প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার,২৯ অক্টোবর ২০২০ইং ।।১৩ই কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)।। ১১ই রবিউল আউয়াল,১৪৪২ হিজরী।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : প্রতিবছর রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখ বিপুল উৎসাহে মিলাদ মাহফিল উদযাপন করা হয়। যেন মিলাদুন্নবীর উৎসব পালন করা নেকির কাজ। অথচ এই মিলাদের কথা কুরআন ও সহীহ হাদীস এবং ফিকাহ শাস্ত্রের কোনটিতেই নেই। মোট কথা, খোলাফায়ে রাশিদীনের ৩০ বছর, সাহাবীগণের ১২০ বছর, তাবিঈদের ১৭০ বছর এবং প্রায় তাবে-তাবিঈগণের প্রায় ২০০ বছরকাল পর্যন্ত এই মিলাদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
অথচ দুনিয়ার বুকে প্রকৃত নবীপ্রেমের উজ্জ্বল নিদর্শন তারাই রেখে গেছেন। যে কাজ শ্রেষ্ঠ যুগে উত্তম ও নেকির কাজরূপে কোনো সময় পালিত হয়নি, তা আজ কী রূপে অসীম বরকতরূপে গণ্য হতে পারে? তাই এই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা হলো-
মিলাদ ও মিলাদুন্নবী এর অর্থ-
আরবী মিলাদ শব্দের অর্থ জন্মের সময়, জন্মকাল, জন্ম তারিখ, জন্মদিন। (আলকামুস- ১/২১৫, মিসবাহুল লুগাত- ৯৫৪ পৃ)
ঈদে মিলাদুন্নবী অর্থ হচ্ছে নবী (সা.) এর জন্ম দিনের উৎসব যা বর্তমানে ১২ রবিউল আওয়াল মাসে নবী (সা.) এর জন্মের আনন্দোৎসব দিবস বলে জোর প্রচার ও পালন করা হচ্ছে।
মিলাদুন্নবীর সূচনা ইতিহাস-
নবী (সা.) এর সময়, খোলাফায়ে রাশিদিনের সময় এবং উমাইয়া খলিফাদের সময়ে ঈদে মিলাদুন্নবী উৎসব ছিল না। আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে বাদশা হারুনুর রশীদের মাতা খায়জুরান বিবি (১৭৩ হিজরী) মদীনা শরীফে নবী (সা.) এর রওজা মোবারক জিয়ারত করার ও সেখানে দরূদ ও দু’আ পাঠ করার যে ব্যবস্থা রয়েছে, ঠিক সেভাবে নবী (সা.) মক্কায় যে ঘরে ভূমিষ্ট হয়েছিলেন, সেই ঘরটির জিয়ারত ও সেখানে দু’আ করার প্রথা সর্ব প্রথম চালু আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে বাদশা হারুনুর রশীদের মাতা খায়জুরান বিবি (১৭৩ হিজরী) করেন।
পরবর্তী কালে ১২ রবিউল আওয়ালে ঐ নারীর নেতৃত্বে র্তীথযাত্রীগণ প্রতি বছর নবী (সা.) এর জন্ম দিবস ধরে নিয়ে ঐ ঘরে আনন্দোৎসব পালন করেন। (ইবনে জারীর- ১১৪-১১৫পৃঃ)
অতঃপর হিজরী ৪০০ শতকে উবাঈদ নামে এক ইহুদী ইসলাম গ্রহণ করে তার নাম রাখে ওবায়দুল্লাহ। তিনি নিজেকে ফাতেমা রাঃ. এর বংশধর বলে দাবি করেন এবং মাহাদি উপাধি ধারণ করেন। এরই প্রপৌত্র (পৌত্রের ছেলে) মুয়ীযলি-দীনিল্লাহ ইহুদী ও খ্রিস্টানদের অনুকরণে ৫ রকম জন্মবার্ষিকী ইসলামে চালু করেন।
মিসরে ফাতেমী শিয়া শাসকরা মুসলিমদের মধ্যে জন্ম বার্ষিকী পালনের রীতি চালু করেন। মিসরে শিয়া খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা আবু মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ ইবনু মাইমুন জন্মসূত্রে প্রথমে ইহুদী ছিলেন। যেমন, তাদের ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ শিয়া ব্যক্তিত্ব হলেন আবদুল্লাহ বিন সাবা। সেও ইয়েমেনের একজন ইহুদী ছিলেন। ইসলাম গ্রহন করার পরও চিন্তা চেতনায় ইহুদী মতবাদ তাদের মাঝে বিদ্বমান ছিল। (আলহিদায়া ওয়ান নিহাইয়া- ১১/১৭২)
ইতিহাস থেকে জানা যায় মিসর সম্রাট ফেরাউন ইহুদীদের মাঝে জন্মবার্ষিকী রীতি প্রথম প্রচলনকারী, আর সে নিজেও একজন ইহুদী ছিলেন। ঐ ইহুদীর রীতি খ্রিষ্টানদের মধ্যে ইহুদীরাই প্রথম চালু করে। ফলে খ্রিষ্টানরা তাদের মধ্যে ঈসা (সা.) এর জন্মবার্ষিকী “ক্রিস মাস ডে” পালন করে থাকে।
মুসলিমদের মাঝে এই জন্মবার্ষিকী চালু হওয়ার পর আফজাল ইবনু আমিরুল জাইশ (৪৮৫-৫১৫) মিসরের ক্ষমতা দখল করে এই মীলাদুন-নবীসহ আরও ৫টি (আলী রাঃ., ফাতেমা রাঃ., হাসান রাঃ., হোসাইন রাঃ, জাইনুল আবেদীন রাঃ.) জন্মবার্ষিকির প্রথা বাতিল করে দেন। (আহসানউল কালাম ফি হায়াতি আমা-লিল আলাকু বিস সুন্নাতি ওয়াল বিদআতি -৪৪-৪৫ পৃঃ)
