নব তুষারের দিনে

0
11
নব তুষারের দিনে

প্রকাশিত: সোমবার,২ নভেম্বর ২০২০ইং ।। ১৭ই কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)।। ১৫ই রবিউল আউয়াল,১৪৪২ হিজরী। বিক্রমপুর খবর :

শাহাব আহমেদ
নভেম্বরের প্রথম দিন। বছরের প্রথম তুষার পড়তে শুরু করেছে। সাদা, বহুকোণের ফাবিনাচ্চি সিকোয়েন্সের মত বিস্ময় ধারনকারী অপূর্ব তুষার-ফুলগুলো উড়ছিল বাতাসে। শীত কনকনে নয়, তবে শীত মন্দও নয়। বাতাস আছে বেশ। বাল্টিক সাগর ও ফিন উপসাগরের হাওয়ার হুটোপুটি খেলার মাঠ এই শহর।
সকালে উঠে স্নানাদি সেরে সাড়ে দশটার দিকে আমরা পেত্রোভস্কি জাগ্সের দিকে হাঁটা শুরু করি। জাগ্স হলো ম্যারেজ প্যালেস। ৫-৭ মিনিটের পথ। নেভা নদীর তীরে নদীর দিকে তাকানো এক ঐশ্বর্যময় প্রাসাদ। বিপ্লবের আগে হয়তো কোনো বিত্তবানের বাসস্থান বা প্রমোদভবন ছিলো, এখন ম্যারেজ প্যালেস।
ওর বয়েস ১৯, আমার ২৮। কে বেশি বুদ্ধিপক্ক ছিলো বলা মুশকিল তবে অনুভূতির কলস ছিলো পরিপূর্ণ। আর ছিলো ইভান তুর্গেনেভের সেই মাথা ঘুরানোর মুহূর্ত:
“সুখের কোন আগামিকাল নেই, নেই গতকালও। অতিক্রান্তকে সে মনে রাখেনা, আগামীকে নিয়েও মাথা ঘামায়না। তার শুধু আছে বর্তমান, তাও আজকের সারাটি দিন নয়, শুধু এই মুহূর্তটি।”
আমরা সেই মুহূর্তের দিকে হাঁটছিলাম।
শ্বেতা পরেছে ব্লু ড্রেস, আর হলুদ ও বাদামীর উট-রঙা চেকের হাল্কা শরতের ওভারকোট। কাপড় কিনে শরীরের মাপ মত ড্রেসটি বানানো হয় তিন পাঁচেক আগে। তখনও তৈরী পোষাকের যুগ আসেনি। ওর পিঠের দুই-তৃতীয়াংশ ঢেকে বাদামি-সোনালি চুল।লম্বায় আমার প্রায় কাছাকাছি।
আমার গায়ে ধূসর স্যুট-কোট এবং ধূসর ভারী শীতের ওভারকোট। তখন একটাই ওভারকোট গায়ে শরৎ শীত ও আংশিক বসন্ত কাটতো আমার। মাথাভরা চুল ছিলো অবাধ্য ও নানা দিকে জিভ বাড়ানো। তুষারপাত শুরু হয় আমাদের যাত্রার মাঝপথে, “দেখো দেখো, প্রথম তুষার!”
দেখলাম।
ইতিমধ্যেই কত তুষারপাত দেখে ফেলেছি, কিন্তু ঠিক অমনটি নয়। প্রথম তুষার হল অকলুষ, অকল্কতার প্রতীক। আমাদের জীবন অনাঢ্য হলেও অনাসক্ত হবেনা, অবিমিশ্র ভালোবাসায় জড়াজড়ি করে থাকবো- যেন প্রথম তুষার তারই বার্তা নিয়ে এসেছে।
জাগসে পৌঁছে দেখি শিউলী, অনুরূপ, রেজাউল ও মৃণাল, ১৯৮২ সাল থেকে আমার সহপাঠি বন্ধুরা, এসে গেছে। ভলখভ শহর থেকে এসেছে শ্বেতার স্কুলের বান্ধবীরা : দুই ওলগা ও নাতাশা। এসেছে শ্বেতার বড় বোন ইউলিয়া, বোনজামাই ভোভা ও ওর আরও কিছু আত্মীয়-স্বজন। সবাই দাঁড়িয়ে আছি হলরুমের মত বিশাল এক কক্ষে। আমার মত জনা পাঁচেককে একে অন্যের পিঠে দাঁড় করালে সিলিংয়ের নাগাল পাওয়া যাবে। সামনে একটি বিশাল বন্ধ দরজা, তাও প্রায় আমার মত আড়াইজনের সমান উঁচু। পেছনে নেভা বইছে, চিরদিনের মত। ওপারে গ্রীষ্ম-উদ্যানের গাছগুলোর কিছুর পাতা ইতিমধ্যেই ঝরেছে, কিছু ঝরবে ঝরবে করে এখনও রঙিন।
দরজাখুলে এগিয়ে আসে সুন্দর পোষাকের হাসি মুখের এক নারী। বিয়ের রেজিস্টার। এক বিশাল হলের মাঝখানে দাঁড়াই দুজনে। সামনে একটি টেবিলের উল্টা দিকে দাঁড়িয়ে সেই মহিলা গৎবাঁধা কিছু শুভেচ্ছা বাণী পাঠ করার পরে আমাদের দুজনকে টেবিলের সামনে দুই চেয়ারে বসার আহ্বান জানায়। আমরা কাগজে স্বাক্ষর করি। তারপরে
আবার এসে হলের মাঝখানে দাঁড়াই। তার নির্দেশ মত, প্রথমে আমি শ্বেতার বাম হাতের অনামিকা আঙুলে আংটি পরিয়ে দেই। তারপরে সে আমার আঙুলে পরায়। স্বল্প দামের চৌদ্দ ক্যারেট সোনার সিম্পল দুটো বিয়ের আংটি। গত ২ মাস ধরে লেনিনগ্রাদ শহরের সবকটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো আংটি না পেয়ে আমার শাশুড়িকে যোগাযোগ করতে হয় তার ছোট শহর ভলখভে। সেখানে ৩২ বছর কিন্ডারগার্ডেনা শিক্ষকতা করার কারণে শহরে তাকে চিনতো। ১ জোড়া আংটির সন্ধান জুটে যায় পরিচিতি বা ব্লাতের মাধ্যমে। মা মেয়ে একদিন যায় আংটি কিনতে। ভলখভ বিদেশিদের জন্য রুদ্ধ শহর বলে আমি যেতে পারিনা। ১৯৮৮ সাল।
আমার আংটিটি আঙুলের মাপে হলেও ওর লম্বা ও সরু আঙুলে ওরটি হয় শিথিল। কিছু করার নেই, শিথিল আংটি ‘না-আংটি’র চেয়ে ভালো। আংটি পরানো শেষ হলে ঘোষণা করা হয়, তোমাদের এখন আইনত স্বামী ও স্ত্রী বলে ঘোষণা করা হলো, তোমরা এখন একে অন্যকে চুম্বন করতে পারো।
ঘরভরা লোকের সামনে আমাদের অফিশিয়াল চুম্বনের সময়ে নেপথ্যে বেজে ওঠে স্ফুর্তির “মেন্দেলসন মার্চ।”
রাশিয়ায় সব বিয়েতেই জার্মান কম্পোজারের এই মিউজিক বাজানো হয় আজও। মিউজিকের ঝংকারে ঝংকারে উড়াল ডানায় বের হয়ে আসি। বাইরে তুষার পড়া বন্ধ হয়নি। বরং একটু বেড়েছে। বাতাসে ঘুর্ণির সৃষ্টি করে কখনও কখনও চক্রাকারে, কার্পাস তুলো ওড়ে যেমন, তেমন সাদা সাদা
কণা।
ট্যাক্সি রেডি ছিল। আমরা একটিতে চড়ে বসি শ্বেতার দুই বান্ধবী সহ। কিরভ ব্রিজের ওপর দিয়ে নেভা পার হয়ে নামহীন শহীদদের স্মরণে তৈরি “মারসোভো পোলে” বা মার্চ ফিল্ডের শিখা অনির্বাণের কাছে এগিয়ে এসে ফুল রাখার নির্ধারিত স্থানে পুষ্প অর্পণ করি।
এটাই নিয়ম।
এই দেশে মোল্লা পাদ্রিরা বিয়ে করায় না, বিয়ের পরে বর-কনে গির্জা বা মসজিদে যায়না। যায় দেশের জন্য জীবন দেয়া শহীদদের স্মৃতি প্রান্তরে। “এই যে আমরা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি, তা তোমাদেরই উপহার। তোমরা জীবন দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে গেছো, ধন্যবাদ হে অচেনা বীর সেনানিরা।”
‘মার্সোভো পোলে’র ঘাস ও মাটি ইতিমধ্যেই ঢেকে গেছে তুষারের চিকন সাদা কার্পেটে। শুধু আমরাই নয় আরো গুটি দুই নবদম্পতি এসেছে সেখানে। এ ছাড়াও বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে ফুলদান করছে।
হাঁটতে হাঁটতে একটু এগিয়ে এসেছি বন্ধুদের সাথে। শুনতে পাই শ্বেতাকে ওর এক বান্ধবী বলে, “তোর বরটা ভালোরে, আমি ইতিমধ্যেই ওর প্রেমে পড়ে গেছি,সাবধানে রাখিস।”
ওদের ফুর্তির হাসি শুনি। এমন মস্করা ওখানে অস্বাভাবিক কিছু নয় এবং এ নিয়ে চোখ ট্যারা বা মুখ ব্যাকা করার কিছু নেই।
আবার গাড়িতে চড়ে বসি। নেভা নদীর বাঁধানো তীরের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাই অশ্বারোহী পিটারের মনুমেন্টের দিকে। পুশকিনের দেশপ্রেমের বিখ্যাত কবিতা “তাম্রের অশ্বারোহী” এই মূর্তি নিয়ে। লেনিনগ্রাদের অন্যতম প্রতীক এটি। আমরা এখানে কাটাই কিছুক্ষণ। এই সেই স্থান যেখানে হাজার বছরের রাশিয়ান সামন্ত ও স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি নাড়ানো ডিসেম্ব্রিস্ট বিদ্রোহ হয়েছিল ১৮২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এবং রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল সেই অভ্যুত্থান। এই প্রান্তরও রক্তের রং মাখা।
লেনিনগ্রাদে প্রতিটি ইঞ্চি জমিতে ইতিহাস ও রক্ত জড়াজড়ি করে আছে।
আমরা ঘরে ফিরে আসি।
মিচুরিন্সকায়া ১৯ নম্বর বাড়ির ২৬ নম্বর এপার্টমেন্ট। তিন পরিবারের একটি কমন এপার্টমেন্ট।
একটি রুম শ্বেতাদের। সেখানেই টেবিল ভরে খাদ্য ও পানীয়ের বন্দোবস্তো করা হয়েছে। দুর্ভিক্ষের বাজারে বহু সপ্তাহ ধরে একটু একটু করে আমার শাশুড়ি প্রায় সব দুস্প্রাপ্য খাবারগুলো জোগাড় করেছে। সাদা ও লাল ক্যাভিয়ার, রিগার স্প্রত ( এক ধরনের স্মোকড সুস্বাদু ক্যান ফিস ), শসার পিকল, ক্যানের বেগুন ভর্তা, বিভিন্ন ধরনের সালাদ, মাংস, মুরগি, শ্যাম্পেন, ওয়াইন ও কনিয়াক। টেবিল পরিপূর্ণ।
অতিথিরা মানে শ্বেতার তিনখালা ও তাদের ছেলেমেয়েরা, শ্বেতার বোন, বান্ধবীরা, আমার বন্ধুরা জড়ো হয়েছে। বড়পা দেশ থেকে পাঠিয়েছিল গোলাপী রংয়ের সুন্দর একটি সিল্কের শাড়ি। শিউলি শ্বেতাকে শাড়িটি পরিয়ে দেয় এবং আমি ওকে চিনতে পারিনা। এ যেন উরুকের বনে এককিদুকে বশ করার উর্বশী সামাত। অথবা কশ্যপ ঋষির দৃষ্টি সমুখে অপ্সরি মেনকা। আমি না-এনকিদু না-কশ্যপ ঋষি, রূপ- বিহ্বল!
টেবিলে খাওয়া দাওয়া পান আর গান চলতে থাকে। শ্যাম্পেনের সুমিষ্ট তরলের মত উচ্চারিত হয় টোস্ট।
তারপরে আসে নাচের সময়। খাওয়া দাওয়া প্রচুর হয়েছে, এবার তা নৃত্যের তালে হজম করার সময়। আমি শ্বেতাকে ধরে ধীরে নাচছি প্রায় আলিঙ্গনাবস্থায় আর শ্বেতার সিল্কের শাড়ির আচলটি হাতে নেড়ে চেড়ে, নাকে শুঁকে দেখছে ওর বয়স্ক নানী।
যেন ওর আঁচলে বেঁধে দিচ্ছে সুখ ও নিরাপত্তার মন্ত্রনা।
আপন নানী নয়, ওর মায়ের খালা, পরিবারের বয়স্কতম মুরুব্বি। আপন নানী অনাহার ও যক্ষায় মারা গেছে যুদ্ধের পর পর।
কতদিন হয়ে গেছে এই নানীও নেই। নেই সেইদিনের গান- গাওয়া, টোস্ট-বলা তিন খালার একজনও। মানুষ চলে যায়, পৃথিবী চলেও যায়না, থেমেও যায়না। পৃথিবী শ্বাস নেয়, হাওয়া বয়, বৃষ্টি ঝরে, পাতা দোলে, ফুল ফোটে, ফুল ঝরে যায়।
জাপানি প্রবাদ বাক্য বলে, “প্রেমের পথে হাঁটলে হাজার মাইলও এক মাইলের দূরত্বের চেয়ে বেশি মনে হয় না।”
৩২ বছর ধরে হাঁটছি, মনে হয় এক বছরও অতিক্রম হয়নি।
১১/১/২০

নিউজটি শেয়ার করুন .. ..

‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন