প্রকাশিত : শুক্রবার,১৬ অক্টোবর ২০২০ইং ।। ৩১শে আশ্বিন ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (শরৎকাল)।। ২৯শে সফর,১৪৪২ হিজরী
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : মাওলানা ওমর ফারুক – দিল্লির কাছেপিঠেই এক জায়গায় এক শিশু-পরিবার বসবাস করত। যারা নিজেদের নামের সঙ্গে শায়খ শব্দ ব্যবহার করত। (শায়খ উপাধি অধিকাংশেই সদ্য হিন্দু থেকে মুসলিম হওয়া লোকেরাই বেশি ব্যবহার করত)। এ কারণে বলা হয় এই পরিবারের এক ব্যক্তি যার সন্তানদের মধ্যে কেউ আর অবশিষ্ট নেই, পৈত্রিক সম্পত্তি বেহাত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য ইসলাম কবুল করেছে। কানপুর জেলার অনেক জমিদাররা নিজের সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য ইসলাম কবুল করতে বাধ্য হয়েছিল।
অনেক নওমুসলিমদের এটাও বলতে শোনা যায়, রাজপরিবারের হাকিম ও বিচারকরা তাদের উচ্চপদস্থ রাজন্যবর্গদের পর্যন্ত বন্দি করে কিংবা নজরদারিতে রেখে দিল্লি নিয়ে গিয়ে জোর করে খতনা করে মুসলিম বানিয়ে দেয়া হয়। এসব ইতিহাস পড়ার সময় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে এদের সাক্ষ্য ও বর্ণনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেবল আঞ্চলিক ও গোত্রীয় বর্ণনাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু বাদশাহ আলমগীর তথা আওরঙ্গজেব যুগের ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতে যতদূর আমি জানি, এই জোরপূর্বক মুসলমান বানিয়ে ফেলার কথা কোথাও উল্লেখ নেই। আর এটাও সত্য যে, এই ভারতবর্ষে মুসলিম বাদশাহরা হিন্দুদের জোর করে মুসলিম বানিয়ে ছিলেন।
একইসঙ্গে ধারণা করা হয়, বাদশাহ আলমগীর স্বভাবগতভাবেই ধর্মপরায়ন ছিলেন। দক্ষিণ ভারতের অনেক হিন্দুদের (যাদের মুসলমান হওয়ার ইতিহাস চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছিল) এটা ভাববার যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হয়েছিল যে, তারা মুসলমান হওয়ার কারণকে বাদশাহর অত্যাচার বলে ধরে নিতে পারে। আর এই কারণটাও এমন, যা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাছাড়া হায়দার আলী ও টিপু সুলতান এই বিষয়ে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছেন যে, তারাও অনেক পরিবার ও জনসাধারণের এক বিরাট অংশকে ক্ষমতা ও গায়ের জোরে মুসলমান বানিয়েছিলেন। অথচ এদের মুসলমান হওয়ার গাল-গল্প সেসব বাদশাহি শাসনামলেরও বহু পুরোনো যার ঐতিহাসিক বর্ণনা অদ্যাবধি আমরা পাইনি।
আওরঙ্গজেবের আদেশনামা ও চিঠিপত্রের এক পাণ্ডুলিপি (যা এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি) তাতে ধর্মীয় স্বাধীনতার সেই সার্বজনীন মূলনীতি আছে যা এক রাজার তার ভিন্ন ধর্মাবলম্বী প্রজাদের সঙ্গে করা উচিত। যেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই মূলনীতি তা হলো, বাদশাহ আলমগীরের কাছে এক ব্যক্তি নালিশ দিল বেতন বণ্টনে নিয়োজিত দুই ইরানি কর্মচারীদের চাকুরিচ্যুত করা হোক। কারণ তারা অগ্নিপূজক। তাদের স্থলে অভিজ্ঞ চৌকষ মুসলিমদের নিয়োগ দেয়া হোক। কারণ আল-কোরআনে আছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমার ও তোমাদের দুশমনদের বন্ধু মনে করো না। (মুমতাহানা: ১)।