৫১৫ হিজরীতে শিয়া খলিফা আমির বিল আহ-কা-মিল্লা তা পুনরায় চালু করেন। পরবর্তীতে কুরআন সুন্নাহর অনুসারী গাজী সালাহউদ্দীন আইয়্যুবী (৫৩২-৫৮৭ হিজরী) ঈদে মিলাদুন্নবীসহ সকল জন্মবার্ষিকী উৎসব বন্ধ করে দেন।
৬০৪ হিজরীতে ইরবীলের শাসক আবু সাইদ মুজাফফর উদ্দীন কুকবরী আবার মিলাদুন্নবী প্রথা চালু করেন। তার এই মাহফিলে ফজর হতে জোহর পর্যন্ত সূফী নামদারী ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকত এবং এই মাহফিলে লক্ষ লক্ষ স্বর্ণ মুদ্রা খরচ করা হত। (মীর আতুজ জামান ফি তারীখিল আইয়্যম- ৮/৩১০)
স্পেনের অধিবাসী আবুল খাত্তাব উমার ইবনু হাসান ইবনু দিহইয়াহ বাদশাকে মিলাদ সম্পর্কীয় “কিতাবুল তানভীল ফি মাউলিদিস সীরা-জিল মুনির” নামে একটি কিতাব লিখে ১০০০ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা লাভ করার মাধ্যমে মিলাদুন্নবী পালনে উৎসাহিত করে। (আফাইয়াতুলআ’য়ান- ৩/১২২)
ভারতীয় উপমহাদেশে মিলাদুন্নবী প্রচলনকরীরা ছিল শিয়া সম্প্রদায়। ইসলামের মধ্যে মিলাদ, মিলাদুন্নবী প্রচলরকারী হল ফাতেমীয় শাসক শিয়া মুয়ীযলি দীনিল্লাহ, আর ভারত উপমহাদেশে মিলাদ প্রচলনকারী হলেন মোঘাল সম্রাট হুমায়ুন ও সম্রাট আকবরের মাতা ও অভিবাবক বৈরাম খাঁ । এরা দু‘জনেই কট্টর শিয়া ছিলেন।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাষ্ট্রদূত, শেষ সম্রাট বাহদুর শাহও ছিলেন শিয়া। মোট কথা সম্রাটদের মাধ্যমে এই উপমহাদেশে সুন্নীদের মাঝে মিলাদুন্নবীর প্রচলন হয়। ফলে শিয়া মতাদর্শী মিলাদ ও মিলাদুন্নবীর আনুসাঙ্গিক ব্যাপারগুলো সুন্নিদের মধ্যে প্রচলিত হয়। (শাইখ আইনুল বারী, মিলাদুন্নবী ও বিভিন্ন বার্ষিক- ৩৩ পৃ)
ইমামুল হিন্দ হযরত সরহিন্দী মুজাদ্দেদী আলফে সানী রাঃ. কে মিলাদ সমর্থক আলেমগণ জিজ্ঞাসা করেন, মিলাদ মাহফিল অনাচারমুক্ত হলেও তাতে দোষের কিছু আছে কি? উত্তরে তিনি বলেন আমি মনে করি যতক্ষণ পর্যন্ত এই উৎসবের দরজা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত স্বার্থপর লোকেরা এর থেকে বিরত থাকবে না। যদি এর কিঞ্চিত জায়েজ হওয়ার ফতোয়া দেওয়া হয় তাহলে আমি জানি না ব্যাপারটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। (মাকতুবাতে ইমাম রব্বানী, দপ্তর-৩, মাকতুব- ৭২)
প্রখ্যাত আলিম মাওলানা আঃ. রহীম হানাফী রাঃ. বলেন, মিলাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হলো, রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের ২০০ শত বছর পর এমন একজন বাদশা প্রচলন করেছে, যাকে ইতিহাসে ফাসিক বা পাপিষ্ঠ বলা হয়েছে। (সুন্নাত ও বিদআত- ২২৬ পৃ)
আল্লামা তাজুদ্দীন ফাকেহানী রাঃ. বলেন, মিলাদের এই প্রথা না কুরআনে আছে না হাদীসে আছে। আর না পূর্ববাসীদের থেকে বর্ণিত হয়েছে। বরং এটি একটি বিদআত কাজ। যাকে বাতিলপন্থি ও স্বার্থপরগোষ্ঠি সৃষ্টি করেছে। আর পেট পূজারীরা তা লালন করেছে। (বারাহীনে ক্বাত্বেআ- ১৬৪ পৃ)
এই প্রথা/রীতি খ্রিষ্টান ও হিন্দুদের থেকে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। খ্রিষ্টানজাতি প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বর ঈসা আঃ. এর জন্ম দিবস “ক্রিস মাস ডে” এবং হিন্দু জাতি প্রতি বছর ৮ ভাদ্র “শ্রী কৃষ্ণের জন্ম দিবস” উপলক্ষে জন্মাষ্টমী পালন করে থাকে।
খ্রিষ্টান ও হিন্দুরা এই উপলক্ষে জুলুস/মিছিলের আয়োজন করে থাকে। তেমনি ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী পালনকারীরা জুলুস/ মিছিলের আয়োজন করে থাকে। (মাহনামায়ে দারুল উলূম, এপ্রিল সংখ্যা- ১৯৯০) লেখক : মাওলানা আখতারুজ্জামান খালেদ, ইমাম ও খতীব
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’