বিক্রমপুরের কৃর্তি সন্তান শহীদ নিজামউদ্দিন আজাদ

0
9
বিক্রমপুরের কৃর্তি সন্তান শহীদ নিজামউদ্দিন আজাদ

প্রকাশিত : রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, খ্রিষ্টাব্দ।।৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ(হেমন্তকাল)।।১২ জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরী।

বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক :

শহীদ নিজামউদ্দিন আজাদ
“মন খারাপ করার কোন সময় নাই। দেশ মাতার ডাকে জীবন দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।কোন রকম দূর্বলতা আসলে আমাদের চলবে না। আজ যে মাকে ওরা ধর্ষণ করছে সেই মাকে সম্পূর্ণ ভাবে মুক্ত না করা পর্যন্ত আমাদের একটাই চিন্তা, একটাই তপস্যা মা কে মুক্ত করবো, এর মধ্যে দুর্বলতার কোন স্থান নেই, মানুসিক অশান্তির কোনও সুযোগ নেই, পেছন ফিরে তাকাবার কোনও সময় নেই। তুই কোন চিন্তা করিসনা।সব ঠিক হয়ে যাবে।আবার বাংলায় ফিরবো আবার সুখী হয়ে থাকবো”~
(গেরিলা ক্যাম্প থেকে ১৭ জুলাই ১৯৭১ সনের অমর শহীদ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিন আজাদের শেষ চিঠি- লিখেছিলেন বন্ধু আরেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাজী টুলুর কাছে। সে চিঠির প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে ফুলের মতো ফুটে আছে শহীদ নিজাম উদ্দিন আজাদের দেশপ্রেম।)
শহীদ নিজাম উদ্দিন আজাদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(১)
ভাষা সৈনিক, সাবেক রাষ্ট্রদূত, প্রথিতযশা লেখক, আইনবিদ, কুটনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের স্থপতিদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত জনাব কামরুদ্দীন আহমদ এবং প্রয়াত জোবেদা খানমের কনিষ্ঠ পুত্র শহীদ নিজামউদ্দিন আজাদের জন্ম ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ বৃহস্পতি বারে-অত্যাচারী ব্রিটিশ বেনিয়ার হাত থেকে ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণে।
সদ্যজাত শিশুটিকে পরম যত্নে ধারণ করে তাঁর পিতা প্রয়াত জনাব কামরুদ্দীন আহমদ (সুবাহ্) বিড়বিড় করে বললেন “আজাদ” অর্থ “স্বাধীন”।
ব্রিটিশ বিরোধী অগ্নিযুগের বিপ্লবী ” আজাদের” মতো করে সন্তানকে গড়ে তোলার শপথ নিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের তরুণ নেতা গণতান্ত্রিক যুবলীগের আহবায়ক সুবাহ্। আজাদ তাঁকে আশাহত করেননি। ১৯৭১ এর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সেই প্রখ্যাত বিপ্লবী আজাদের মতোই আমৃত্যু সশস্ত্র যুদ্ধ করে নিজের বুকের তাজা লাল রক্তে ঘন সবুজের মাঠকে রঞ্জিত করে দিয়ে গেছেন স্বাধীনতা।
আজাদের পূর্বপ্রজন্মের নিবাস ছিল বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার ষোলঘর গ্রামের মিঞা বাড়িতে। বাবার কুটনৈতিক চাকরির সুবাদে তাঁর শৈশব কাটে প্রবাসে।
ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানে ভর্তি হন। তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং সমাজতন্ত্রের পক্ষের সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। কলেজের ছাত্রাবস্থায়ই নিজ মেধা ও যোগ্যতায় অল্পদিনেই সংগঠনের নেতৃত্বের প্রথম সারিতে ওঠে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রাবস্থায় দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক আসে। সব কিছু পেছনে ফেলে তিনি এগিয়ে যান সামনে, যোগ দেন ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ ও বিশেষায়িত গেরিলা বাহিনীতে। প্রশিক্ষিত সমাপ্ত করেন দ্বিতীয় ব্যাচে।
(২)
একাত্তরে সশস্ত্র সংগ্রামে বীরোচিত ভূমিকা পালনকারী ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ ও বিশেষায়িত গেরিলা বাহিনী।
এই বিশেষায়িত বাহিনীর যোদ্ধারা সামরিক প্রশিক্ষণের পূর্ব প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ ছাড়াও রাজনৈতিক বিষয়েও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন যা তাঁদের সাধারণভাবে প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে করেছিলো আলাদা।
