প্রকাশিত : শনিবার,১৭ অক্টোবর ২০২০ইং ।। ১লা কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)।। ৩০শে সফর,১৪৪২ হিজরী
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : আজ শনিবার পয়লা কার্তিক বাউল সম্রাট লালন সাঁইয়ের ১৩০তম তিরোধান দিবস (মৃত্যুবার্ষিকী)। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন আখড়াবাড়িতে এ দিনে লালন স্মরণোৎসব ও মেলা হলেও এবার মহামারী করোনার কারণে সে অনুষ্ঠান হচ্ছে না। লালন একাডেমি এ স্মরণোৎসব বাতিল করেছে।
বাংলা ১২৯৭ সালের পয়লা কার্তিক সাধক পুরুষ লালন সাঁই দেহত্যাগ করেন। এরপর থেকে লালনের অনুসারীরা প্রতি বছর ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করে আসছেন। তবে লালন একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর এ আয়োজনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। কেনো বছর সাঁইজির তিরোধান দিবস ঘিরে ৫ দিন আবার কোনো বছর তিনদিনের অনুষ্ঠান হতো আখড়া বাড়িতে। স্মরণোৎসবের কয়েকদিন আগে থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে লালন ভক্তরা এসে একাডেমি ভবনের নিচতলার পুরো মেঝে জুড়ে আসন পেতে বসতেন। আর উৎসবের দিনগুলোতে আখড়া বাড়ির আঙ্গিনা ছাড়িয়ে মরা কালী নদীর পাড় অবধি বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে হাট বসতো বাউল সাধুদের।
তবে এবারের দৃশ্যপট আলাদা, পুরো আখড়া বাড়ি জুড়ে সুনসান নীরবতা। আখড়া বাড়ির প্রধান ফটকে ঝুলছে তালা। কারণ, করোনা পরিস্তিতিতে লালন একাডেমি কর্তৃপক্ষ এক সভায় এবারের তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠান বাতিল করে দেয়। তাই এবার সহজ মানুষদের মহা সম্মিলন হচ্ছে না। হচ্ছে না গুরু শিষ্যের ভাবের আদান প্রদান। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মুক্তির পথ খুঁজে বেড়ানো মানুষগুলো এবারের তিরোধান দিবসে সাঁইজিকে স্মরণ করবেন নিজ নিজ ধামে।
পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে পরে বড় পরিসরে উৎসবের আয়োজন করা হবে বলে জানান লালন একাডেমীর সভাপতি ও জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আসলাম হোসেন জানান,’এ বছর করোনার কারণে তিরোধান দিবসটি আমরা স্থগিত করেছি। লালনের এই সমাবেশে হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়। সেক্ষেত্রে করোনার সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, তাই এ বছর এ সিদ্ধান্ত।’
বাউল জীবনধারার প্রাণপুরুষ, আধ্যাত্মিক সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক এবং অসংখ্য বাউল গানের স্রষ্টা, ফকির লালন সাঁই এর জীবন সম্পর্কে কোন বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। এমনকি, তাঁর জন্ম তারিখ নিয়ে এযাবতকালে সঠিক কোন তথ্যও পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ মনে করেন যে তাঁর জন্ম ১৭৭২ সালের ১৪ অক্টোবর, আবার অধিকাংশ গবেষকই মনে করেন যে তাঁর জন্ম ১৭৭৪ সালের ১৭ অক্টোবর।
লালনের জন্ম আসলে কোথায় তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক । অনেক গবেষক মনে করেন লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালি থানার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। আবার এই মতের ভিন্নতা আনেন অনেকেই। তাদের মতে, ছেঁউড়িয়া থেকে ২০ কি.মি. দুরের একটা গ্রাম থেকে ১৫/১৬ বছরের একটা ছেলে হারিয়ে যায় আর তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে তাঁর আত্মীয় স্বজন বা পরিচিতরা কেউ চিনতে পারে না, একথা বিস্ময়করভাবে অযৌক্তিক। আবার লালন ফকিরের অন্যতম প্রবীণ ভক্ত পাঞ্জুশাহের ছেলে রফিউদ্দিন তার ভাবসঙ্গীত নামের গ্রন্থে লালন ফকিরের জন্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ড থানার হরিশপুর গ্রামে বলে জানান। এছাড়া ১৩৪৮ সালের মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার আষাঢ় সংখ্যায় লালনের জন্ম যশোর জেলার ফুলবাড়ি গ্রামের একটি মুসলিম পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয়। লালন হিন্দু না মুসলমান এনিয়ে বিস্তর মতভেদ। কারো মতে লালন কায়স্ত পরিবারের সন্তান যার পিতা মাধব এবং মাতা পদ্মাবতী, পরে লালন ধর্ম পরিবর্তন করেন। গবেষকদের একাংশ মনে করেন লালন মুসলিম তন্তুবায় পরিবারের সন্তান। পিতা দরিবুল্লাহ দেওয়ান, মাতার নাম আমিনা খাতুন।
মূলত লালনকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে গবেষকরা নানান সময়ে হিন্দু বা মুসলমান বানানোর চেষ্টা করেছেন। লালন ফকির হিন্দু না মুসলমান এই কৌতূহল ও প্রশ্নের মুখোমুখি লালনকেই হতে হয়েছে তাঁরই জীবদ্দশায়। মোদ্দাকথায়, তাঁর জন্ম ও ধর্ম সম্পর্কে আজো পর্যন্ত কোন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব হয়নি। তবে, তাঁর নামের বিষয়ে কিছু সুত্রে জানা যায় যে, প্রিয়জনেরা তাকে ‘নালন’ নামে ডাকতেন। নাল অর্থ উর্বর কৃষিজমি।
লালনের জীবন রহস্য নিয়ে যথার্থ উপসংহারটি টানে, তাঁর মৃত্যুর পনেরো দিন পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘হিতকরী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধ – সেখানে বলা হয়, “ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশত: কিছুই বলিতে পারে না।”
