প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৫মার্চ ২০২১ইং।। ১১ই চৈত্র ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (বসন্তকাল)।। ১১ শা’বান ১৪৪২হিজরী বিক্রমপুর খবর
আনিস আহামেদ :
আজিমপুর চৌরাস্তা থেকে শহীদ মিনারমুখী সড়কে পলাশী নামক স্থানটি সর্বপ্রথম খ্যাতি লাভ করে ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন সেনাছাউনি স্থাপন করা হয়। তখন এই নাম পরিচিত হয়ে ওঠে পলাশী ব্যারাক নামে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর সেমিপাকা ঘর সামনে পিছনে উঠানে ব্লকে ব্লকে সরকারি কর্মচারীদের নামে বরাদ্দ হয়। তবে বৈশিষ্ট্য হলো চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এই পরিবারগুলোর স্থায়ী নিবাস হয়ে যায় পলাশী ব্যারাক। সরকারি নথিতে সমুদয় এলাকা বুয়েটের নামে মালিকানা হস্তান্তর হওয়ার সুবাদে পর্যায়ক্রমে এই অস্থায়ী নিবাসগুলো উচ্ছেদ হতে শুরু করে ১৯৮০ সালের পর। এখন আর সেখানে ব্যারাকের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। পূর্ব থেকে পশ্চিমে পলাশি বাজার, বুয়েটের ক্যাম্পাস, সরকারি কর্মচারী স্টাফ কোয়ার্টার, আর আর্মি ব্যারাকের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে সেনা রিক্রুটিং সেন্টার।
মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকালে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে পূর্বাঞ্চলের সব ট্রেন ঢাকা ত্যাগ করত পলাশি ব্যারাক হয়ে বর্তমান সোনারগাঁও রোড ধরে তেজগাঁও স্টেশনে। এখন যেটি পলাশী মোড় নামে পরিচিত, এর উত্তর-দক্ষিণে ট্রেন চলাচল করত। পলাশীর মোড়ে পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ সড়কটি দু’পাশ দিয়ে ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠেছিল, যাতে ট্রেনের সাথে গাড়ি-ঘোড়ার দুর্ঘটনা ঠেকানো যায়।
ট্রেনলাইনের উত্তর-পূর্ব পাশে ছিল জহুরুল হক হল (সাবেক নাম ইকবাল হল) ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। ফুলবাড়িয়া থেকে কারওয়ানবাজার পর্যন্ত রেললাইনের দু’পাশে ছিল বস্তি। ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন পরিত্যক্ত হয়ে কমলাপুরে স্থানান্তরিত হলে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে সমস্ত এলাকা বস্তিতে রূপান্তরিত হয়। পর্যাক্রমিক এগুলোর নাম ছিল ১. পলাশীর বস্তি ২. নীলক্ষেত বস্তি ৩. বাবুপুরা বস্তি ৪. হাতিরপুল বস্তি।
পলাশী ব্যারাকবাসীরা ছিল পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষিত পরিবার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট ক্যাম্পাসের সংস্পর্শের মানুষ স্বভাবতই এরা রাজনৈতিক সচেতন এবং পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের সমর্থক। বস্তিবাসীরা ছিল শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের ঘোরতর কর্মী।
পলাশীর দক্ষিণে বৃহত্তর লালবাগ ও চকবাজার। পশ্চিমে আজিমপুর, নবাবগঞ্জ ও হাজারীবাগ। পুরান ঢাকা আর নতুন ঢাকার সংযোগস্থল হিসেবে পলাশী ছিল ভাষা আন্দোলন ও পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকালে পলাশী ছাত্রলীগের ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত হতো। পাকিস্তান স্বাধিকার আন্দোলনে পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগ কর্মীরা পলাশীকে সেল্টার হিসেবে ব্যবহার করত।