বাদশাহ আলমগীর ফরমানে লিখলেন, দুনিয়াবি লেনদেনে ধর্মের কোনো স্থান নেই। আর না এই ধরণের লেনদেনে স্বজনপ্রীতির কোনো সুযোগ থাকছে। এই কথার সমর্থণে আয়াত তুলে ধরলেন, ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য আর আমাদের ধর্ম আমাদের জন্য।’ পাশাপাশি বাদশাহ লিখে দিলেন, যে আয়াত আমার লেখক তুলে ধরেছেন, এটাই যদি সালতানাতের রীতি-নীতি হয়ে থাকে তাহলে আমাদের উচিত ছিল, এই সাম্রাজ্যের প্রত্যেক রাজা ও প্রজাদের জেল-গারদে পুরে দেয়া। কিন্তু এটা আদৌ কি সম্ভব? সরকারি চাকুরী লোকেরা তাদের যোগ্যতা অনুসারে পাবে, অন্য কোনোভাবে নয়। আর এটাও বলা মুশকিল যে, স্বয়ং আলমগীরেরও এই সামগ্রিক মূলনীতির ওপর পরিপূর্ণ আমল ছিল। কিন্তু এটা ঠিক যে, আলমগীরের ওপর অধিকাংশ সময় অভিযোগ আনা হয়, তিনি জোর করে হিন্দুদের মুসলমান বানিয়ে ছিলেন। তাই এই অভিযোগটা কতোটুকু সত্য তা নিয়েও একটু বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার।
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, মুসলিম বাদশাহদের পীড়াপীড়িতে ইসলাম প্রচার কতোটুকু হয়েছে? দিল্লী ও আগ্রার জেলাগুলো যা ইসলামি শক্তি ও শৌর্যবীর্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল তাতে হিন্দুদের তুলনায় মুসলিমদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম। দিল্লির জেলাগুলোতে ১০ শতাংশের কিছুটা বেশি এবং আগ্রার জেলাগুলোতে মোট জনপদের একচতুর্থাংশের চেয়ে’ সংখ্যায় কম মুসলিমরা। এতে বোঝা যায়, যেসব হিন্দুদের জোর করে মুসলমান বানানো হয় তাদের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ওপর একটুও পড়েনি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গোরাখপুর জেলায় (উত্তরপ্রদেশ) মানঝুলির (বর্তমানে চায়না) রাজা বুদ্ধমলের মুসলমান হওয়া এ বিষয়ের জ্বলন্ত প্রমাণ। বলা হয় বাদশাহ আকবার এই রাজাকে খাজনা আদায় না করার অপরাধে গ্রেফতার করেন এবং গ্রেফতারের পর তাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে বাদশাহ রাজাকে মুসলমান বানিয়ে তার নাম মুহাম্মাদ সেলিম রেখে দেন। কিন্তু যখন রাজা দিল্লি থেকে ফিরে নিজ মাতৃভূমিতে পদার্পণ করে তখন রাণী তাকে প্রাসাদে ঢুকতে দেয়নি। কারণ রাণী ছিলেন প্রজাবৎসল। প্রজাদের সুখ-দুঃখে সবসময় তিনি তাদের পাশে থাকতেন। এজন্য রাণী তার পুত্র ভবানীমলকে নিজস্ব তত্তাবধানে রাজ্যের মালিক ও দায়িত্বশীল বানিয়ে দেন। আর এভাবে অধিকার ও উত্তরাধিকারে কোনো প্রকার জটিলতা দেখা দেয়নি।
কিছুকাল পরে বৈষ্ণবদের মধ্যেও যারা কেবল (বিষ্ণু দেবের (হিন্দু ধর্মের পালনকর্তা আরাধনা করে) ইসলামের রীতিনীতি পাওয়া যায়। এতে বোঝা যায়, তারা এক সময়ে অনিয়মিত ও অজানা কারণে মুসলমান হয়ে যায়। এরা নিজেদের মৃত আত্মীয়দের পোড়ানোর পরিবর্তে তখন কাফন-দাফন দিত। নামটাও গোলাম মুহাম্মাদ ইত্যাদি মুসলমানদের মতো করেই রাখতো। পরস্পরে অভিবাদনে সালাম বিনিময় করতো। এই বিষয়গুলো অনুশীলনের কারণে এমনও ঘটনা ঘটেছে, এক মুসলিম বিচারককে ব্যভিচারের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিয়েছে। এই অপরাধের দায়ে বাধ্য হয়ে তাদের ইসলাম কবুল করতে হয়েছে। তাই পরবর্তীতে বৈষ্ণবরা এই প্রথা ছেড়ে আবার তাদের প্রাচীন প্রথায় ফিরে যায়। উপর্যুক্ত ঘটনার আলোকে কোন কথাটা বেশি যৌক্তিক?