ভারতের ত্রিপুরাস্থ ক্রাফট হোস্টেল, কর্তাবাড়ি, বড়দোয়ালী স্কুল, আগরতলার সন্নিকটস্থ পাহাড়ী এলাকা, সোনামুড়া, গোকুলনগর ও ধর্মনগরে, আসামস্থ করিমগঞ্জ হিন্দু স্কুল, ব্যালট মেঘালয়স্থ তুরা, বারেঙ্গা পাড়া ও পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগর, গঙ্গারামপুর, বালুরঘাট, মানিক নগর, বশির হাটে তাঁদের অস্থায়ী রিক্রটমেন্ট শিবির ছিল। উপরোক্ত শিবিরগুলো থেকে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য তাঁদের ভারতের আসামের তেজপুরস্থ সেনানিবাসে পাঠানো হয়। এসময় ডেল্টা সেক্টরে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার কারিয়াপ্পার অধীনে তিনটি ব্যাচে মোট পনেরশ জনকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ কমান্ডার ছিলেন প্রয়াত ওসমান গনি, দ্বিতীয় ব্যাচে জনাব মনজুরুল আহসান খান (বর্তমানে উপদেষ্টা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি), তৃতীয় ব্যাচে গোলাম প্রয়াত মর্তুজা খান। এফ এফ, মেরিন কমান্ডোসহ বিভিন্ন বাহিনীতেও এসকল অস্থায়ী রিক্রটমেন্ট শিবির থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো হয়।
আরো ১০সহস্রাধিক তরুণ যুবা কৃষক শ্রমিক প্রশিক্ষণের প্রতিক্ষায় প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছিলেন।
(৩)
এই বিশেষায়িত বাহিনীর দ্বিতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষিণ প্রাপ্ত সদস্যদের একটি অংশ অর্থাৎ ৬৮ জনের অদম্য সাহসী একটি গেরিলা যোদ্ধাদের দল পার্শ্ববর্তী বন্ধু প্রতীম রাষ্ট্র ভারতে আসামের তেজপুরস্থ সেনানিবাসে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন ছাত্রনেতা স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের (ইউকসু অর্থাৎ বুয়েট কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মন্ত্রী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) নেতৃত্বে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য ১১ নভেম্বর রাত ১০.৩০- এ স্বদেশে প্রবেশকালে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেতিয়ারা নামক স্থানে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের আকস্মিক আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে ত্বরিত প্রতিরোধ যুদ্ধে ব্যাপৃত হন।
প্রশিক্ষণ শেষে শহীদ নিজামউদ্দিন আজাদ গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী নিয়ে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য ভারতের ভৈরব টিলা থেকে যাত্রা শুরু
করেন। কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বেতিয়ারা নামক স্থান দিয়ে সি এম রোড (বর্তমান ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক) অতিক্রম করে স্বদেশে প্রবেশকালে রাস্তার অপর পার থেকে ওঁৎপেতে থাকা পাক সেনাদের কাছ থেকে হঠাৎ‘হ্যান্ডস আপ’ কমান্ড ভেসে আসে। তিনি বিশেষ গেরিলা বাহিনীটির অগ্রগামী কমান্ডটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সাথে সাথে তিনি বুঝে যান সামনে সমূহ বিপদ। শত্রুদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে তিনি যোদ্ধাদের রক্ষার জন্য অস্ত্র হাতে সবার সামনে রুখে দাঁড়ান।
শত্রুদের বজ্রগর্জনের “হল্ট” উপেক্ষা করে গর্জে উঠে তাঁর হাতের স্টেন গান, গর্জে উঠলো কয়েকজনের রাইফেল, লুটিয়ে পড়ে শত্রুরা। এসময় হয়তো তাঁর সুযোগ ছিল নিভৃতে নিজের প্রাণ রক্ষার। কিন্তু যোদ্ধাদের ফেলে রেখে তিনি পেছনে ফিরে যেতে চাননি। তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে প্রতিরোধ ব্যূহ রচনা করে নিজের যোদ্ধাদের নিরাপদে পশ্চাদপসরণের সুযোগ করে দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর অস্ত্র নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং আহতাবস্থায় শত্রু বাহিনী তাঁকেসহ তিনজনকে আহতাবস্থায় গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
এ সময় ঘটনাস্থলে শহীদ হন ছয়জন- শহীদ জহিরুল হক ভুঁইয়া (দুদু মিয়া), শহীদ শহীদুল্লাহ্ সাউদ, শহীদ আব্দুল কাইউম, শহীদ আওলাদ হোসেন, শহীদ আব্দুল কাদের ও শহীদ মোহাম্মদ সফিউল্লাহ।
আহতাবস্থায় গ্রেফতারকৃত শহীদ নিজামউদ্দিন আজাদ, শহীদ সিরাজুম মুনীর জাহাঙ্গীর, শহীদ বশিরুল ইসলাম (বশির মাস্টার)- কে বহু অনুসন্ধানের পরও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি- দেশ মাতৃকার জন্য এই অকুতোভয় বীরেরা তাঁদের প্রাণ বিলিয়ে দেন।
শহীদ নিজাম উদ্দিন আজাদের সাথে হারিয়ে যায় এদেশের ছাত্র-গণআন্দোলনের এক সম্ভাবনাময় আলোকবর্তিকা। আমরা হারাই সাহস, দৃঢ়তা এবং জন্ম-নেতৃত্ব বৈশিষ্ট্যের এক চমৎকার জিয়ন কাঠিকে।
(৪)