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা বাংলা করার দাবিতে ভাষা দিবস ঘোষিত হলে, ইসলামপুরের নবাববাড়ীর কিছু যুবক এর বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করে, তখনকার মুসলিম লীগ পা-ারা লাটিসোটাসহ কয়েকটি ঘোড়ার গাড়িতে করে লালবাগ-পলাশী হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করতে চেষ্টা করলে পলাশীতে ছাত্র-জনতার ধাওয়ার মুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে প্রতিটি আন্দোলনে আজিমপুর-পলাশী সড়ক ছিল স্বাধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের দুর্জয় ঘাঁটি।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকবাহিনীর আক্রমণের শঙ্কা যখন বেড়ে যায়, সে সময় পুরান ঢাকায় যাতে পাকবাহিনী প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য সংগ্রামী জনতা পলাশী সংলগ্ন সব রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে তোলে। গাছ কেটে, পাইপ ফেলে, পরিত্যক্ত গাড়ি এনে এই ব্যারিকেড গড়ে তোলা হয়। এর পিছনে ছিল নিরস্ত্র মানুষের ‘যার কাছে যা আছে তা নিয়ে’ প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রত্যয়। রাত ১১টার পর অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে, বাবুপুরা নীলক্ষেত বস্তিতে আগুন দিয়ে পাকবাহিনীর একটি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে হামলা করে। অন্য একটি দল নিউ মার্কেট, আজিমপুর সড়ক হয়ে জহিরুল হক হল (ইকবাল হল), এসএম হল ও জগন্নাথ হলের দিকে এগুতে চাইলে পলাশীতে বাঙালিদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। পাকবাহিনীর সমরাস্ত্রের আক্রমণের মুখে বেশি সময় টিকে থাকতে পারেনি। সেখানে পাকবাহিনীর হাতে অগুনতি মানুষ নিহত হয়। পাকিরা সেখানে অবস্থিত ফায়ার ব্রিগেড স্টেশন আক্রমণ করে সব সদস্যকে হত্যা করে। হত্যাকা-ের মুখে পড়ে বুয়েটে অবস্থানরত ছাত্র-কর্মচারীরা।
২৫ মার্চের পলাশীর প্রতিরোধযুদ্ধে যারা সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন এবং প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছেন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের কয়েকজনের স্মৃতিকথা পাঠকদের সামনে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরব।
এক
আমির হোসেন, বয়স-৭২, পিতা-মৃত বাদশা মিয়া, স্থায়ী নিবাস-৭৭, হোসেনি দালান রোড, ঢাকা।
১৯৬২ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৮ মার্চ থেকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীসহ আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা-কর্মীদের সাথে প্রতিরোধের ট্রেনিং নিতে শুরু করেন। হোসেনি দালানের পুকুর সংলগ্ন দক্ষিণ দিকের মাঠে আমরা প্রায় ৪০ জন কর্মী নিয়মিত ট্রেনিং নিতাম। রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত অন্ধকারে চলত আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্প। বেগম বাজারের বাসিন্দা একজন আনসার কমান্ডার ও হোসেনি দালানের আনসার সদস্য জাফর হোসেন ছোটু কাঠের ৪টি ডামি রাইফেল দিয়ে আমাদের ট্রেনিং দিতেন।
২৫ মার্চ রাতে ট্রেনিং চলাকালে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা মারফত আমাদের কাছে খবর আসে যে আজ রাতেই পাকবাহিনী ঢাকা শহর আক্রমণ করবে। আমরা যেন সর্বত্র প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তুলি। প্রথমে আমরা বকশিবাজার ফজলে রাব্বী হলের সামনে রেলগেটে ব্যারিকেড দেওয়া শুরু করি। রেলগেটের দুপাশে সুয়ারেজ লাইনের পাইপ দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। এরপর চাঁনখারপুলের রেলগেটের দক্ষিণ পাশে নাজিমুদ্দিন রোডের প্রবেশ পথে রাস্তার ধারের জাম ও লটকন গাছ কেটে ডালপালা দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি সম্পন্ন করি।
