প্রকাশিত: রবিবার,১২মে ২০১৯। ২৯শে বৈশাখ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। ৬ রমজান ১৪৪০ হিজরি।
বিক্রমপুর খবর ডেস্ক : সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ আমাদের মা,আর প্রিয় শব্দ সুমধুর মা ডাক। মাকে ভালোবাসতে কোনো বিশেষ দিনের প্রয়োজন নেই। তবুও পৃথিবীর সব মায়েদের প্রতি সম্মান জানাতে কয়েক যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব মা দিবস।
১২ মে (রোববার) বিশ্ব মা দিবস। প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বব্যাপী এ দিনটি পালিত হয়। দেশ ও অঞ্চলভেদে কোথাও কোথাও অবশ্য মা দিবসের তারিখ ভিন্ন হয়ে থাকে।
মা দিবসের সূত্রপাত ও ইতিহাস:
আজ মে মাসের দ্বিতীয় রোববার। বিশ্ব মা দিবস। সারাবিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়। দিবসটির মূল উদ্দেশ্য,মাকে যথাযথ সম্মান দেয়া,ভালোবাসা। দিনটি উপলক্ষে দেশে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বিভিন্ন সংগঠন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এরই মধ্যে মাকে ভালোবাসা জানিয়েছেন বহু সন্তান।
মা’এক শব্দেই তার পূর্ণতা। মিষ্টি এক ডাক। মা’কে ভালোবাসার নাই কোনো নির্দিষ্ট দিন। মায়ের জন্য ভালোবাসা চিরন্তন। তবে বিশ্ব মা দিবসের ধারণার প্রবর্তন করেন মার্কিন পরিচ্ছন্নতাকর্মী অ্যান জার্ভিস। প্রাচীন গ্রিসে পালন করা হতো মা দিবস। প্রতি বসন্তের একটি দিনে দেবতাদের মা ‘রিয়া’কে উদ্দেশ্য করেই পালিত হতো মা দিবস।
মাকে মহান আল্লাহ তা’য়ালা স্বীয় রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সালামের পরে সর্বোচ্চ আসন দিয়েছেন। পবিত্র আল কোরআনে বলা হয়েছে,‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন,তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে এবং মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে। তাঁদের একজন অথবা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাঁদের ‘উফ্’বলবে না এবং তাঁদের ধমক দেবে না;তাঁদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলবে। মমতাবশে তাঁদের প্রতি নম্রতার ডানা প্রসারিত করো এবং বলো,‘হে আমার প্রতিপালক! তাঁদের প্রতি দয়া করো,যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছেন।’(সুরা ইসরা-বনি ইসরাইল,২৩-২৪)। রাসুল (সা.) বলেছেন,‘সন্তানের জান্নাত মায়ের পদতলে।’
সনাতন হিন্দু ধর্মেও মায়ের স্থান অনেক উঁচুতে। মনুসংহিতার শ্লোকে আছে: উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য্য আচার্য্যণাং শতং পিতা। সহস্রন্ত্ত পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে। খ্রিষ্ট ধর্মেও মায়ের মর্যাদা উঁচু স্তরে। বৌদ্ধ ধর্মেও মা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। অথচ মা দিবসের নামে এই মাকেও পাশ্চত্য বেনিয়ারা বাণিজ্য লক্ষ্মী বানিয়েছে। মাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে নির্দিষ্ট দিন চালু করেছে তারা।
ইতিহাস খতিয়ে দেখা যায়,মা দিবসের সূচনা প্রাচীন গ্রিসের মাতৃরূপী দেবী সিবেলের আরাধনা, প্রাচীন রোমানে দেবী জুনোর আরাধনা ও ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে মাদারিং সানডে’র মতো বেশ ক’টি আচার-অনুষ্ঠান। মায়েদের সম্মানে পালিত মাদারিং সানডে পালিত হতো নির্দিষ্ট একটি রোববারে।
যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস পালনের প্রচলন শুরু হয় আমেরিকান সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্ড হোই নামে এক নারীর হাত ধরে। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পৈচাশিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে শান্তির প্রত্যাশায় জুলিয়া একটি ঘোষণাপত্র লেখেন। এটি মাদার’স ডে প্রোক্লেমেশন নামে পরিচিত ছিল।
এ ঘোষণার মধ্যে জুলিয়া রাজনৈতিক স্তরে সমাজ প্রতিষ্ঠায় নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য রাখেন। এরপর যুদ্ধ শেষে পরিবারহীন অনাথদের সেবায় ও একত্রীকরণে নিয়োজিত হন মার্কিন সমাজকর্মী আনা রিভিজ জার্ভিস ও তার মেয়ে আনা মেরি জার্ভিস। এ সময় তারা জুলিয়া ওয়ার্ড ঘোষিত মা দিবস পালন করতে শুরু করেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে আনা রিভিজ জার্ভিস ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ৫ মে মারা যান।
মায়ের মৃত্যুর পর আনা মেরি জার্ভিস মায়ের শান্তি কামনায় ও তার সম্মানে সরকারিভাবে মা দিবস পালনের জন্য প্রচারণা চালান। তিন বছর পর ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মে পশ্চিম ভার্জিনিয়ার আন্দ্রেউজ মেথডিস্ট এপিসকোপাল চার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম মা দিবস পালিত হয়।
চার্চটি বর্তমানে International Mother’s Day Shrine নামে পরিচিত। আনা রিভিজ সাদা কারনেশন ফুল ভীষণ ভালোবাসতেন। তাই নিজের ও সব মায়ের সম্মানে চার্চে উপস্থিত সব মায়েদের দু’টি করে সাদা কারনেশন ফুল উপহার দেন আনা মেরি জার্ভিস।
কিন্তু এখানেই আনা মারি জার্ভিস থেমে ছিলেন না। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্থাপন করেন মাদার’স ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন। এ সময় জার্ভিস মা দিবসকে ছুটির দিন করার লক্ষ্যে ও দিনটিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে ব্যাপক প্রচারণা চালান।
তার এই প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কানাডা, মেক্সিকো, চীন, জাপান, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকায়। তারপর ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রচেষ্টা সফল হয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস ও জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই থেকে আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে মা দিবস। ১৯২০ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রায় সব দেশে মা দিবসের প্রচলন শুরু হয়।
এরপর থেকেই সরকারিভাবে মা দিবস পালিত হতে থাকে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই মা দিবসের মূল প্রাধান্যকে ছাড়িয়ে যায় দিনটির বাণ্যিজ্যিক প্রভাব। মা দিবসে ফুল বিক্রি ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে দিনটি এতটাই বাণিজ্যিক হয়ে ওঠে যাতে করে আনা মেরি জার্ভিস প্রতিবাদী হয়ে পড়েন। দিনটির এমন অবমাননার প্রতিবাদে তিনি নিজের সমস্ত সম্পত্তি ব্যয় করেন ও ঘোর বিরোধিতার অভিযোগে গ্রেফতার হন।
মূলত আনা মেরি জার্ভিসকেই মা দিবসের আসল প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে মা দিবসের প্রবক্তা এই আনা মেরি জার্ভিস দিবসটির বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধিতা করে বলেছিলেন,মাকে কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর অর্থ হলো,তাকে দুই কলম লেখার সময় হয় না। চকলেট উপহার দেয়ার অর্থ হলো,তা নিজেই খেয়ে ফেলা।