সাংবাদিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী নিজাম উদ্দিন আহমদের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

0
300
সাংবাদিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী নিজাম উদ্দিন আহমদের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত:শনিবার, ১৪ডিসেম্বর ২০১৯ ইং ।। ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ।

বিক্রমপুর খবর : বিক্রমপুরের লৌহজং থানার কুমারভোগ (মাওয়া) গ্রামে ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন সাংবাদিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী নিজাম উদ্দিন আহমেদ । তাঁর ডাকনাম দাদন। তাঁর বাবা সিরাজউদ্দিন আহমদ এবং মা ফাতেমা বেগম। পিতা-মাতার চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।

তার লেখাপড়ার শুরু গ্রামেরই মাওয়া প্রাইমারি স্কুলে। পরে স্থানীয় কাজির পাগলা এ.টি ইনস্টিটিউশন-এ দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। ১৯৪৬ সালে বিক্রমপুর ভাগ্যকূল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি. পাস করেন। নিজাম উদ্দিন আহমদ মুন্সিগঞ্জের সরকারি হরগঙ্গা কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান ডিগ্রী এবং ১৯৫২ সালে তিনি এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তিনি সাংবাদিকতায় যুক্ত হন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রাখার জন্য এই অকুতোভয় সাংবাদিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবীকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে ১৪ ডিসেম্বর,১৯৭১ পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার ও আল-বদর বাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের অংশ হিসাবে তাকে হত্যা করে।

১৯৫০ সালে করাচি থেকে প্রকাশিত ‘সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক আজাদ, পাকিস্তান অবজারভার, ঢাকা টাইমস, ইউপিআই, পিপিআই এএফপি, এপিপি, রয়টার্সে কাজ করেন। খুব দ্রুত প্রথম সারির সাংবাদিক হিসেবে দেশব্যাপী সুখ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (পিপিআই, বর্তমানে বিএসএসঃ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা)-এর জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। নিজামুদ্দীন আহমদ একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ৫৮’র রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। কর্মজীবনে দেশের জন্য জীবনের ঝুঁকি জেনেও দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ২৫শে মার্চের আগে সোয়াত জাহাজে করে চট্টগ্রামে অস্ত্র আনার বিষয়টি তিনিই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে জানান। এসময় তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের রাজনৈতিক খবর বঙ্গবন্ধুকে দিতেন। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ সেই কালরাতে অফিসেই ছিলেন তিনি। সারা শহরে তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিচরণ। রাত ৮ টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা কামারুজ্জামান (জাতীয় নেতা) তাঁকে ফোন দিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চান। নিজামুদ্দীন তাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের কথা জানান। পরদিন ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বেরিয়ে গণহত্যার খবর সংগ্রহের জন্য। নিজামুদ্দীন বাঙালির উপর পাক বাহিনীর এই বর্বর আক্রমনের সংবাদ বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সরবরাহ করতেন। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধি ম্যাক ব্রাউন তাঁর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য ও ছবির ভিত্তিতে মুক্তিবাহিনী, পাকিস্তানি বর্বরতা, বাঙালি গণহত্যার উপর রিপোর্ট করেছিলেন। পাকিস্তান সরকার আরোপিত কড়া সেন্সরশিপের মাঝেও তিনি বিবিসিকে নিয়মিত পূর্ব-পাকিস্তানের পরিস্থিতি, বাঙালি গণহত্যা, পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতা নিয়ে নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করতেন।

নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকা শুরু করেন। এসময় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে ডেকে পাঠানো হয় কিন্তু তিনি কৌশলে তা এড়িয়ে যান। এই ঘটনায় পাকিস্তানের নজরে তিনি শত্রু বলে চিহ্নিত হন। ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পুরান ঢাকার ১২ নম্বর রোকনপুরের বাসায় সপরিবারে ছিলেন তিনি। তাকে সেখান থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার ও আল-বদর বাহিনীর সদস্যরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে হত্যার জন্য।হয়েছে। বিবিসি’র মার্ক টালিসহ অনেক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এব্যাপারে খোঁজ-খবর করেছেন।

