প্রকাশিত : শনিবার, ১৫ আগস্ট ২০২০ইং ।। ৩১শে শ্রাবণ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।। বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক :
গীতালি দাশগুপ্তা
“হারিয়ে গেছে অন্ধকারে – পাইনি খুঁজে আর,
আজকে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার!”
শেখ রাসেল ও আমার সম্পর্কটা ছিল এক বিচিত্র সুরে বাঁধা। সেখানে প্রচলিত সুর-তাল-লয় বা ছন্দের বালাই ছিল না। ছিল, নিত্য নব নব আনন্দের ও গভীর ভালোবাসার অনুরণিত অনুরাগ। ওর সম্পর্কে আমার মুখে বলা যত সহজ, লেখা তত সহজ নয়। অনুভব গভীর হলে, ভাষা সেখানে অসহায়। এ-মুহূর্তে আমি তেমনি অসহায়!
আমার ভেতরের অনুভূতিটুকু ফুটিয়ে তুলে সকলকে বোঝানোর ক্ষমতাও যেন আমি হারিয়ে ফেলেছি। তবুও, “ভাষাহারা মম বিজন রোদনা, প্রকাশের লাগি করেছে সাধনা”, সে অনেকগুলো বছর… বয়ে বেড়াচ্ছি বেদনার এই নীল বোঝাটা। লিখতে বসেছি, বারবার কলম আটকে যাচ্ছে। অতীতের সুখস্মৃতি আজ দুঃখের আঁধারের অবগুণ্ঠনে ঢাকা। সে স্মৃতি আজ, আমার ভারী বোঝা। চিৎকার করে যাচ্ছি, “এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু নামাও…” কারোই যে এ বোঝা নামাবার ক্ষমতা নেই, তা আমি জানি। যতদিন বেঁচে আছি, রক্তে শিক্ত এ বেদনার বোঝা আমার সঙ্গী হয়েই আমাকে জড়িয়ে থাকবে। বুকের গভীরে যে দগদগে ঘায়ের সৃষ্টি হয়েছে, তা আমৃত্যু আমায় পুড়িয়ে খাবে। লিখতে যে বেশ কষ্ট হচ্ছে! আমি এগুবো কী করে? অতীত যে বর্তমান হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সেই অতীতকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যাচ্ছে না তো! ছোট্ট একটি হাসিমাখা মুখ আমার সামনে দাঁড়িয়ে, অথচ সেই মিষ্টি মুখখানা ছুঁতে পারছি না, পারছি না আগের মতো করে আদর করতে! খুনসুটির খেলাটাও তো বন্ধ! দম আটকে আসছে, চোখ বুজে অনুভব করছি, আমার সামনেই অতীত বর্তমান রূপে জাগরূক! এ যন্ত্রণা বোঝাই কী করে? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
“অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন
তার বক্ষে বেদনা অপার।”
আমি বিধাতার কাছ থেকে এই অলৌকিক আনন্দের ডালিখানা পেয়েছিলাম। আমার সেই আনন্দে ভরা ডালিখানা প্রলয় ঝড়ের আঘাতে ভেঙেচুরে কোথায় যেন হারিয়ে গেল! আজ খুঁজে ফিরছি, সে-ই আনন্দের অম্লমধুর, বেদনাবিধুর, অম্লান কিছু স্মৃতির ঐশ্বর্য্য।
অ-নে-ক গুলো বছর পার হলেও মনে হয়, এই তো সেদিনের ঘটনাগুচ্ছ! তারপরেও কোথা থেকে ছিঁড়বো সে স্মৃতির কুঁড়ি, বুঝে উঠতে পারছি না যে! সযত্নে আগলে রাখা সঞ্চিত স্মৃতির চারা গাছটাই আজ আমার একমাত্র সম্বল। সেখান থেকেই তুলতে হবে দু-চারটি এলোমেলো স্মৃতির অস্ফুট কুঁড়ি। সেই ছোট্ট গাছ থেকে কিছু স্মৃতির কুঁড়ি নিয়ে গাঁথা শুরু করি আমার হৃদয়ের রক্তেভেজা আখরের মালাখানি।