জোর-জবরদস্তি করে বাদশাহ ও বিচারকদের এভাবে মুসলিম বানানোর কারণে হয়তো কিছুটা লাভ হয়েছে। কিংবা ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন ছাড়া ইসলামি উত্থানের চিত্র কেবল অনুমান নির্ভর জানা অসম্ভব হোক না কেনো, সত্য যাই হোক, তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারে ব্যাপক সফলতার এই গর্ব-গাঁথা চিত্র সে সময়ের; যখন মুসলিমদের রাজনৈতিক শক্তিও ছিল বেশ দুর্বল। দক্ষিণ ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ এর আদর্শ উদাহরণ।
ইসলামের দাঈরা ভারতবর্ষে কি ধরণের কাজ করেছেন?
এখন আমরা ইসলাম প্রচারের বিবরণ এই ধারাবাহিকতায় লিখছি, দক্ষিণ ভারত ও দাকান শহর থেকে শুরু করে সিন্ধু, কুচ ও গুজরাটের ঘটনাগুলোর দিকে ভাসাভাসা নজর দেব। এরপর বাংলার সুবাগুলোর (সুবা বলা হয় যখন সমগ্র ভারত-বাংলা-বিহার মোগল সালতানাধীন তখন বাংলায় স্বতন্ত্র ১২-১৩ জন শাসক বিদ্যমান, এদের বলা হয় সুবাদার) বিবরণ দিয়ে দাঈ ইলাল্লাহদের আলোচনা শুরু করব। যারা এই সুবে সীমানার বহির্ভূত হিন্দুদের মুসলমান বানিয়ে ছিলেন। এই ইসলাম প্রচারকদের মধ্যে অধিকাংশই এমন যে, যাদের নাম ও স্থান ছাড়া বেশি কিছু লেখা হয়নি। যার ফলে তাদের ব্যপারে বিস্তারিত জিজ্ঞেস পর্যন্ত করা হয় না। তাই তাদের সম্পর্কে যে ঘটনাগুলো বিশদ জানা আছে তা সবিস্তারে লিখবো।
দক্ষিণ ভারতে ইসলাম প্রচার:
দক্ষিণ ভারতে ইসলামি আন্দোলনের সূচনা খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে। কিছু মুসলমান যাদের মোপলা জাতি নিজেদের আধ্যাত্মিক পূর্বপুরুষ মনে করত। ইরাক থেকে এসে দক্ষিণে বসতি গড়ে তোলে। গরম মশলা, হাতির দাঁত ও অলঙ্কার ইত্যাদি বাণিজ্য আরব ও ইরানিদের মধ্যস্থতায় ভারত ও ইউরোপীয়দের মধ্যে চলে আসছিল। এই জন্য ইসলামের প্রভাব দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম সমুদ্রতটে সমানভাবে বিদ্যমান ছিল। বহিরাগত মুসলিমদের অধিকহারে যাতায়াতের ফলে পশ্চিম সমুদ্রবর্তী ভারতীয় বন্দর ও বাণিজ্যিক শহর বেসামাল হয়ে পড়ে। আর অধিকাংশ লোক অর্ধেক হিন্দু, অর্ধেক আরব ও অর্ধেক ইরানি হয়ে যায়। এটাও বেশ সবার জানা-শোনা যে, হিন্দু রাজা ও মুসলিম ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে। মুসলিম ব্যবসায়ী দ্বারা অর্জিত বাণিজ্য সফলতার এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং দেশের স্বার্থে রাজ্যের গভর্ণররা তাদের নিরাপত্তা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। এমনকী একথাও বলা হয় যে, তারা কোনো ধরণের সহযোগিতায় এ কাজ করেনি। যা মুসলমানরা ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য বড় আগ্রহের সঙ্গে অবলম্বন করত।
