প্রকাশিত : সোমবার, ২০ মে ২০২৪ ইংরেজি, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ বাংলা (গ্রীষ্ম কাল), ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরি ।
বিক্রমপুর খবর :অনলাইন ডেস্ক : হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পর ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি সোমবার মৃত বলে নিশ্চিত হয়েছে দেশটি। অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল তার বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটি কুয়াশায় ঢাকা পশ্চিম পর্বত অঞ্চলে খুঁজে পায়। এতে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ইরানে চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি পাঁচ দিনের শোক ঘোষণা করেছেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবারকে (৬৮) ৫০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী দায়িত্ব দিয়েছেন।
এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সরকারের মুখপাত্র আলী বাহাদোরি জাহরোমি বলেছেন, ইরানের শীর্ষ পরমাণু আলোচক আলী বাগেরিকে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর আগে রাষ্ট্রীয় টিভি ঘোষণা করে, ‘ইরানি জাতির সেবক, আয়াতুল্লাহ ইব্রাহিম রাইসি, শাহাদাতের সর্বোচ্চ স্তর অর্জন করেছেন।’ এ সময় কোরআন তেলাওয়াতের সঙ্গে রাইসির ছবি সম্প্রচার করা হয়। পাশাপাশি তেহরানের দক্ষিণে কোম শহরে একটি প্রধান শিয়া মাজারে শোকের চিহ্ন হিসেবে একটি কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
অতি রক্ষণশীল রাইসি (৬৩) ২০২১ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় ব্যাপক বিক্ষোভ ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে আরো গভীর অর্থনৈতিক সংকট এবং চিরশত্রু ইসরায়েলের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষ দেখেছে দেশটি। এদিকে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়ায় সবাই রাইসির এমন মৃত্যুতে শোকাহত। গাজা যুদ্ধ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের উচ্চ উত্তেজনার সময় ইসরায়েল ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে তথাকথিত প্রতিরোধের অক্ষের সব সদস্য শোক জানিয়েছে।
খামেনি রবিবার ইরানিদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, যেহেতু অনুসন্ধান এখনো চলমান ছিল, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্ব সম্পর্কে ‘চিন্তা না করার’ জন্য। ‘দেশের কাজে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না’ বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি। রাইসির সঙ্গে নিহত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান, যিনি তার উগ্র ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব এবং পশ্চিমের সন্দেহের জন্য পরিচিত। তাদের দুজনের সঙ্গে পাইলট, দেহরক্ষী এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্মকর্তাসহ আরো সাতজন নিহত হন।
কুয়াশা ও বৃষ্টি
ইরানি কর্তৃপক্ষ রবিবার বিকেলে প্রথম সতর্কতা উত্থাপন করে, যখন পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের জোলফা অঞ্চলের কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ি এলাকা দিয়ে ওড়ার সময় রাইসির হেলিকপ্টারটির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।
রাইসি এর আগে একটি বাঁধ প্রকল্পের উদ্বোধন করতে সীমান্তে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ফিরতি যাত্রায় রাইসির বহরের তিনটি হেলিকপ্টারের মধ্যে দুটি তাবরিজ শহরে অবতরণ করে। কিন্তু একটি হেলিকপ্টার নিখোঁজ হওয়ায় ব্যাপক অনুসন্ধান ও উদ্ধার প্রচেষ্টা শুরু হয়। একাধিক বিদেশি সরকার শিগগিরই সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ ওয়াহিদি প্রথমে একটি ‘হার্ড ল্যান্ডিং’-এর কথা বলেছিলেন এবং নাগরিকদের প্রতিকূল বিদেশি গণমাধ্যমগুলোকে উপেক্ষা করার এবং ‘শুধু রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে’ অনুসরণের আহ্বান জানান।
রেড ক্রিসেন্টের দলগুলো কুয়াশা ও বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সেনা সদস্য, বিপ্লবী গার্ড এবং পুলিশ সদস্যরা অনুসন্ধানে যোগ দেন। এ সময় জরুরি পরিষেবার গাড়ির সারি কাছাকাছি অপেক্ষা করছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া জাতিজুড়ে নিখোঁজদের জন্য প্রার্থনা শুরু হয়, যার মধ্যে রয়েছে রাইসির নিজ শহর মাশহাদের মাজার শহর।
পরে সোমবার সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকারকর্মীরা জানান, তারা ৯ জন আরোহী নিয়ে ধ্বংস হওয়া হেলিকপ্টারটি খুঁজে পেয়েছেন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল আইআরআইবি অনলাইনে জানায়, হেলিকপ্টারটি ‘একটি পাহাড়ে আঘাত করে এবং বিধ্বস্ত হয়’। এর পরই ইরানের রেড ক্রিসেন্টের প্রধান পিরহোসেইন কুলিভান্দ নিশ্চিত করেন, তাদের কর্মীরা ‘শহীদদের মরদেহ তাবরিজে স্থানান্তর করছেন’ এবং ‘অনুসন্ধান অভিযান শেষ হয়েছে’।
তেহরানের বাসিন্দা ৬৩ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত নবী করম বলেন, ‘আমরা যখন খবরটি জানতে পেরেছিলাম তখন আমরা খুব দুঃখিত হয়েছিলাম। আমাদের প্রেসিডেন্ট খুব ভালো নেতা ছিলেন, সৃষ্টিকর্তা তাকে আশীর্বাদ করুন।’
‘অক্লান্ত আত্মা’
অন্যদিকে ইরানের মন্ত্রিসভা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সরকারের কাজ ‘কোনো ব্যাঘাত ছাড়াই’ চলবে। তারা বলে, ‘আমরা অনুগত জাতিকে আশ্বস্ত করছি যে আয়াতুল্লাহ রাইসির অক্লান্ত চেতনার সঙ্গে সেবার পথ অব্যাহত থাকবে।’
৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে গাজা যুদ্ধ নিয়ে উচ্চ আঞ্চলিক উত্তেজনার সময় অন্যান্য দেশ রাইসির হেলিকপ্টারের অনুসন্ধানটি ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করছে। চীন, ইরাক, কুয়েত, কাতার, রাশিয়া, সৌদি আরব, সিরিয়া, তুরস্কসহ দেশগুলো থেকে উদ্বেগের প্রকাশ এবং সাহায্যের প্রস্তাবগুলো দ্রুতই আসে। পরে তারা শোক প্রকাশ করে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেও অনুসন্ধান সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল। একজন মার্কিন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছিলেন। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনুসন্ধান প্রচেষ্টায় সহায়তার জন্য দ্রুত প্রতিক্রিয়া ম্যাপিং পরিষেবা সক্রিয় করেছিল।
২০২১ সালে এমন সময়ে রাইসি মধ্যপন্থী হাসান রুহানির স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন, যখন ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ ছাড়া নারীদের জন্য কঠোর পোশাকের নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর ইরান-কুর্দি মাহসা আমিনির পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর কারণে ইরানে ২০২২ সালে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা যায়। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান ও সৌদি আরব একটি আশ্চর্য চুক্তি স্বাক্ষর করে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করে।
মধ্যপ্রাচ্যে গাজা যুদ্ধের কারণে উত্তেজনা বেড়েছে এবং একের পর এক ধারাবাহিক উত্তেজনার ফলে তেহরান এই বছরের এপ্রিলে সরাসরি ইসরায়েলে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট নিক্ষেপ করেছে। রাইসির মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে একটি বক্তৃতায় তিনি ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইরানের সমর্থনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে দেশটির পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দু হলো ফিলিস্তিনি ইস্যু।।
রাইসি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, ফিলিস্তিন মুসলিম বিশ্বের প্রথম সমস্যা।’ হামাস রাইসিকে একজন ‘সম্মানিত সমর্থক’ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে। হিজবুল্লাহ তাকে ‘প্রতিরোধ আন্দোলনের একজন রক্ষক’ হিসেবে শোক প্রকাশ করেছে এবং ইয়েমেনের হুতিরা তার মৃত্যুকে ‘সমগ্র মুসলিমবিশ্ব, ফিলিস্তিন ও গাজার জন্য’ ক্ষতি বলে ঘোষণা করেছে। সূত্র : এএফপি