প্রকাশিত: সোমবার, ১৬ জুন, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ।। ২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ (বর্ষাকাল)।। ১৯ই জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরী।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক :
‘চিত্তরঞ্জন ও নারায়ণ’–রানা চক্রবর্তী
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর জীবদ্দশায় কলকাতার রসা রোডের বাড়িতে ‘নারায়ণ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে এই নারায়ণ কোন নির্জীব কোন শালগ্রাম শিলা ছিল না, আসলে তিনি ‘নারায়ণ’ নাম দিয়ে কিছুকাল ধরে একটি উচ্চাঙ্গের সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এই পত্রিকাটি বিংশ শতকের বাংলার বাংলা সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসে যেমন একটি দিকচিহ্নের গৌরব অর্জন করতে পেরেছিল, তেমনি এটি আবার চিত্তরঞ্জনের সাহিত্য-কর্মের বিশেষ ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
আসলে দেশবন্ধুর সমগ্র জীবনটাই এগিয়ে চলবার জীবন ছিল। এই কারণেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবার পর থেকে হিমালয়ের কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবার দিনটি পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল যে, নিজের জীবনের নানা পর্বে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও তিনি সমানের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। নিজের জীবদ্দশায় কাব্য সাধনার ক্ষেত্রে তিনি যেমন রসানুভূতির পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন, তেমনি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একটা নতুন শক্তির—একটা নতুন ভাবের উদ্বোধন করবার জন্যই নারায়ণ পত্রিকা প্রকাশ করবার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিত্তরঞ্জন দাশ ও প্রমথ চৌধুরী—এই দুটি নাম—তাঁদের সম্পাদিত নারায়ণ ও সবুজপত্র—এই দুটি সাময়িক পত্রিকার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এঁরা দু’জনেই যেমন বিদগ্ধ সাহিত্যরসিক ও সুলেখক কবি ছিলেন, তেমনি দু’জনেই আবার ব্যারিস্টার ছিলেন। তবে আইন-ব্যবসার দিকে অবশ্য প্রমথ চৌধুরী কোনদিনই বিশেষ মনোযোগ দেন নি—সে প্রতিভা তাঁর মধ্যে ছিল না, কিন্তু তিনি একজন জাত-সাহিত্যিক ছিলেন। তাঁদের উভয়ের মধ্যেই অসাধারণ সাহিত্যপ্রীতি ছিল এবং সাহিত্যে একটা নতুন দিগন্তের সন্ধানে তাঁরা উভয়েই ব্রতী হয়েছিলেন। চিত্তরঞ্জন যখন একটি নতুন মাসিক পত্রিকা বের করবেন ঠিক করেছিলেন, প্রমথ চৌধুরীও ঠিক সেই একইসময়ে একটি নতুন মাসিক পত্রিকা বের করবার কথা চিন্তা করছিলেন। যেহেতু তাঁরা দু’জনেই আর্থিক দিক থেকে সঙ্গতিসম্পন্ন ছিলেন, সেহেতু তাঁরা দু’জনেই সম্পূর্ণ নিজব্যয়ে এই সাহিত্যকর্মের বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন এবং উভয়েই নিজের নিজের পত্রিকাটি সম্পাদনা করবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এরপরে সেইমত চিত্তরঞ্জন নারায়ণ পত্রিকার এবং প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্রের সম্পাদক হয়ে উভয়েই তাঁদের নিজের নিজের পত্রিকায় নিজের নাম মুদ্রাঙ্কিত করে দিতে পেরেছিলেন। তবে এক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরীর বিশেষ সুবিধা ছিল যে—তিনি তাঁর এই সাহিত্যপ্রয়াসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ ও সাহায্য—দুটোই লাভ করেছিলেন। এর বিশেষ কারণ ছিল যে, প্রমথ চৌধুরী জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির জামাই ও কবির বিশেষ স্নেহের পাত্র ছিলেন। তবে একইসাথে একথাও সত্যি যে, বিদগ্ধ সাহিত্যরসিক ও কবি এবং একজন প্রথম শ্রেণীর সাহিত্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক হিসাবেই তিনি সমকালীন জোড়াসাঁকোর সাহিত্য-দরবারে একটা সহজ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে চিত্তরঞ্জনের সে সুবিধা ছিল না, এবং