লালন ফকিরের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর রচিত গানে এর পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি মানবতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং সকল ধর্মের লোকের সাথেই তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। মুসলমানদের সাথে সুসম্পর্কের কারনে অনেকে তাকে মুসলমান বলে মনে করত। আবার কখনো বৈষ্ণবধর্মের মত পোষণ করতে দেখে হিন্দুরা তাঁকে বৈষ্ণব মনে করতো। প্রকৃতপক্ষে লালন ফকির কোন জাতিভেদ মানতেন না। তবে তিনি শ্রীকৃষ্ণের অবতার বিশ্বাস করতেন বলে কারও কারও কাছে জানা যায়। আর আল্লাহ, রসুলের কথা তাঁর অনেক গানেই পাওয়া যায়।
‘হিতকরী’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ নিবন্ধে আছে, লালন ফকির যৌবনকালে একবার তীর্থভ্রমণে বের হয়ে পথিমধ্যে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন সাথীরা তাঁকে পরিত্যাগ করে যার যার গন্তব্যে চলে যায়। কালিগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে উদ্ধার করেন কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামের সাধক মলম শাহ। মলম শাহ ও তদীয় স্ত্রী মতিজান তাকে বাড়িতে নিয়ে সেবা-শুশ্রষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এরপর লালন মলম শাহের কাছে প্রাথমিক দীক্ষা পান ও ছেঁউড়িয়াতে বসবাস করতে থাকেন। একসময় তিনি বিবাহ করেন এবং সামান্য কিছু জমি ও ঘরবাড়ি নিয়ে সংসার করতে থাকেন। কিন্তু তাঁর আধ্যাত্মিক গুণাবলী গোপন থাকেনি এবং এই কারনে অনেক শিষ্যও জুটে যায় তাঁর। এসময় লালন তৎকালে বিখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সংস্পর্শে আসেন ও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করেন।
এরপর, লালন ফকির ছেঁউড়িয়াতেই একটি আখড়া তৈরি করেন এবং শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতে থাকেন। তার শিষ্যরা তাঁকে ‘সাঁই’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি প্রতি শীতকালে একটি ভান্ডারা (মহোৎসব) আয়োজন করতেন। যেখানে সহস্রাধিক শিষ্য ও সম্প্রদায়ের লোক একত্রিত হতেন এবং সেখানে সংগীত, সাধনা ও নানা আধ্যাত্মিক বিষয়ে আলোচনা হত। চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর এবং দূরদূরান্তের অনেক মানুষ লালন ফকিরের শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিলেন তখন – শোনা যায়, তাঁর দশ সহস্রাধিক শিষ্য ছিল।
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অনেকের সাথেই লালন ফকিরের পরিচয় ছিল বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়। ঠাকুরদের জমিদারিতেই ছিল তাঁর বসবাস এবং ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা ছিলেন তিনি। কিন্তু এই ঠাকুরদের সঙ্গে লালন ফকিরের একবার সংঘর্ষ ঘটে। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন সেসময়। এরই একটি সংখ্যায় ঠাকুর-জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ ও তথ্য প্রকাশের সূত্র ধরে উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তারা বিষয়টি তদন্তে প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানে আসেন। এতে করে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ঠাকুর-জমিদারেরা। তাঁকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে লাঠিয়াল পাঠালে শিষ্যদের নিয়ে লালন ফকির সশস্ত্রভাবে জমিদারের লাঠিয়ালদের মোকাবিলা করেন এবং লাঠিয়াল বাহিনী পালিয়ে যায়। এর পর থেকে কাঙাল হরিনাথকে বিভিন্নভাবে রক্ষা করেছেন লালন ফকির। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, তখনকার শ্রেণীবিভক্ত সমাজেও লালন ফকির ও তাঁর অনুসারীদের অবস্থান ছিল শোষণের বিরুদ্ধে আর নিপীড়িতের পক্ষে।
লালন ফকিরে জীবদ্দশায় তার একমাত্র স্কেচটি তৈরী করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। লালন ফকিরের মৃত্যুর বছরখানেক আগে ৫ মে ১৮৮৯ সালে পদ্মায় তাঁর বোটে বসিয়ে তিনি এই পেন্সিল স্কেচটি করেন, যা কোলকাতার এক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। অবশ্য অনেকেই দাবী করেন যে, এই স্কেচটিতে লালন ফকিরের আসল চেহারা ফুটে ওঠেনি।
১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর, ফকির লালন সাঁই, ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর দিন ভোর পাঁচটা পর্যন্ত তিনি গানবাজনা করেন এবং এক সময় শিষ্যদের বলেন – “আমি চলিলাম’’। এর কিছুক্ষন পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর কোনও সুস্পষ্ট নির্দেশ বা ইচ্ছা না থাকায়, মৃত্যুর পর তাঁর জন্য, হিন্দু বা মুসলিম, কোন ধরনের ধর্মীয় রীতিই পালন করা হয়নি। তবে, তাঁরই এক পুরনো উপদেশ অনুসারে, আখড়ার মধ্যেই একটি ঘরে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর মৃত্যুর ১২ দিন পর মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত পাক্ষিক পত্রিকা ‘হিতকরী’তে সর্বপ্রথম তাঁকে “মহাত্মা” হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।
‘‘আমাদের বিক্রমপুর–আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন–বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’