১৯৭২। এখন মাসটি মনে করতে পারছি না। খুব সম্ভবত জুলাই কী আগস্ট মাস। আমি তখন ছোট্ট রাসেলকে পড়াতে যেতাম ‘গণভবনে’। আজ ঐ ‘গণভবনের’ নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘সুগন্ধ্যা’। এটা পড়া শুরুর প্রথম দিকের কথা। ওখানে বেশিদিন পড়াই নি। মনে হয় এক মাসের মতো বা কিছু বেশি হবে। এরপরে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতেই পড়াতে যেতাম। তখন কী জন্যে যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল, আজকে মনে পড়ছে না। সে যা-ই হোক, সে সময়টাতে সকাল নয়টা, কী দশটার দিকে পড়াতে যেতাম।
প্রথম দিনে খুব বেশি পড়াই নি। রাসেল কতটুকু জানে, ওকে কোথা থেকে শুরু করতে হবে, এসবেরই খোঁজ নেবার চেষ্টা করলাম। বুঝলাম, আমাকে আদি থেকেই শুরু করতে হবে। রাসেল তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ছে। কয়েক মাস পরেই ওর বার্ষিক পরীক্ষা। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টু-এ উঠবে। সবকিছু, আমাকে বেশ তাড়াতাড়ি শেখাতে হবে। ওকে আ কার-ই কার থেকে শুরু করে অ ই ঈ উ সব শেখাতে হবে। সেদিনের মতো পাঠ শেষ করে, রাসেলকে বাসার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় পড়া দিয়ে চলে এলাম। আমাকে ওদের গাড়িতেই বাসায় পৌঁছে দিল। গাড়ির যিনি ড্রাইভার ছিল, তার আসল নামটি কী ছিল আমি জানি না।
তাকে সকলে ‘মুন্সী’ নামেই ডাকতো। শুনেছি, সে অনেক পুরনো ড্রাইভার এবং খুব বিশ্বস্ত। শেখ রেহানার জন্মের আগে অথবা জন্মের সময় থেকেই মুন্সী ভাই এ-বাড়িতে গাড়ি চালাচ্ছে। সেদিন গাড়ির ভেতরেই মুন্সী ভাই আমায় কিছু প্রশ্ন করেছিল। যেমন : রাসেল পড়েছে কি না? কেউ আমার সাথে দেখা করেছে কি না? রাসেল আমাকে কিছু বলেছে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার সব প্রশ্নের উত্তর ছিলÑ “না।” “আজ তো প্রথম দিন, তাই, পড়ানো হয়নি তেমন। তবে যা যা রাসেলকে করতে বলেছি ও তাই করেছে। আজ সামান্য পড়েছে মাত্র।” মুন্সী ভাই হেসে বলল, “তাই? আপনারে পছন্দ হইছে তাইলে।” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এর মানে কী ড্রাইভার সাহেব?” প্রথম ক’দিন ড্রাইভার সাহেবই বলেছি। পরে মুন্সী ভাই ডেকেছি।
: না ও কিছু না। রাসেল ভাইয়া পড়াশুনা করতে পছন্দ করে না কি না, তাই জিজ্ঞাসা করলাম আপা। আপনি তো কইলেন পড়ছে। ভালো লাগলো শুইন্যা। এরপর তিন-চার দিন কেটে গেল, মুন্সী ভাইয়ের সেই একই প্রশ্ন-
: আইজ রাসেল পড়ছে আপা?
: আজ তিন-চার দিন আসছি ও তো কম হলেও পড়েছে। এ-কথা শুনে মুন্সী ভাই একটু হেসে বলল,
: আম্মার (রাসেলের মা) সাথে দেখা হইছে আপনার?
: না, এখনো দেখা হয় নাই।
: আম্মা মনে হয় লজ্জায় আপনার সাথে দেখা করতেছে না।
: কেন? লজ্জা কেন হবে? প্রথম দিন তো ওনার সাথেই কথা হলো।
: মুন্সী ভাই হেসে বলল, রাসেল ভাইয়ের কোনো টিচারই তো পছন্দ হয় না। একদিন দুইদিন পড়ার পর, “এই টিচার পছন্দ না” কইয়া, আসতে মানা কইরা দেয়। ভাইয়ার যে কত টিচার আসলো আর গেল! টিভি’তে একজনকে পছন্দ হইছে, তার কাছে সে পড়বে কইলো, তারে বাসায় আনলো, তার কাছে দুই-তিন দিন পড়ল ব্যাস, তারে পছন্দ না, কইয়া বিদায় করলো। এই রকম অনেককে করছে। তাই আম্মা হয়তো আপনার সাথে দেখা করে না। আপনারে আবার রাসেল ভাই কি কইয়া দেয়!