তিনি তেমন কোন সুবিধা-প্রার্থীও ছিলেন না। তবে তাঁর নিজের সাহিত্য শক্তির উপরে অগাধ বিশ্বাস ছিল। তাছাড়া, তাঁর সাহিত্যের আদর্শও স্বতন্ত্র ছিল, এদিক থেকে তিনি কিছুটা ‘revivalist’ ছিলেন; আর সেজন্য বাংলার ঐতিহ্যে ও বাঙালির ঐতিহ্যে তখন যাঁরা বিশ্বাসী ছিলেন, চিত্তরঞ্জন নিজের পত্রিকার জন্য সেসব বিশিষ্ট লেখকদের অকুণ্ঠ সহযোগিতা লাভ করতে পেরেছিলেন। প্রসঙ্গতঃ একথাও উল্লেখ্য যে, উক্ত পত্রিকা দুটি-ই স্বল্পায়ু ছিল, এগুলির মধ্যে কোনোটাই চার-পাঁচ বছরের বেশি স্থায়ী হতে পারে নি; কিন্তু নিজেদের সেই স্বল্পায়ু জীবনেই নারায়ণ ও সবুজপত্র নিজের নিজের আদর্শ অনুযায়ী বাংলা সাময়িক সাহিত্যের ইতিহাসে নিজের নিজের নামের স্বাক্ষর রেখে যেতে পেরেছিল। তবে পত্রিকা দুটির সুর যেমন আলাদা ছিল, তেমনি আদর্শ আর দৃষ্টিভঙ্গীও সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের ছিল। আরো ভালো করে বললে, উত্তরমেরু ও দক্ষিণমেরুর মধ্যে যতটা তফাৎ রয়েছে, চিত্তরঞ্জনের নারায়ণ ও প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্রের মানসিকতার মধ্যে ঠিক সেই ব্যবধান ছিল। কিন্তু তবুও একইসাথে একথাও সত্যি যে, তখনকার কলকাতার সাহিত্য-জগতে নারায়ণের পূজারীবৃন্দের যেমন কোন অভাব ঘটেনি, তেমনি সবুজপত্রের নিশান তুলে ধরবার জন্যও যোগ্য লেখকগোষ্ঠীর কোন অভাব হয়নি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ—
“ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।”
(সবুজপত্র, প্রথম সংখ্যা, ১৩২১ বঙ্গাব্দ; সবুজের অভিযান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
—লিখে সবুজপত্রের ললাটে জয়-তিলক এঁকে দিয়েছিলেন।
যাই হোক, চিত্তরঞ্জনের নারায়ণ পত্রিকার কথা আলোচনা করাই যেহেতু এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য, সেহেতু এবারে সেদিকেই নজর দেওয়া যাক। নারায়ণ আসলে চিত্তরঞ্জনের পরিণত সাহিত্য-প্রতিভার ফল ছিল। এপ্রসঙ্গে দেশবন্ধু-দুহিতা অপর্ণা দেবী তাঁর ‘মানুষ চিত্তরঞ্জন’ গ্রন্থে লিখেছিলেন—
“বাংলার প্রাণধারার সন্ধান নিবার এবং দেবার উদ্দেশ্য নিয়েই এ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। আমাদের তথাকথিত ইংরেজী-শিক্ষিত সমাজে তখন বাংলার সংস্কৃতির আদর ছিল না; বিশেষ করে দেশের সংস্কৃতির দিকে এ সমাজের তেমন দৃষ্টি ছিল না বললেই চলে। তাই বাবা ‘নারায়ণ’ পত্রিকা বার করে সমাজের এ অংশটিকে সচেতন করবার এবং সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যকে একটা নতুন রূপ দিয়ে তার হৃতমান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়াস পান।”
স্বয়ং চিত্তরঞ্জনও সেযুগের শিক্ষিত-সমাজের একজন প্রতিনিধিস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন; বিলাতে তিনিও কিছুকাল শিক্ষালাভ করেছিলেন এবং দু’বার তিনি পাশ্চাত্য দেশ ঘুরে এসেছিলেন ও পাশ্চাত্য সভ্যতার নিকট সংস্পর্শ পেয়েছিলেন। এমনকি, যে পরিবারের মধ্যে তিনি শৈশব ও কৈশোরে মানুষ হয়েছিলেন, সেখানকার আদব-কায়দা বা রীতিনীতির মধ্যেও নির্ভেজাল বাঙালি-সংস্কৃতি বা বাঙালি জীবন-বিন্যাসপ্রীতি ছিল। এপ্রসঙ্গে বিপিনচন্দ্র পাল জানিয়েছিলেন—
“চিত্তরঞ্জন পিতৃ-পরিবারে আধুনিক ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজের রীতিনীতি ও আবহাওয়ার মধ্যেই বাড়িয়াছিলেন।”
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল যে, বিলাত-ফেরত এবং ব্রাহ্ম-পরিবারের সন্তান হয়েও চিত্তরঞ্জন আমৃত্যু খাঁটি বাঙালি এবং মনেপ্রাণে বাংলার নিজস্ব জীবনধর্মের অনুরাগী হয়ে
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর– আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন– বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com
আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।
জাস্ট এখানে ক্লিক করুন। https://www.facebook.com/BikrampurKhobor
email – bikrampurkhobor@gmail.com

















































