প্রকাশিত : রবিবার, ৯ই আগস্ট ২০২০ইং ।। ২৫শে শ্রাবণ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।।
বিক্রমপুর খবর : অফিস ডেস্ক : আজ বিক্রমপুরের কৃতি সন্তান বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী লায়লা হাসানের ৭৪ তম জন্মদিন। লায়লা হাসান একজন বাংলাদেশি কোরিওগ্রাফার, নৃত্যশিল্পী এবং অভিনেত্রী। বাংলাদেশ সরকার শিল্পক্ষেত্রে তার অবদানের কথা চিন্তা করে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করেন।
লায়লা হাসান এর বাবা মায়ের রাখা নাম লায়লা নার্গিস রোজী। ১৯৪৭ সালের ৮ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে নানা খানবাহাদুর আলি আহমেদ খানের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মায়ের নাম লতিফা খান, বাবার নাম এম এ আউয়াল।
লায়লা হাসান এর গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরের টঙ্গিবাড়ি উপজেলায় বেশনাল গ্রামে।তিনি অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন এর কেন্দ্রীয় পর্ষদের সহ সভাপতি।
বাবা কোয়াপারেটিভ কলেজের ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। মা ছিলেন কাস্টমস এর কর্মকর্তা। এম এ আউয়াল অবসরে বাঁশি বাজাতেন, আর লতিফা খান সেতার।
লায়লা নার্গিস এর ছোটবেলা কাটে ঢাকার টিকাটুলি এলাকায়। একটু বড় হবার পর মায়ের বদলির চাকরির কারণে নানা, নানি, মামা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ খান সরোয়ার মুরশিদ, মামি রাজনীতিবিদ নুরজাহান মুরশিদ, মামাতো ভাই বোনের যৌথ পরিবারে বড় হন তিনি।
তখন পুরো টিকাটুলি পাড়াটির ছিল এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ওখানে থাকতেন সুফিয়া কামাল, মোদাম্বের হোসেন, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখ। এসব মানুষদের সন্তানদের সাথে রামকৃষ্ণ মিশনে, গোলাপবাগে ফুল কুড়িয়ে শৈশব কাটে লায়লা নার্গিসের।
লায়লা নার্গিস রোজীর নৃত্যজীবন শুরু হয় মাত্র দু’বছর বয়সে। স্টেজে নাচলে দেখা যায় না বলে আরেকটা টেবিল এনে তার ওপরে দাঁড় করিয়ে দেয়া হতো। সেই থেকেই শুরু। বিদ্যালয় জীবন শুরু করেন নারীশিক্ষা মন্দিরে, পরবর্তীকালে কামরুন্নেসা স্কুলে।
নাচ শিখতেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে। সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজের পর ভর্তি হন বেগম বদরুন্নেসা কলেজে। সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। তবে পড়াশুনার সাথে নাচ চলেছে একই ছন্দে। চলেছে রেডিও নাটকে অভিনয়।
১৯৬৫ সালে চলচ্চিত্রের নায়ক সৈয়দ হাসান ইমামকে বিয়ে করেন লায়লা। শুরু হয় এক ছন্দবদ্ধ যুগলবন্দীর। লায়লা নার্গিস হয়ে যান সবার প্রিয় লায়লা হাসান।
নতুন পরিবারের অনুপ্রেরণায় গতিময় হয় সংস্কৃতির সঙ্গে পথচলা। একে একে কোল জুড়ে আসে ৩টি সন্তান। কিন্তু সন্তান, শ্বাশুড়ি, স্বামীসহ যৌথ পরিবারের বহু কাজের মাঝেও নাচের মহড়া, টিভি নাটক, এমনকি কিছুদিন মঞ্চ নাটকও চলতে থাকে। সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়েও বিদেশে গিয়েছেন বহুবার।
খেলাঘল কেন্দ্রীয় প্রেসিডায়াম সদস্য। ষাটের দশকে আইয়ুব খান যখন রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপন নিষিদ্ধ করলো খেলাঘর ৩দিনের রবীন্দ্র জয়ন্তী করার সিদ্ধান্ত নিল।কিন্তু রিহার্সাল করার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না।নিজের বাড়িতে রিহার্সালের ব্যবস্থা করলেন সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসান।সেই থেকে আজ পর্যন্ত খেলাঘরকে আগলে রেখেছেন লায়লা হাসান।৯২সালে যখন খেলাঘর এর উপর আঘাত আসে পর্বতের ন্যায় শক্ত ভাবে হাল।আজও ছুটে চলেছেন-কোন শাখা বা আসরের ডাকেও নিরাশ করেন না।সারা দেশের লক্ষ খেলাঘরের কর্মীদের অনুপ্রেরণার আরেক নামলায়লা হাসান।
অগণিত সংগঠনের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি ও পুরস্কার পেয়েছেন লায়লা হাসান। একুশে পদক প্রাপ্তি এনে দেয় রাষ্ট্রীয় সম্মান। একুশে পদকে প্রাপ্ত সব অর্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্য বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কার্যক্রমে দান করেন।
নানা সংগঠনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বর্তমানে নিজেই চালাচ্ছেন নটরাজ নামে একটি নৃত্য শেখার সংগঠন। এছাড়াও নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
প্রতিষ্ঠা কাল থেকেই জাতীয় নবান্ন উৎসব উদযাপণ পর্ষদের কর্ণধার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন এই গুণী শিল্পী।
লায়লা হাসান প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মণিবর্ধন মহাশয়, অজিত সান্যাল, বাবু রাম সিংহ, জিএ মান্নান এবং বাফার শমর ভট্টাচার্য্য প্রমুখ খ্যাতিমান নৃত্য শিক্ষা গুরুর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৮০-৮৫ কালপর্বে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত টেলিভিশন অনুষ্ঠান “রুমঝুম” এর জনপ্রিয় উপস্থাপিকা ছিলেন। ঐ অনুষ্ঠান থেকেই বর্তমানের জনপ্রিয় তারকা ঈশিতা, তারিন, শ্রাবন্তী, রিয়া এবং রিচির মতো খ্যাতিমান শিল্পীরা উঠে আসে।
লায়লা হাসান বেশ কিছু সংখ্যক থিয়েটার, টেলিভিশন নাটক, চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। কঙ্কাবতীর ঘাটে, রক্তকরবী, ছুটি, মায়ার খেলা, রাজা রাণী, তাসের দেশ, স্বর্গ হতে বিদায়, শ্যামল মাটির ধরাতলে, নীল দর্পন, দত্ত, কেরানির জীবন, টেমিং অব দ্য শ্রু এবং নকশী কাথার মাঠ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি অনুষ্ঠান করেছেন।
তার টিভি নাটকগুলো হল মন পবনের নাও, কাজল রেখা, ভেলুয়া সুন্দরী, মহুয়া, রাণী ভবানীর পথ, রত্নদ্বীপ, পাশাপাশি এবং আশ্চর্য এক রাতের গল্প। তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো হল ঘরে বাইরে, এইতো প্রেম, ডনগিরি ইত্যাদি।
তিনি নৃত্যসংঘ “নটরাজ” প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৯০ সালে। ১৯৯৬ সালে নটরাজ থিয়েটার এবং নাঈম হাসান সুয়জার সাথে মঞ্চনাটক করতে শুরু করে। লায়লা হাসান নটরাজের সভাপতি এবং সুজা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।
লায়লা হাসান বাংলা একাডেমি এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল ডান্স ফেডারেশনের আজীবন সদস্য। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য এবং বাংলাদেশ নৃত্য শিল্পী সংঘের সভাপতি।
তিনি নৃত্যবিষয়ক হৃদয়ে বাজে নূপুর (১৯৯৬) এবং চারুকলা বিষয়ে মোহনরূপে গ্রন্থ রচনা করেন।
লায়লা হাসান হাসান ইমামের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।লায়লা হাসানের মোট ছয় ভাইবোন রয়েছে। অভিনেত্রী ডেইজি আহমেদ তার এক বোন।
নিজ কর্মের স্বীকৃতি স্বরুপ লায়লা হাসান জীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হলো, বাচসাস পুরস্কার (২০০১), কাজী মাহবুব উল্লাহ বেগম জেবুন্নেচ্ছা ট্রাস্ট পুরস্কার (২০০১) এবং একুশে পদক (২০১০) ইত্যাদি।
যখন একুশে পদকে সম্মানিত হন লায়লা হাসান। তখন তাঁর মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্য বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ থাকা উচিত। প্রস্তাবটি নিয়ে দেখা করেন তৎকালীন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকীর সাথে। সম্মানিত উপাচার্য এবং তৎকালীন বিভাগীয় চেয়ারম্যান ইসরাফিল শাহীনের সহযোগিতায় নানা কাগজপত্র সংগ্রহ, সিলেবাস তৈরি, শিক্ষক নিয়োগ সকল বিষয়েই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন লায়লা হাসান আরো অনেক নৃত্যশিল্পীকে সাথে নিয়ে। অবশেষে প্রতিষ্ঠিত হয় নৃত্য বিভাগ। এ যেন লায়লা হাসানের স্বপ্নপূরণ।
আজকে খ্যাতিমান নৃত্য শিল্পী ও কোরিওগ্রাফার এবং দক্ষ অভিনেত্রী লায়লা হাসান এর চুরাত্তরতম জয়ন্তীতে গভীর শ্রদ্ধা ও অফুরুন্ত ভালোবাসা।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..