বেতিয়ারা রণাঙ্গনের নিকটবর্তী দুটি স্থান- ফেণী আর জগন্নাথ দিঘীতে তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত অবস্থান ছিল। রণাঙ্গনে আগ্নেয়াস্ত্রের গগনবিদারী গর্জনে প্রকম্পিত মুক্তিযোদ্ধারা দেখলেন রণাঙ্গনের দিকে ছুটে আসছে শয়ে শয়ে সার্চ লাইট- মেশিনগান আর সীমান্ত এলাকায় সাদা প্রস্তুত সশস্ত্র আর সু প্রশিক্ষিত সৈন্য বহনকারী ট্রাক।
গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুযোগ্য নেতা শ্রদ্ধেয় স্থপতি ইয়াফেস ওসমান প্রশিক্ষণকালীন শিক্ষানুযায়ী তাঁর গেরিলা বাহিনীটিকে রক্ষার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর সময়োপযোগী ও সঠিক সিদ্ধান্তে অবশিষ্ট জীবিত মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ বহু সংগ্রামের পর বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে এলেন ভৈরব টিলায়। শ্রদ্ধেয় স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে বেঁচে গেলো প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও দক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের অমূল্য প্রাণ।
(৫)
ভৈরব টিলায়- পুর্বাকাশে তপন দেবের উত্থান হতে যাচ্ছে- শোকে মূহ্যমান মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি যেন দাঁড়াতে পারছেন না- তাঁদের প্রাণ প্রিয় আজাদ ভাই আর সহযোদ্ধাদের হারিয়ে তাঁরা যে মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন তা যেন কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।
এসময় এলেন তাঁদের প্রশিক্ষণকালীন কমান্ডার শ্রদ্ধেয় মঞ্জুরুল আহসান খান(সাবেক সভাপতি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর দ্বিতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষিণকালীন দলপতি)- অগ্নিঝড়া উজ্জীবিত ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন “কমরেডস – দ্যা ইন্টারন্যাশনাল।”
বেতিয়ারা রণাঙ্গনের প্রাণরক্ষা পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ঠে প্রকম্পিত হয়ে উঠলোঃ
“জাগো জাগো সর্বহারা
অনশন বন্দী ক্রীতদাস..
(৬)
শহীদদের রক্তে রঞ্জিত দৃঢ় শপথে বলিয়ান যোদ্ধা দলটি রওনা হলেন ফেণীর গুণবতী হয়ে ঢাকার পথে। পথে প্রবল পরাক্রমে শ্রদ্ধেয় স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের নেতৃত্বে বহুগুণে বজরা ও পানি এলার যুদ্ধে বহুসংখ্যক সেনায় সজ্জিত পাক সেনাদের ধ্বংস করে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ নরসিংদীর রায়পুরা, ডেমরা আর সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল হয়ে প্রবেশ করলেন ঢাকায়।
আজাদ আর তাঁর সতীর্থদের আত্নদানের সংবাদ স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়লো – ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ ও বিশেষায়িত গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত আর প্রশিক্ষণের জন্য অপেক্ষারত সকল সদস্য দৃপ্ত পদক্ষেপে ঢাকার দিকে এগিয়ে গেলেন- যেন আজাদের লেখা শেষ চিঠির কথামালাগুলোকে তাঁরাই বাস্তবায়ন করবেন-
“…আমাদের একটাই চিন্তা,একটাই তপস্যা মা কে মুক্ত করবো, এর মধ্যে দুর্বলতার কোন স্থান নেই, মানুসিক অশান্তির কোনও সুযোগ নেই, পেছন ফিরে তাকাবার কোনও সময় নেই…”
দেশ স্বাধীন হলো- বিধ্বস্ত শহীদ মিনারে গেরিলা বাহিনীর ১ম ব্যাচের বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদের প্রাণপ্রিয় বন্ধু শ্রদ্ধেয় মাহবুব জামান (বর্তমানে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রযুক্তি রপ্তানীকারক ডাটা সফটের কর্ণধার) আর স্নেহের রাজনৈতিক অনুজ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসাসহ (বিশিষ্ট সাংবাদিক – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী) কজনে মিলে অস্ত্র উঁচিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়বার দৃঢ় শপথ নিলেন- প্রয়াত ও স্বনামখ্যাত আলোকচিত্র শিল্পী আব্দুর রশিদের ক্যামেরায় বন্দী হয়ে সৃষ্টি করলেন ইতিহাস।
আজাদের আরেক রাজনৈতিক অনুজ বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা প্রতিভা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা কলেজের সাবেক সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক (১৯৭১) প্রয়াত খান মোহাম্মদ ফরাবী (২৮ জুলাই, ১৯৫২- ১৪ মে, ১৯৭৪) রচনা করলেন “ঈশ্বর বাতি জ্বেলে দাও (আজাদ ভাইকে)-
‘হে ঈশ্বর বাতি জ্বেলে দাও’…..