১৯৬২ সালে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন সেই নির্বাচনে ১৯৬৫ সালে নিজাম উদ্দিন আহমদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপরে তিনি পিপিআইতে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৬৯ সালে এর সম্পাদক হন। ১৯৬৯ সালে থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ওই সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিবিসি’র সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করেন।সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ ১৯৭১ সালে বিবিসি বাংলাদেশের সংবাদদাতা ও পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালের(পিপিআই) এর জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের অনেকের সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্যতা ছিলো। ২৫ মার্চ কালো রাত্রির আগে চট্টগ্রামে সোয়াত জাহাজে করে যে অস্ত্র আনা হচ্ছে এই খবর তিনিই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণ করেন। নিজাম উদ্দিন আহমদ এই সংবাদটি প্রথম পান ফ্রান্সের এসোসিয়েট প্রেসের (এপি) এক সহকর্মী বন্ধুর মাধ্যমে। বাঙালীর মুক্তি-সংগ্রামের একজন বলিষ্ঠ কর্মী ও সংগঠক হিসাবে গোটা পাকিস্তান আমলেই নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি। একাত্তরে তিনি ঢাকার কলতাবাজারের ১২/সি রুকনপুরে তার স্ত্রী-সন্তান অন্যান্য আত্নীয়-স্বজনদের সঙ্গে যৌথ পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে নিজাম উদ্দিন আহমদ মুন্সিগঞ্জের এক রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে কহিনূর আহমদ রেবার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী কোহিনুর আহমদ রেবা (১৯৯৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন), বড় মেয়ে শামানা নিজাম সিলভিয়া (৭১’এ বয়স ছিল ১১ বছর, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী), ছোট মেয়ে শারমিন রীমা (৭১’এ বয়স ছিল ০৯ বছর,বর্তমানে মৃত), কনিষ্ঠ সন্তান পুত্র শাফকাত নিজাম (ঢাকায় বসবাস করছেন)।

১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর দুপুরে আলবদররা অপহরণ করে নিয়ে যায় এই বরেণ্য সাংবাদিককে। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমনকি স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন বধ্যভূমিতে খোঁজ করেও এই শহীদ বুদ্ধিজীবীর মরদেহ পর্যন্ত পাননি তার স্বজনেরা। তার সন্তান শাফকাত জানান ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর দুপুর ১টা থেকে ২টার মধ্যে বাসার সবাই দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়। দরজা খোলামাত্রই বাসায় দুইজন অস্ত্রধারী প্রবেশ করেন। তারা ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দুতে সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদের নাম ধরে খোঁজ করতে থাকেন। পরিবারের সকলের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাবা খাবার টেবিল থেকে উঠে অস্ত্রধারীদের কাছে বলেন, আমিই নিজাম উদ্দিন আহমেদ। পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য অস্ত্রধারীরা তার কাছে পরিচয়পত্র চান। এক পর্যায়ে বাবা তাদেরকে পরিচয়পত্র দেখান। পরিচয়পত্র দেখানোর পরে তারা দেরি না করে তাদের সঙ্গে বাবাকে নিয়ে যেতে থাকেন। তিনি বলেন, মা তাদের পিছু পিছু যেতে থাকলে অস্ত্রধারীরা মাকে বাবার পেছনে আসতে মানা করেন। পরবর্তীতে প্রতিবেশীদের কাছে জানতে পারি, তারা বাবাকে চোখ এবং হাত বেঁধে একটি কাদা মাখানো মিনিবাসে উঠিয়ে নিয়ে যান অস্ত্রধারীরা। এ সময় ওই গাড়ির পেছন দিকে হাত এবং চোখ বাঁধা অবস্থায় আরো অনেক ব্যক্তি ছিলেন। তার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আলবদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান সরাসরি জড়িত ছিলেন। নিজাম উদ্দিনের মৃত্যুর পর বিবিসি তাঁর পরিবারের জন্য একটি ট্রাস্ট তহবিল গঠন করে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার এই কৃতিমান সাংবাদিককে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করলে বিবিসি সেদিন নিজাম উদ্দিনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে উল্লেখ করে-‘এই ঘোষণা এমন একজন সাংবাদিকের কাজের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বীকৃতি, যিনি কর্তব্যের প্রতি আনুগত্যের মূল্য দিয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে।’ উল্লেখ্য ২০১৩ সালের ৩রা নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল,চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খান কে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে নিজাম উদ্দিন আহমেদ সহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন