংহ-ফরহাদ ট্রাস্ট-এর একজন প্রকৃত স্বজন ও বন্ধু ছিলেন তিনি। কত কাজে কত পরামর্শ যে নিয়েছি। তিনি আমাদের কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করে দিয়ে গেছেন। দেখা হলেই তিনি যুদ্ধাপরাধিদের বিচার নিয়ে জটিলতাসহ নানা সমস্যার কথা বলতেন।
সবচেয়ে বড় কথা জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের দুজনের রাজনৈতিক দলে অবস্থান ছিল এক। এর জন্য কোনো কথার আদান প্রদান হয়েছে, এমন নয়। কিন্তু আমরা জাতীয় রাজনীতির মূলধারা আন্দোলন-সংগঠনে সব সময় একসাথে ছিলাম। এটা আমার জন্য একটা তৃপ্তি।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনী কর্মকর্তা হিসাবে মাহবুবে আলমের নাম দেশের ইতিহাসে অমোচনীয় কালিতে লিপিবদ্ধ থাকবে। তিনি ওই পদে থাকতেই বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুসম্পন্ন হয়। প্রয়াত এই নির্ভীক দেশপ্রেমিক ও মানবপ্রেমিকের অকাল মৃত্যুতে জাতির অপূরনীয় ক্ষতি হলো।
অনুজপ্রতীম সাথী-বন্ধু-সুহৃদ মাহবুবে আলমের প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।