: আমাকে এখনো কিছু বলে নাই ড্রাইভার সাহেব।
এভাবে প্রতিদিন ড্রাইভার সাহেবের সাথে কথা হতো। মুন্সী ভাই-ই আমাকে রোজ প্রশ্ন করতো।
রাসেলকে পড়াতে মুন্সী ভাইয়ের এ-কথাগুলো পরবর্তীতে আমায় খুব সাহায্য করেছিল। আমি রাসেলকে অতি সহজেই বুঝতে পেরেছিলাম। ওকে পড়ানোর ন’দিনের মধ্যে মজার মজার বেশ ক’টি ঘটনা রয়েছে। আমি এখানে দু-একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি।
ওই সময় রাসেল এক/দুই-এর সাথে পরিচিত ছিল না। তাই ওকে এক/দুই শেখাচ্ছি। তার এই এক/দুই-এর একশ পর্যন্ত সংখ্যা শিখতে মাত্র একটি দিন সময় লেগেছে। তাকে দুটো জিনিস আমি বলেছিলাম : ১. এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যার ছবি খেয়াল করে পড়ো ও দেখো এবং কোন সংখ্যার পর কোনটা রয়েছে তা মন দিয়ে দেখে নাও; ২. ‘ঊন’ শব্দটি মনে রাখো। এটা ছিল একটি খেলার মতো। ও দারুণ মজা পাচ্ছিল, সেটা আমি বুঝতে পারলাম। সুতরাং এই সুযোগটা কাজে লাগালাম। অল্প সময়ের মধ্যে সে শিখে নিল। পরের দিন সামান্য ভুল করলো; কিন্তু সেদিনই শিখে গেল সবটা। এরপর আর লিখতে ও পড়তে ভুল হয়নি। এবার অংক শেখাবার পালা।
প্রথমে হাতের আঙ্গুলের কর গুনতে শেখাতে শুরু করি। ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুলে যখন রাসেল কর গুনতো, আমার তা দেখতে খুব ভালো লাগতো। সে দারুণভাবে মনোযোগ দিয়ে গুনতো। তার ভ্রু যুগল থাকতো কুঁচকে আর চোখ থাকতো ছোট্ট আঙ্গুলগুলোর দিকে। ঐ চেহারাটা আমায় খুব আনন্দ দিতো বলে, আমি ওর কর গোনার সময় বলতাম-
: এ হে, আবার গোনো তো, আমি দেখতে পাইনি। ভুল হলো কি না বুঝতে পারলাম না। আবার গোনো।
: খেপে গিয়ে বলতো, আপনি অন্যদিকে ফিরা থাকেন ক্যান? একবারে দেখেন না ক্যান? এ-কথা বলে কখনো গুনতো, কখনো আবার স্বভাব চেতনায় বলে বসতো, আর গুনবো না, আপনি দ্যাখেন নাই ক্যান! এই শেষ কথাতেও আমি বেশ মজাই পেতাম।
কর গোনাটা শেখার পর খুব ছোট্ট ছোট্ট সংখ্যা দিয়ে যোগ শেখাতে শুরু করি। যেমন : ২ + ১ = কত? ২ + ২ = কত? এমনি সব। এই অংক শেখাতে গিয়ে আমি খেয়াল করলাম, ও অংক খুব একটা পছন্দ করছে না। যা হোক, পড়া শেষে অপছন্দকে মাথায় নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরে এলাম।
পরের দিন পড়তে বসেই বলে দিল রাসেল, “আইজ আর অংক করবো না।”
আমার উত্তর ছিল, “কেন করবে না?”
: ভালো লাগে না।
: অংক তো আগে শিখতে হবে, পরীক্ষা তো এসে গেল, পাস করতে হবে তো।
সে কিছুতেই অংক করতে রাজি হলো না। অগত্যা আমাকে অন্য পড়ায় যেতে হলো। কিন্তু আমার মাথায় অংকটা রয়ে গেল। বেশকিছু সময় কাটিয়ে ওর পেন্সিল বক্সটা বের করে নিলাম। সেই বক্সে সাধারণ পেন্সিলের সাথে অনেকগুলো নানা রঙের পেন্সিল।
পেন্সিলগুলো দেখে আমার মাথা কাজ করতে শুরু করে দিল। মনে মনে খুশি হলাম। বললাম, “তোমার এতগুলো পেন্সিল?” রাসেল মাথা নাড়ল। হাতে পেন্সিলগুলো নিয়ে আমি গুনতে শুরু করলাম। আমাকে গুনতে দেখে ও নিজেই গুনতে চাইল। এটাই তো আমি চেয়েছিলাম। এবার ওকে অংক শেখাতে পারব। ঠিক তাই হলো। ঐদিন সে যোগ অংকটা শিখে গেল। মনে মনে দারুণ খুশি হলাম। আমার কাজ শেষ অথচ ও কিছুই টের পেল না।
এ ক’দিনে ও খানিকটা আমার কাছে এসে গেছে বলে আমার মনে হচ্ছিল। আমি বেশ খুশি। ভাবলাম সবকিছু ঠিকঠাক।
এক সপ্তাহ পার হয়েছে, কিন্তু কতদিন সে হিসাবটা আমার ছিল না। পড়াচ্ছি পড়াচ্ছি হঠাৎ করে রাসেল আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আইজ আপনার কয় দিন?” আমি চমকে উঠলাম! সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো মুন্সী ভাইয়ের কথা, ভাবলাম, আজ আমার হয়তো শেষদিন। রাসেলকে বললাম, “কেন? আমি তো গুনে রাখিনি।”
একটুখানি হাসি দিয়ে বলল, “আইজ আপনার নয় দিন। আমারে যে সব চাইতে বেশি পড়াইছে, তার ছিল সাত দিন। আপনার আইজ নয় দিন।” মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, সে-সাথে ভাবলাম, আজকেই শেষ হবে এ খেলা! সুতরাং, শেষবেলার চেষ্টা করতে হবে এখন আমাকে। রাসেল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে বললাম, “তোমার পরীক্ষাটা শেষ হয়ে গেলে আমি আর আসবো না।” খানিকটা যেন চমকে উঠল রাসেল! ভ্রু দুটো কুঁচকে বলে উঠল, “আপনি আর আসবেন না?” আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলাম, “না, আসবো না তো! তবে, আমি আবার নতুন করে আসবো।”
সে ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিল, “ক্যান আসবেন? আপনি তো পুরান!”
: বা রে! তুমি নূতন ক্লাসে উঠবে, নূতন বই কিনবে, আমি নূতন করে আবার আসবো। তোমার নতুন বইগুলোর সাথে পরিচয় করবো, তাহলে কি হলো বলো? আমার আবার নতুন করে আসা হলো না?
রাসেলের মুখে সুন্দর একখানা হাসি ফুটে উঠল। আমি থাকি আর না-ই থাকি, সে-মূহূর্তে দারুণভাবে উপভোগ করলাম সেই মিষ্টি হাসিখানা। ও যে শিশু ভোলানাথ! এসব যখন মনে হয় খুব কষ্ট হয় আমার।
চোখ দুটো বড্ড অবাধ্য হয়ে ওঠে। মনে হয় বুঁচু (পরবর্তী সময়ে আমি রাসেলকে আদর করে ‘বুঁচু’ নামেই ডাকতাম) আমার সামনে রয়েছে, হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারব।
: তাইলে পরীক্ষা পর্যন্ত আসবেন?
আমি মাথা নেড়ে বুঝালাম, হ্যাঁ তাই।
: পরীক্ষা শ্যাষ হইলে আর আসবেন না?
: পরীক্ষা শেষে তুমি যা খুশি করতে পারবে। আমি আসবো না। তবে তুমি যদি চাও, আমাকে ফোন করলে আসবো।
রাসেল ওর খাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললÑ
: আপনার ফোন নম্বরটা এইখানে লেইখ্যা দ্যান।
আমি তাই করলাম। বলাবাহুল্য, শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে এসেই আমাকে ফোন করে এবং ঐদিনই আমাকে পড়াতে যেতে বলে।
ওই নয় দিনের মাঝেই আর একদিনের ঘটনা এখন বলছি। এ-সময়ের দিনগুলো ছিল আমার কাছে পরীক্ষামূলক। আমাকে রাগাবার বা খ্যাপাবার জন্য প্রতিদিন একটা-না-একটা কৌশল খুঁজে নিত।
এই নয় দিনের মাঝে একদিন সে রাগ করে পড়ার মাঝখানে ওর সমস্ত বই-খাতা-রাবার-পেন্সিল সব, সব মাটিতে ফেলে দিল। সমস্ত ঘরময় বই-খাতা-পেন্সিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। যেভাবে জিনিসগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তা দেখলে যে কেউ রাগ করবে। আমিও প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। রাসেল এ কাজটি ক’রে, টেবিলের ওপর আর যা ছিল সেগুলো দু-হাতে আমার দিকে ঠেলে দিয়ে তার কনুই দুটো টেবিলের উপর রেখে, ছোট্ট ছোট্ট দু-খানা হাত দু-গালে লাগিয়ে বসে থাকল। মুখে প্রচ- রাগ। আমি একেবারে চুপ। আমার চোখে-মুখে কোনো রাগ বা বিরক্তির চিহ্ন ছিল না। রাসেল এভাবে রাগ করে বসে আছে, অপরদিকে আমিও উদাসীনভাবে আছি। মনে হচ্ছে কিচ্ছুটি হয়নি। এভাবে, দুজনের বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। কারও মুখে কোনো কথা নেই। দুজনেই চুপ। আমি আর ওর দিকে তাকাচ্ছি না, কিন্তু বুঝতে পারছি, রাসেলের চোখ আমার দিকেই। সে আমাকে খুব করে খেয়াল করছে। কিন্তু কেন এমন করে দেখছে তা বুঝতে পারছি না। আর কতক্ষণ এভাবে থাকা যায়? হঠাৎ করে খুব বিরক্তির সুরে বলে উঠল রাসেল :
“আমি যে বই খাতা সব ফেলাইয়া দিলাম, এতে আপনার রাগ হয় নাই?”
