প্রকাশিত :বুধবার,১জুলাই ২০২০ইং ।। ১৭ই আষাঢ় ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।।
বিক্রমপুর খবর : মোজাম্মেল হোসেন সজল, মুন্সীগঞ্জ মুন্সীগঞ্জ : বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবির ঘটনায় শোক সাগরে ভাসছে মুন্সীগঞ্জ। মুন্সীগঞ্জ সদর ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলাবাসী করোনার মহামারির এই দুঃসময়ে এমন মৃত্যুর ঘটনায় স্তব্ধ ও বাকরুদ্ধ। শোক সাগরে ভাসছে উপজেলা দুইটির হাজারো মানুষ। মাতক আর শোকে কাতর স্বজনহারা পরিবারগুলো। এটা কোন দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকান্ড বলেই মনে করছেন নিহতদের স্বজন ও মুন্সীগঞ্জবাসী। সোমবার ৩২ টি মরদেহ ও মঙ্গলবার আরো একটি মরদেহ উদ্ধারে মোট মরদেহের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩-এ। এর অধিকাংশরই বাড়ি মুন্সীগঞ্জ সদর ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলায়। উদ্ধার হওয়া ৩৩ মরদেহের মধ্যে ২০ জন পুরুষ, ৯ জন নারী এবং ৪ টি শিশু রয়েছে।
জেলা পুলিশের তথ্য মতে, উদ্ধার হওয়া মরদেহের মধ্যে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় রয়েছে ২১ জন, টঙ্গিবাড়ী উপজেলায় ৯ জন, সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলার ১ জন করে রয়েছে।
সোমবার সকাল পৌনে ৮টার দিকে মিরকাদিম পৌরসভার কাঠপট্রি লঞ্চঘাট থেকে ৫০-৬০ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকার সদরঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় মর্নিং বার্ড নামে ছোট একটি লঞ্চটি। লঞ্চটি সদরঘাট লঞ্চঘাটে ভেড়ানোর আগ মুহুর্তে চাঁদপুর লাইনে চলাচলরত ময়ূর-২ নামে একটি লঞ্চ সজোরে ধাক্কা দিলে মর্নিং বার্ড লঞ্চটি মুহুর্তেই বুড়িগঙ্গায় উল্টে তলিয়ে যায়। এ সময় কেউ কেউ সাঁতরিয়ে তীরে উঠতে পারলেও অধিকাংশ যাত্রী প্রাণ হারায়। এ খবর মুন্সীগঞ্জে আসার পরপরই আপনজনেরা ছুটে যায় দুর্ঘটনাস্থলে। আবার অনেকে মরদেহের জন্য কাঠপট্রি লঞ্চঘাটে অপেক্ষা করতে থাকে। দিনের শেষে অ্যাম্বুলেসে কোনটা নদীপথে ট্রলারে করে একের পর এক আসতে থাকে মরদেহ। গোটা মুন্সীগঞ্জ যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। স্বজনদের বুকফাটা কান্নায় আকাশ ভাড়ি হয়ে উঠে। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় কেউ হারিয়েছেন স্বামী, কেউ স্ত্রী, কেউ ভাইবোন আবার কেউ হারিয়েছেন প্রিয় মা-বাবা বা সন্তানকে।
মিরকাদিম পৌরসভার সচিব মো. সিদ্দিকুর রহমান জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত তারা পৌরসভায় ১২ জনের মরদেহ পেয়েছেন। তালিকায় নিখোঁজ কেউ নেই বলে এই সচিব জানান।
টঙ্গিবাড়ী উপজেলার আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. জয়নাল আবেদীন জানিয়েছেন, তার ইউনিয়নের ৪ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। একই পরিবারের স্ত্রী হাসিনা বেগম (৪০) ও তার সন্তান নাইমুর রহমান সিফাতের (১০) মরদেহ উদ্ধার হলেও পরিবারের অভিভাবক স্বামী আব্দুর রহমানের (৫০) সন্ধান মিলেনি। স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-তিনজনই একই লঞ্চে সোমবার ঢাকা যাচ্ছিলেন।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. রুহুল আমিন জানান, তাদের ইউনিয়নে ৯ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। দুর্ঘটনার সময় ২ জন সাঁতরিয়ে তীরে উঠে। নিখোঁজের তালিকায় তাদের ইউনিয়নে এমন কেউ নেই বলে তিনি জানান।
এদিকে, সোমবার রাতেই নিহতদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চের ধাক্কায় লঞ্চডুবিতে প্রাণ হারায় ঢাকার ইসলামপুর শাখার যমুনা ব্যাকের কর্মরত সুমন তালুকদার।
তার ভাই নয়ন তালুকদার জানান, মিরকাদিম পৌরসভার নিজ বাড়ি থেকেই প্রতিদিন লঞ্চে করে ব্যাংকে যেতেন। সোমবারও কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য লঞ্চে করে যাচ্ছিলেন। কর্মস্থলে পৌছার আগেই সুমন লঞ্চডুবিতে প্রাণ হারায়।
মিরকাদিম পৌরসভার পশ্চিমপাড়া গ্রামের দিদার হোসেন (৪৫) ও তার বোন রুমা বেগম (৪০) অসুস্থ ভগ্নিপতিকে দেখতে ঢাকায় যাচ্ছিলেন।পথিমধ্যে লঞ্চডুবিতে দু’জনই মারা যায়।
মিরকাদিমের পশ্চিমপাড়া গ্রামের পরশ মিয়ার স্ত্রী সুফিয়া বেগম (৫৪) দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। বেঁচে যায় তার মেয়ে সুমা আক্তা (২৪)। তারা সদরঘাটের সুমনা ক্লিনিকে ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছিলেন।
দুর্ঘটনায় বেচে যাওয়া জাহাঙ্গীর হেসেন ও নাসিমা আক্তার বলেন, কেরাণীগঞ্জের একটি ডকইয়ার্ড থেকে মেরামত শেষে ময়ূর-২ লঞ্চটি নদীতে নামানোর সময় লঞ্চটি সজোরে ধাক্কা দেয়। এ সময় মুহুর্তেই মর্নিং বার্ড লঞ্চটি উল্টে বুড়িগঙ্গায় নিমজ্জিত হয়। ডুবে যাওয়া লঞ্চটি থেকে আমরাসহ কয়েকজন যাত্রী সাঁতরে পাড়ে উঠলেও অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানান তারা।
এদিকে, ঢাকায় নিহতদের দাফন বাবদ প্রত্যেক পরিবারের হাতে ৩০ হাজার টাকা করে প্রদান করে। ঢাকায় সহায়তা পায়নি এমন নিহত ৪টি পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে প্রদান করে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন।
ওদিকে, লঞ্চডুবিতে হতাহতের ঘটনায় ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় ঘাতক ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক, মাস্টার ও সুকানিসহ ৭ জনকে আসামি করে মঙ্গলবার থানার এআই মো. শাসসুল হক বাদী হয়ে একটি অবহেলাজনিত হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহজামান জানান, এজাহারে লঞ্চের মালিক, মাস্টার, সুকানিসহ ৭ জনের অবহেলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..