ইবনে মুলক ও তার সঙ্গীদের ইসলাম প্রচারের প্রচেষ্টা:
হিজরি দ্বিতীয় শতকে কতিপয় দাঈ ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা এভাবে বিখ্যাত এক মহান সাধক শায়খ শরীফ বিন মালিক বিন দিনার, তার ভ্রাতুষ্পুত্র মালিক বিন হাবিবসহ আরো কতিপয় সঙ্গী-সাথীবৃন্দ আদম কিল্লাহর যিয়ারতের জন্য শীলন উপদ্বীপে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে কারাঙ্গানিয়ারে (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) অবস্থান নিলেন। মালিবারের রাজা যখন তাদের আগমণের সংবাদ শুনলেন, তখন সবাইকে নিমন্ত্রণ জানালেন। অত্যন্ত বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভক্তিভাবের আচরণ করলেন। শায়খ শরীফ রাজার এমন মহানুভব আচরণে অভয় পেলেন। তিনি রাসূল (সা.) এর অবস্থা তার সামনে তুলে ধরলেন। ইসলামের প্রকৃত অবস্থার ব্যাপারে সতর্ক করলেন। আর প্রমাণ হিসেবে রাসূল (সা.) এর বিখ্যাত মুজেযা চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরলেন।
আল্লাহ তায়ালার অসীম কৃপায় রাজার অন্তরে পয়গম্বরের রিসালাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপিত হয়ে গেল। রাসূলের (সা.) ভালোবাসায় তার হৃদয় সিক্ত হয়ে উঠল। অবশেষে ঈমান আনলেন। বিদায়কালে রাজা শায়খ শরীফের কাছে নিবেদন করলেন, তিনি আদম জিয়ারত শেষে ফেরার সময় সাথীবৃন্দসহ ফারাঙ্গানুরে যেনো ফিরে আসেন। কারণ তিনিও তার আরব সফর-সঙ্গী হওয়ার জন্য মনে মনে মনস্থির করে ফেলেছিলেন। রাজা শায়খকে এও বুঝিয়ে দিলেন, আমার মনের এই গোপন ইচ্ছা মালিবারের কোনো ব্যক্তির কাছে যেনো প্রকাশ না পায়। যখন শায়খ তার ভক্তবৃন্দসহ পুনরায় মালিবায় ফিরলেন তখন রাজা আরবগামী বন্দরের জাহাজে লুকিয়ে চুরিয়ে সাওয়ার হয়ে তাদের সঙ্গে সোজা রওনা করলেন। রাজ্যের ব্যবস্থাপনা এক প্রতিনিধির হাতে ন্যস্ত করলেন। আরবে কিছুকাল কাটানোর পর যখন দেশে ফেরার এই ইচ্ছা ব্যক্ত করছিলেন যে, দেশে ফিরে মসজিদ নির্মাণ করব। লোকদের ইসলামের দাওয়াত দেব তখনই এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইন্তিকাল করলেন।
মুমূর্ষ অবস্থায় সাথীদের ওসিয়ত করলেন, মালিবারে সত্য দ্বীন প্রচারের যে দৃপ্ত ইচ্ছা তিনি লালন করেছেন তা পালনে যেনো কোনো প্রকার ত্রুটি না থাকে। এই কাজে সাহায্যের জন্য রাজা প্রতিনিধির নামে সুপারিশপত্র লিখে শায়খ শরীফকে দিয়ে দিলেন। শায়খ ও তার সাথীরা এই পত্র নিয়ে মালিবারে ফিরে রাজার প্রতিনিধির হাতে তুলে দেন। প্রতিনিধি পত্র পাওয়া মাত্রই রাজার দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী কিছু ভূমি ও বাগান শায়খদের থাকার জন্য দিয়ে দিলেন যাতে তারা সেখানে থাকতে পারেন। সেই সঙ্গে মসজিদ নির্মাণ করলেন। মালেক ইবনে দীনার এখানে স্বতন্ত্রভাবে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। তবে ইবনে দীনারের ভাতিজা মালিক বিন হাবিব কিছুদিন পর মসজিদ নির্মাণ করার ইচ্ছায় সেখান থেকে চলে গিয়ে প্রথম শহর কোলিনে আসলেন। সেখানে ধন-সম্পদ ও সন্তানাদিসহ সবকিছু নিয়ে থাকতে গেলেন। এখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করলেন। পরিবারের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে হুবাই মুরাদি শহরে প্রস্থান করলেন। সেখান থেকে বাঙ্গর, ম্যাঙ্গালোর, কঞ্জরকোর্ট শহরে পৌঁছলেন। প্রতি শহরে মসজিদ নির্মাণ করতেন। পুনরায় বাইমুরাদি শহরে আসলেন এবং তিন মাস এখানে থাকলেন। এখান থেকে যারাফতান, দারমাফতান ফান্দারিয়া, শালিয়াতের বিভিন্ন শহরে যান। আর সবগুলো শহরে মসজিদ নির্মাণ করেছেন। শালিয়াতে ৫ মাস অবস্থানের পর আপন চাচা মালিক বিন দিনারের নিকট কারাঙ্গানিয়ায় ফিরে গেলেন। এখানে কিছুদিন অবস্থান করে যে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন তার সূচনা ও ওয়াকফের ব্যবস্থাপনা করার জন্য ক্রমান্বয়ে সফর করে চললেন। কাজ শেষ হলে আবার কারাঙ্গানিয়াতে ফিরে আসেন। এখন তার হৃদয়ে আল্লাহর রহমতের আশা-আকাঙ্খা উতলে উঠল। কারণ ইসলামের নুর এই ভূমিতে ছড়িয়ে পড়েছিল যেখানকার বাসিন্দারা একসময়ে ছিল মূর্তিপূজারি। এরপর মালিক বিন দীনার ও মালিক বিন হাবিব তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে কোলন শহরে চলে আসেন। এখানে মালিক বিন হাবিব ও তার ভক্তবৃন্দরা অবস্থান নেন। তবে মালিক বিন দীনার খোরাসান সফরে বের হন এবং সেখানে পৌঁছে ইন্তিকাল করেন। ইবনে হাবিব নিজ সন্তানদের কোলীনে স্যাটেল করেন। আর স্ত্রীসহ নিজে কারাঙ্গানুরে চলে আসেন। আর এখানে দুজনেই ইন্তিকাল করেন।
উল্লিখিত ঘটনা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে শুদ্ধ-অশুদ্ধের কথা থাকলেও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, মালাবার সমুদ্র বন্দরে ইসলাম প্রচারের শান্তিময় পদ্ধতি শতাব্দি অবধি চলে আসছে। খৃষ্টীয় ১৬ শতাব্দির শুরুতে মোপলা জাতির নও মুসলিমদের সংখ্যা মালাবারের মোট জনগোষ্ঠীর এক-পঞ্চমাংশ ছিল। তাদের ভাষাও ছিল সেখানকার হিন্দুদের মতো। কেবল মুখের দাড়ি ও মাথার বিস্ময়কর পাগড়ি দেখেই কেবল অন্যদের থেকে তাদের আলাদা করা যেত। যদি পর্তুগীজরা মালাবারে না আসত তাহলে ভারতবর্ষের বন্দর অঞ্চলের সব হিন্দুরা মুসলমান হয়ে যেত। কারণ সে সময় জনসাধারণরা অধিক হারে মুসলিম হতে শুরু করে। গুজরাট, দাকান, আরব ও ইরান থেকে আগত মুসলিম ব্যবসায়ীদের প্রভাবও ছিল তখন বেশ দাপুটে।
আলী হায়দার ও টিপু সুলতানের শাসনামলে জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণ:
দক্ষিণ ভারতে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস সর্বদা উপরোল্লিখিত প্রেক্ষাপটগুলোর মতো এতোটা শান্তিপূর্ণ ছিল না। কিন্তু সেখানকার প্রাচীন ইতিহাসে এমন নির্মমতার কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না যা সেসময়ের হিন্দুদের জোর করে মুসলমান হওয়ার জন্য করা হয়েছিল। অথচ হায়দার আলী (১৭৬৭-১৭৮৪ খৃষ্টাব্দ) ও টিপু সুলতান (১৭৮২-১৭৯৯ খৃষ্টাব্দ) এর শাসনকাল ছিল মুসলিম সাম্রাজ্যের উত্থানের যুগ। এই বাদশাহরা হয়তো নির্মমতা কিছুটা দেখিয়েছেন তবে এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, প্রাচীন যুগে সংখ্যালঘু জাতিদের অত্যধিক নিরাপত্তার স্বার্থে মুসলমান বানিয়ে নেয়া হত। এখনো এ অবস্থা বহাল আছে। মোটকথা হিন্দু সম্প্রদায় এত বেশি সংখ্যায় মুসলমান হয় যে, দক্ষিণ ভারতের পূর্ব-পশ্চিম বন্দরের নও মুসলিমদের মধ্যে প্রাচীন হিন্দু ধ্যান-ধারণার সংমিশ্রণ ও আচার-প্রথার প্রতি ঝোক পরিলক্ষিত হত। কেবল শায়খ শরীফ ছাড়া সেখানকার অধিকাংশ নওমুসলিমদের আচরণ ও অবস্থা ঠিক তেমনটাই হত যেমনটা ছিল সেখানকার বাসিন্দাদের। ভিনদেশি মুসলিমদের রক্তের প্রভাব সেখানে অতি কম মাত্রায় ছিল বলা যায়।
ভারতের পশ্চিম বন্দরের জেলাগুলোতে জাত-পাতের ভেদাভেদ ছিল অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। তারামঙ্করের কতিপয় নিচু জাতের লোকেদের নিয়ম ছিল, ব্রাক্ষ্মনদের থেকে ৭৪ পদ দূরে থাকতে হবে। এরচে’ বেশি কাছে আসার সাহস দেখানো যাবে না। রাস্তায় যখন চলবে তখন শব্দ করে চলবে, যাতে অন্য লোকেরা তার ধারের কাছে না ঘেষে। এ ধরণের আরো বহু দৃষ্টান্ত চাইলে বর্ণনা করা যাবে। তাই আশ্চর্যের হবার কী আছে এতে, যখন নিচু জাতের লোকেরা মুসলিম হওয়ার ফলে মুসলিম জনসংখ্যায় দ্রুত উন্নতি সাধিত হয়েছে? এরা তো মুসলিম হয়ে লাঞ্ছনা ও বঞ্জনা-বৃত্তের বন্দিদশা থেকে চিরতরে মুক্তি পেয়েছে। সংস্কার ও সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে আপন সত্তা ও সন্তানদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
প্রফেসর আর্নল্ডের বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ ‘‘দি প্রিচিং অফ ইসলাম’ থেকে অনূদিত
সুত্রঃ মাওলানা ওমর ফারুক ডেইলি-বাংলাদেশ ডটকম
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর–আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন–বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’