মাথা নেড়ে বললাম “না।”
: ক্যান রাগ হয় নাই?
: বইগুলো তো আমার না। তোমার বই তুমি ফেলেছ, আমি রাগ করব কেন?
এ উত্তরটি রাসেল আশা করেনি। মনে হচ্ছিল, এ উত্তরে সে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। ভ্রু যুগল কুঁচকে বলল,
: রাগ হন, আপনি রাগ হন!
: বারে, আমি রাগ করব কেন? এ-কথা বলে আমি একটু হাসলাম।
: আপনি রাগ হবেন না?
: না।
: রাগ হবেন না ক্যান?
: বইগুলো তো আমার না, তাই আমার রাগও হবে না। এ-কথাগুলো মুখে ঠিকই বলছি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে চিন্তাও হচ্ছিল বেশ। এ খেলার শেষ কি হবে তা ভেবে।
: ভ্রু কুঁচকেই বললে, এই বইগুলা কে উঠাবে?
: যার বই সে-ই উঠাবে।
: মাথা নেড়ে বলল, আমি তো উঠাব না।
: আমিও উঠাব না। এভাবেই মাটিতে পড়ে থাকবে।
চোখে-মুখে তার চিন্তার ছাপ! হয়তো ভাবছে কী বিপদ! এ-সময়টা আমি খুবই উপভোগ করছিলাম। আমার বুঁচু ছোট্ট বাচ্চা বই তো আর কিছুই নয়! তাই ভাবনাটা শিশুর মতোই বইকি? সঙ্গে সঙ্গে সে বলে উঠলÑ
: বইগুলো না উঠালে কী হবে?
: আমি খুব শান্তভাবে সুর দিয়ে দিয়ে বললাম, এগুলো না উঠালে বিদ্যা হবে না, বুদ্ধি হবে না, বোকা হয়ে থাকতে হবে।
একটু ভেবে নিয়ে, আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে মেঝেতে নামলো, মেঝেতে উপুড় হয়ে বসে, বই-খাতা-পেন্সিল-রাবার একটা একটা করে অনিচ্ছার সাথে গুছিয়ে, টেবিলের উপর আমার সামনে ওগুলো সব ধপ্ করে রেখে বললÑ
: এই ন্যান আপনার বই-খাতা!
: গুড বয়, বলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে চেষ্টা করলাম, ও ঝট্ করে মাথাটা সরিয়ে নিল। আদর করতে পারলাম না।
শেষে আমি বই-খাতা সব গুছিয়ে ওর ব্যাগে ভরে রেখে দিলাম। এ নাটক যত তাড়াতাড়ি লিখে শেষ করলাম, সেদিন কিন্তু এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়নি। এ নাটক শেষ হতে বেশ সময় নিয়েছিল। এ নাটক শেষ হতে সময় নিয়েছিল বলে আমাকে এর পরেই ফিরে আসতে হয়েছিল।
আসার সময় ফরিদ (রাসেলদের কাজের ছেলে) আমাকে জিজ্ঞেস করল-
: আপা, রাসেল ভাইয়া কি আপনার উপর রাগ করছে? দেখলাম বই-খাতা সব সারা ঘরে ছড়ানো।
: ও কিছু না। ফরিদকে আর কিছু বললাম না।
: আবার দ্যাখলাম রাসেল ভাইয়াই সব কিছু গুছাইলো।
অবাক হয়েই কথাগুলো বলেছিল ফরিদ।
: হ্যাঁ, রাসেলই গুছিয়েছে সব।
( চলমান……. পরবর্তী অংশ আগামীকাল)
লেখক : ১৯৭২ থেকে ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত রাসেলের গৃহশিক্ষিকা; তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। পরে অধ্যাপনা করে অবসর নিয়েছেন। এখন সিডনি প্রবাসী।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..