এ রৌদ্রময় চিৎকার বিদ্রোহের ঐশ্বর্য নিয়ে ভেসে যেতো
ঢাকা কলেজের বারান্দায় আছড়ে পড়া ভালোবাসা নিয়ে
দেয়ালের বাঁধন এড়িয়ে এ রৌদ্রের শ্লোগান মিছিল হয়ে যেতো।
রাজপথে আকাংক্ষার শিশুদের নিয়ে খেলা হতো
তার মানে তোমার চিৎকার
‘ঈশ্বর বাতি জ্বেলে দাও’।
মরুভুমি বাংলার বৃক্ষের সাধনা যারা করে গেলো বেপরোয়া
রাতে
তাদের জন্য আমরা কি দিতে পারি বলো?
তবুওতো বিধ্বস্ত গ্রামে ও নগরে বাংলাদেশ শোক হয়ে
গেছে আজকাল
শোকের মাঝে ও যেন সূর্য জলে তোমার শ্লোগান
রক্তের মার্টি থেকে জেগে উঠে তুমি আজ একাই মিছিল
আশ্বস্ত তোমার আজও প্রত্যয়হীনতার বুকে দুটা ছুরি।
সেই যে অন্ধকার আহা বড় অন্ধকার সময়েরা তখন
চিৎকার করে যেতো কারা।
নির্দ্ধিধায় ভেঙ্গে যেতো লাঞ্ছিত ছলনার কারা’
রৌদ্রের ওপারে তুমি আজ রৌদ্রের সেই চীৎকার
ঈশ্বর বাতি জ্বালো…..বাতি জ্বেলে দাও ঈশ্বর…..
আমাদের রৌদ্রেহীনতায় তুষ্ণার্ত পথে
আমাদের প্রত্যেক মিছিলের রাজপথে
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াবার সশব্দ প্রেরণায়
তুমি আজ ঈশ্ববের বাতি
ঈশ্বর বাতি জ্বালো…..বাতি জ্বেলে দাও ঈশ্বর..”
(৭)
বেতিয়ারা গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দারা ধানক্ষেত থেকে ৬ শহীদের দেহাবশেষ উদ্ধার করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে সমাহিত করেন।
২৮ নভেম্বর ১৯৭১ চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথদীঘি অঞ্চল শত্রুমুক্ত হওয়ার পর এই বীরদের গণকবরের ওপর স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
স্বাধীনত্তোর সময়ে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর আরেকজন উল্লেখযোগ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রদ্ধেয় জনাব ওমর ফারুক (কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি, কুমিল্লা জেলা পরিষদের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সম্মানিত সহসভাপতি) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পর্বতসংকুল প্রতিকূলতার মধ্যে এই বীরদের স্মৃতিতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করার প্রচেষ্টা শুরু করেন।
যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭৩ সালের ১১নভেম্বর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রাক্তন সভাপতি কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে একটি স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করা হয়।
সর্বশেষ ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পুননির্মাণকালে (চার লেনের বিস্তৃতির সময়) মহাসড়কের পাশে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে ও অর্থানুকুলে আধুনিক শৈলীতে গণকবরটি পাকাকরা সহ একটি সুদৃশ্য স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় যা বিশাল হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বদন্যতা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকল শক্তিকে (দল ও মত নির্বিশেষে) তাঁর অন্তরে ধারন করার ক্ষমতা ও সদিচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ।
কিন্তু,অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিষয় হলো স্মৃতিসৌধটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধিগ্রহণকৃত জায়গার উপর নির্মিত এবং আইনগতভাবে এটি অস্থায়ী। অন্যদিকে নির্মাণকারি প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত নি¤œ শ্রেণীর উপকরণ ব্যবহার করে স্মৃতিসৌধটির নির্মাণ কাজ শেষ করে। যার কারণে মিনারটির নির্মাণের মাত্র দু’বছরের মধ্যেই বিপদজনকভাবে হেলে পড়ছে। এমনকি কবরে স্থাপিত টাইলস খুলে আপনা আপনি খসে পরছে। স্মৃতিসৌধের সামনের অংশে বামদিকের দেয়ালটির নির্মাণের এক বছরের মধ্যেই ভেঙে পড়ে যায়। কবরে কোন নাম ফলক নেই এমনকি স্মৃতিসৌধের কোন প্রবেশ দ্বারও নেই।
দুঃখের বিষয় হলো, সরকারীভাবে আজ পর্যন্ত বেতিয়ারার সম্মুখ রণাঙ্গণ, বেতিয়ারার অমর শহীদ বা ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ইতিহাস সরকারীভাবে সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা হয় নাই।