রাত ১২টার পূর্বে প্রথমে পলাশী ও ইকবাল হল এলাকা থেকে একাধারে গুলির শব্দ পাওয়া যায়, রাত ৩টা পর্যন্ত একটানা গোলাগুলির আওয়াজ আসতে থাকে। আমরা ব্যারিকেডের পাশে সতর্কভাবে অবস্থান করি, কেউই ভয়ে পালিয়ে যাইনি, যে আমাদের অবস্থানের দিকে পাকিস্তানি আর্মি আসে নি। ধলপ্রহরে আমরা সবাই পলাশীর দিকে অগ্রসর হই। পলাশী বুয়েট গার্লস স্কুলের মাঠে ৫-৬টি লাশ পড়ে ছিল। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিফর্ম পরা দুটি লাশ ছিল। আমরা পিছনের দেয়াল টপকে স্কুলের ভেতর ঢুকেছিলাম।
ফজরের আজানের পর আমি, আবদুল কাদের ধলা, বাচ্চু মিয়া, আবু মিয়া ও বুয়েটের আহসান উল্লাহ ভেতরে প্রবেশ করি। হলের ভিতরে মাঠে বারান্দা ও বাথরুমে অনেক লাশ পড়েছিল। আহতরা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। আমরা সেখান থেকে অন্য সহযোগীদের সহায়তায় ৭টি লাশ ও ১০-১২ জন গুলিবিদ্ধ আহতকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইমারজেন্সিতে নিয়ে আসি। তখন সেখানে চিকিৎসা দেওয়ার মতো কোনো ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন না, শুধু কয়েকজন নার্স ও ওয়ার্ডবয় ছিলেন, তারাই প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে শুরু করেন।
২৬ মার্চ সকাল ১১টায় আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পাই, আমাদের গড়া ব্যারিকেড দুটি অক্ষত আছে। ২৬ মার্চ দিবাগত রাতে পাকবাহিনী বকশিবাজার ও চাঁনখারপুলের ব্যারিকেড ভেঙে দেয়। তারা দুটি ট্যাংক নিয়ে নাজিমুদ্দিন রোড হয়ে চকবাজারের দিকে যায়। এ সময় চাঁনখারপুলে পাকবাহিনীর গুলিতে দুই পান দোকানি শহীদ হন।
জুলাই মাসে মুক্তিযোদ্ধা কান্টুর সাথে নরসিংদীর বাইলপাড়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে খসরু ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করি। প্রথমে ওখানে চার দিন অবস্থান করি, এরপর নিয়মিত ওখানে আসা-যাওয়া করতাম। বিভিন্ন কায়দায় গোপনে গ্রেনেড বহন করে হোসেনি দালান এলাকায় গোপন আশ্রয়ে অবস্থানরত গেরিলাদের হাতে পৌঁছে দিতাম। তারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অপারেশন চালাত।
১৫ ডিসেম্বর ভোররাতে খবর আসে নবাবপুরে বিহারিরা সিদ্দিকবাজার আক্রমণ করেছে। সকালে সেখানে আমার বোনের বাড়ির খোঁজ নিতে যাওয়ার সময় পাকবাহিনী রাস্তা থেকে গ্রেফতার করে প্রথমে ঠাটারিবাজার নিয়ে যায়। সেখান থেকে বেঁধে প্রেসিডেন্ট হাউসের (বঙ্গভবন) ভিতরে নিয়ে নির্যাতন চালায়। ওখানে আরও বন্দী অনেকে ছিল। সবাইকে পিছনে হাত বেঁধে বসায়। এ সময় পাকি-কমান্ডার আওয়াজ করল, ‘ওয়াল ফায়ার’। আমি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হই। বন্দী ২১ জনের মধ্যে ১৯ জন ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করে। মাত্র দুজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। ১৬ ডিসেম্বর সকালে বঙ্গভবনের দেয়াল টপকে রেলওয়ে কলোনি হয়ে সিদ্দিকবাজারে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেই। ১৬ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি হই এবং ৯ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে বাসায় ফিরে আসি।
এই সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন অনবরত চেষ্টা চালিয়ে এখনও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাননি।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, উত্তরণ
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’