প্রতি বছর ১১ নভেম্বর শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বেতিয়ার দিবস পালন করা হয়। বেতিয়ারা প্রান্তরে সেই রাতে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার কাছে দিনটির গুরুত্ব বিশেষ আবেগ ও অনুভুতির। বেতিয়ারা দিবস স্মৃতি চিরন্তন হয়ে আমাদের উজ্জীবিত করে যাবে অনন্তকাল। অথচ, সরকারী উদ্যোগে বেতিয়ারা দিবস পালনের কোন উদ্যোগ কখনো নেয়া হয়নি।
বেতিয়ারার নয় শহীদদের কেউই সরকারিভাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দের তালিকায় আসেননি।
১১ নভেম্বর দিনটি প্রতি বছর সব মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়। সহযোদ্ধারা রণাঙ্গনের স্মৃতিচারণের পাশাপাশি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও বেতিয়ারার জীবিত সকল যোদ্ধাদের উপস্থিতিতে বেতিয়ারার সেই ঐতিহাসিক প্রান্তে স্মরণানুষ্ঠান ও মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের মাধ্যমে বেতিয়ারা দিবস উদযাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ দিবস উপলক্ষে ২০১৫ সন থেকে প্রতি বছর আমি একটি স্মরণিকা প্রকাশ করেছি। এছাড়াও একটি প্রামাণ্য চলচিত্র বিনির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম অর্থাভাবে যা এখন স্থগিত আছে।
২০১৭ সালে বেতিয়ারা দিবসের প্রাক্কালে আমি ব্যক্তিগত অর্থায়নে ও উদ্যোগে সমাধিস্থল ও স্মৃতিসৌধটি মেরামত করি। স্মৃতিসৌধটির প্রবেশপথে একটি নামফলক ও একটি সমাধিফলক স্থাপন করি এবং পুষ্পবনে শোভিত করি।
কিন্তু নির্মাণ শৈলীর ত্রুটির কারণে সমগ্র স্মৃতিসৌধ ক্রমাগত মাটির নীচে ডেবে যাচ্ছে যা মেরামতের অযোগ্য বলে স্থপতিগণ ইতিমধ্যে নিশ্চিত করেছেন।
স্মৃতিসৌধটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধিগ্রহণকৃত জায়গার উপর নির্মিত এবং আইনগতভাবে এটি অস্থায়ী তাই এখানে ব্যক্তি উদ্যোগে স্মৃতি সৌধ পুনঃ নির্মানের কোন সুযোগ নেই।
অবহেলায় বঞ্চনায় বাংলার অমর শহীদরা আজ নিভৃতে শুয়ে আছেন। তাঁদের আত্নত্যাগে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ মনে করিয়ে দেয় প্রয়াত খান আতাউর রহমানের গানের সেই পংক্তিগুচ্ছ:
“হয়তো বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না/বড় বড় লোকেদের ভীড়ে
জ্ঞানী আর গুনীদের আসরে/তোমাদের কথা কেউ কবে না”
(৮)
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর জীবিত সংগঠক, নেতৃবৃন্দ, শহীদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ, বেতিয়ারা রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধা,বেতিয়ারার স্থানীয় আপামর জনতা তথা দলমত নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকল শক্তির পক্ষ থেকে জাতীয় নেতা পংকজ ভট্টাচার্য সর্বশেষ ঐতিহাসিক বেতিয়ারা দিবসে (১১ নভেম্বর ২০১৭) বেতিয়ারা রণাঙ্গনের স্মরণসভায় মাননীয় সরকারের কাছে নিম্ন লিখিত দাবি সমূহ উত্থাপন করেন:
ক) ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ও ঐতিহাসিক বেতিয়ারা শহীদ দিবসের ইতিহাস সরকারীভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা।
খ) বেতিয়ারা রণাঙ্গণের সম্মুখ যুদ্ধের কাহিনী ও শহীদদের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা।
গ) বেতিয়ারার বর্তমান অনন্য শিল্পসৌন্দর্যময় স্মৃতিসৌধটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধিগ্রহণকৃত যে স্থানটিতে অস্থায়ীভাবে নির্মিত হয়েছে সে স্থানটিসহ স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন জমি বেতিয়ারা স্মৃতিসৌধের জন্য স্থায়ীভাবে বরাদ্দ প্রদান করা।
ঘ) স্মৃতিসৌধটির ক্ষতিগস্ত অংশটুকু যতদ্রæত সম্ভব সংস্কার করা স্মৃতিসৌধটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রদানের নিমিত্তে অবিলম্বে বেতিয়ারায় একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ করা প্রয়োজন। অতিসত্বর কবরে নাম ফলক স্থাপন ও স্মৃতিসৌধের প্রবেশদ্বার স্থাপন করা।
ঙ) বেতিয়ারা স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদেও স্মৃতি ভাস্কর্য ও একটি পাঠাগার স্থাপন করা।
চ) বেতিয়ারায় বীর শহীদদের জন্মস্থানসমুহের সড়কের নাম শহীদদের নামে নামকরণ করা ও তাঁদের প্রতিকৃতিসহ তোরণ নির্মাণ করা।
ছ) সরকারী উদ্যোগে বেতিয়ারা দিবস পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করা ও শহীদ দিবসে কুমিল্লার জেলাপ্রশাসক এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে এই বীর শহীদগণকে সরকারীভাবে গার্ড অব অনার প্রদান করা।
জ) বেতিয়ারার অন্যতম শহীদ মোহাম্মদ শফিউল্লাহর মা শহীদ জননি রজবুন্নেসার জন্য বিশেষ সম্মাননা ও অনুদান প্রদান করা।
ঝ) বেতিয়ারায় বীর শহীদদের জন্মস্থানসমুহে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানসমুহকে সরকারী অনুদান ও প্রণোদনা প্রদান করা- বিশেষতঃ নরসিংদির রায়পুরার উপজেলার কান্দাপাড়াস্থ গ্রামে স্থাপিত “কান্দাপাড়া শহীদ বশিরুল ইসলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের” জন্য প্রতিশ্রুত একটি তিনতলা দালান নির্মাণের কাজ শুরু করা এবং বিদ্যালয়টিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা ।
ঞ) বেতিয়ারায় বীর শহীদদের জন্মস্থানসমুহের জেলাগুলোর সরকারী ওয়েবসাইটে ঐতিহাসিক বেতিয়ারা শহীদ দিবসের ইতিহাস ও শহীদদের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করা।
ট) নির্মিতব্য প্রামাণ্য চলচিত্রটির জন্য সরকারী অনুদানের ব্যবস্থা করা ও একটি পূর্ণাঙ্গ চলচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
এসময় তিনি আরো বলেন “আমরা মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকল শ্রেনী ও পেশার মানুষের উপরিউক্ত প্রয়োজনীয় কাজসমূহ দ্রুলত সম্পন্ন করার তাগিদ রয়েছে। সরকারসহ সকলকে তাই আমরা আহবান জানাই, আসুন আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি বেতিয়ারার বীর মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে। শহীদদের বিদেহী আত্মার প্রতি জানাই যথাযথ সম্মান।
আমরা সশ্রদ্ধ সালাম, অভিবাদন জানাই বেতিয়ারার শহীদসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদগণকে। সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি জাতির পিতা মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাসিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চারনেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সকল সংগঠকগণকে।
বেতিয়ারা শহীদ দিবস দিবস অমর হোক। জয় বাংলা।”
তখন বিকেল পৌনে চারটা শ্রদ্ধেয় পঙ্কজ ভট্টাচার্য এর বক্তব্য শেষ হবার পূর্বেই জগন্নাথ দীঘি ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য আবুল কাশেম মোল্লা, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক শাহজালাল মজুমদার ও কুমিল্লা জেলা পরিষদের সদস্য ফারুক আহমেদ মিয়াজীর নেতৃত্বে শতাধিক সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন পূর্ব স্মরণ সভায় আগত সভ্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমি তাঁদের নিবৃত্ত করতে গেলে তাঁরা আমায় শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করেন। এসময় তাঁরা দাবি করেন- শ্রদ্ধেয় পঙ্কজ ভট্টাচার্য সরকার বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন এবং ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ ও বিশেষায়িত গেরিলা বাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। তাঁরা স্মৃতিসৌধে ও সমাধিস্থলে জুতো পায়ে উঠে ভাঙচুর করেন যা ১২ নভেম্বর ২০১৭ তে প্রথম আলোসহ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২-এ অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আহবান জানান। এই আহবানে সাড়া দিয়ে ৩০ জানুয়ারি ৭২ রবিবার ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ ও বিশেষায়িত গেরিলা কমান্ডের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী অস্ত্র জমা দেওয়া হয়। ঢাকা স্টেডিয়ামের অস্ত্র জমা দান অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানান গেরিলা বাহিনীর আহবায়ক মোহাম্মদ ফরহাদ এবং মাল্যভূষিত করেন ন্যাপের পক্ষে সহ-সভাপতি চৌধুরী হারুনুর রশীদ, কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে সাধারণ সম্পাদক বারীণ দত্ত (আব্দুস সালাম) এবং ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে সহ-সভাপতি আবুল হাসনাত। এসময় বঙ্গবন্ধু তাঁকে গার্ড অব অনার পরিদর্শন প্রদান করেন। বিশেষ গেরিলা বাহিনীর আহবায়ক মোহাম্মদ ফরহাদ গেরিলা কমান্ডারদের বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমাদানের নির্দেশ ঘোষণা করেন। ন্যাপের পক্ষ থেকে পংকজ ভট্টচার্য, কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ওসমান গণি এবং ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দেন।
(৯)
শহীদ নিজামউদ্দিন আজাদের পিতা প্রয়াত জনাব কামরুদ্দীন আহমদ মুসলিমলীগের সামন্ত প্রভাবিত ও রক্ষণশীল নেত্বতৃর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী তরুণ তুর্কীদের একজন ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের তীক্ষ বিশ্লেষক ছিলেন তিনি। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো প্রগতিশীল, অগ্রসর, বিজ্ঞান মনস্ক। কামরুদ্দীন আহমদ রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনেই। তৎকালীন আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে খেলাফত আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের অবসান চেয়ে আন্দোলন করে একটি উন্মাদনা জাগিয়েছিল। এই নব ধারার বিপ্লবী ভাবধারা আর সব তরুণদের মতো কামরুদ্দীন আহমদ সাহেবের রাজনৈতিক জীবনকেও প্রভাবিত করতে শুরু করে। তাই রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে ১৯৪০ সনের মার্চ মাসের পর তিনি মুসলিম লীগে সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। কিন্তু দেশ ভাগের উত্তরকালে মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকান্ডের জন্য তিনি এ দল ত্যা গ করেন। তিনি ছিলেন ১৯৪৭ সালে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য। ১৯৫৩ সনে জাতি সংঘে সাধারণ পরিষদে ও ১৯৫৭ সনে তিনি জাতিসংঘের সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে যান।
একমাত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বাদ দিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন। একে বলা হয় আমাদের আত্নবিস্কার বাঁ স্বরূপ- অনেষার সূচনালগ্ন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ এই মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই উপ্ত ছিল।
আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনও মুক্তিযুদ্ধে কামরুদ্দীন আহমদের ভূমিকা স্মরণযোগ্য। পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিকে ঢাকাকেন্দ্রিক সমাজতান্ত্রিক-প্রগতিবাদী রাজনীতির বিকাশে তার অবদান আছে। বাঙালি মুসলমান সমাজের উত্থানের সূত্রকে সমাজতাত্তিকভাবে শনাক্ত করে তিনি আমাদের কাছে মূলত বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের গঠন পর্বকেই তুলে ধরেছেন।
পাকিস্তানোত্তর কালে এদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। চল্লিশের দশকে আবুল হাশিম সাহেব বঙ্গীয় মুসলিমলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে, বঙ্গবন্ধু, শামসুল হক, তাজউদ্দীন আহমদ সহ যে ক’জন প্রগতিশীল তরুণকে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সৈনিক তৈরি করে ছিলেন, কামরুদ্দীন আহমদ তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। মুসলিম লীগে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন এর অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অংশ সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের উপদলের অন্তর্ভুক্ত। ঢাকায় তাঁর গুরু ছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ ও শামসুল হক। “তাজউদ্দীনের ডায়েরী” প্রথম খন্ডে আমি দেখতে পাই তাঁরা একটি শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন।
আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব বা মহত্ত্ব কেবলমাত্র ২১ শে ফেব্রুয়ারী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দবিতে ছাত্রদের মিছিল-সংগ্রাম ও শহীদদের আত্নদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেরনি। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি নিয়ে তৎকালীন পূর্ব বাঙলার মানুষ কিংবা তার সচেতন অংশটির মধ্যে ১৯৪৮ কিংবা তারও আগের চিন্তাভাবনা শুরু হয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর সুত্রপাত হয় ১৯৪৭ সালে গণআজাদী লীগ (Peoples Freedom League) গঠনের মাধ্যমে যার আহ্বায়ক ছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ। এই সংগঠনটির বৈঠকগুলো অনুষ্ঠিত হতো কামরুদ্দীন আহমদ সাহেবের ঢাকাস্থ ১৫০ নং মোগলটুলির বাসায়। তাজউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ এবং কামরুদ্দীন আহমদ সাহেব যৌথভাবে কিছুসংখ্যক কর্মীদের একত্রিত করে করেন। এঁরা, সকলেই মুসলিম লীগের উপর আস্থা হারিয়েছিলেন এবং স্বাধীনতার পর এদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি গঠনের চিন্তা করেছিলেন। তাঁদের ম্যানিফেস্টোতে তাঁরা বলেছিলেন-
“মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে এবং বাংলা আমাদের মাতৃভাষা”
গণআজাদী লীগের এই ঘোষণাটিতে শিক্ষা ও ভাষা বিষয়ে যে দাবী করা হয় সেটা বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টো ব্যাতীত এই জাতীয় অন্য কোন দলিলে পূর্বে দেখা যায়নি। সুতরাঙ নির্দ্বিধায় বলা যায় আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের তথা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ এই গণআজাদী লীগ গঠনের মধ্যেই উপ্ত ছিল আর কামরুদ্দীন আহমদ সাহেব ছিলেন এই অসাধারণ উদ্যোগটির উদ্যোক্তা।
তাঁর এই উদ্যোগের কারণে দেশভাগের পর তাঁকে সপরিবারে তাঁর বাড়ি থেকে ২৪ আগস্ট ১৯৪৭ -এ বিনা নোটিশে তাঁকে তাঁর বাড়ি থেকে সপরিবারে উচ্ছেদ করা হয়। এসময় শহীদ নিজামউদ্দিন আজাদের বয়স ছিল ৯ দিন।
২২ ডিসেম্বর ১৯৭২ বিকেলে প্রয়াত তাজউদ্দিন আহমেদ সাহেব তাঁর সাথে দেখা করতে এসে তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এবং প্রধান বিচারপতি হবার অনুরোধ করলে তিনি তা ফিরিয়ে দেন এ বলে যে এতে করে তাঁর শহীদ সন্তানের বিদেহী আত্নার প্রতি অসম্মান করা হবে।
(১০)
শহীদ নিজামউদ্দিন আজাদের প্রয়াণে তাঁর পিতা তাঁর প্রখ্যাত “Socio Political History of Bangladesh” বইতে কবি John Donn-এর ভাষায় তাঁর অনুভ‚তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন-
Any man’s death diminishes me
because I am involved in mankind.
And therefore never send to know for
Whom the bell tolls, it tolls for thee
এই পংক্তিগুলোই তাঁর বেদনাকে যথার্থভাবে প্রকাশ করে।
শহীদ নিজামউদ্দিন আজাদেরা ছিলেন তিন ভাই এবং এক বোন। সর্বজ্যেষ্ঠ প্রয়াত জহির উদ্দীন মাহমুদ, এরপর প্রয়াত মহিউদ্দীন খালেদ এবং ভাইদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ নিজামউদ্দিন আজাদ। তাঁদের একমাত্র বোন সালমা আহমেদ একজন গৃহিণী। অত্যন্ত মর্মান্তিক বিষয় হলো তার দুই ভাইকেই স্বাধীন বাংলাদেশে হত্যা করা হয়। জহির উদ্দীন মাহমুদ নিহত হন ১২ মার্চ ১৯৭৯ তে আর মহিউদ্দীন খালেদ ১৮ মে ১৯৯৯ তে। এসকল হত্যাকান্ডের বিচার আজও হয়নি।
আমি শহীদ নিজাম উদ্দীনের ভাতৃষ্পুত্র- হিসেবে শহীদদের আত্নদানে বলিয়ান হয়ে তাঁদের স্বপ্নের সমাজতান্ত্রিক প্রগতিশীল বাংলাদেশের কামনা করছি ও বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ
১) “তাজউদ্দীনের ডায়েরী” প্রথম খন্ড/তাজউদ্দীন আহমেস
২) পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি (১৯৭৬)/কামরুদ্দীন আহমদ
(৩)বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ (দুই খন্ড)/কামরুদ্দীন আহমদ
(৪)স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অত:পর (১৯৭৯)/কামরুদ্দীন আহমদ
(৫)বেতিয়ারা সংকলন ২০১৭/২০১৮/ সম্পাদনাঃ
ইফতেখার খালিদ
১৪ আগস্ট ২০১৮
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..           

‘‘আমাদের বিক্রমপুরআমাদের খবর

আমাদের সাথেই থাকুনবিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’

Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com

আমাদের পেইজ লাইক দিন শেয়ার করুন

জাস্ট এখানে ক্লিক করুন। https://www.facebook.com/BikrampurKhobor

email – bikrampurkhobor@gmail.com

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন