প্রকাশিত : বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, খ্রিষ্টাব্দ।। ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ(হেমন্তকাল)।। ১ জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরী।
বিক্রমপুর খবর : নিউজ ডেস্ক :
তিনি থাকবেন আমৃত্যু আমাদের অন্তরে
লেখক- মুনীর মোরশেদ
১৯৬০ সালে ব্রাহ্মণগাঁও হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করার সময় আমি তাঁকে দেখিনি।কারণ,স্কুলে যাওয়ার বয়স তখনও আমার হয়নি।আমি তখন কেবলি তিন বছরের এক শিশু।তিন বছরের এক শিশুর মনোজগতে মা-বাবা,ভাই-বোন ছাড়া অন্য কোনো মানুষের ছবি আঁকা হওয়ার কথা নয়।তাই তখন অবধি তাঁর কোনো ছবি আঁকা হয়নি আমার মনোজগতে। সে ছবি আমার মনোজগতে আঁকা হয়ে যায় আরও চার বছর পর।আমি তখন সাত বছেরর এক বালক,পড়ি ক্লাস থ্রিতে, ব্রাহ্মণগাঁও হাইস্কুলে। ১৯৬৪ সাল বিএসসি পাশ করে আবদুল জাব্বার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন একদা ছাত্র ছিলেন যেই স্কুলের, সেই ব্রাহ্মণগাঁও হাইস্কুলে। ঢের মনে পড়ে,ক্লাস থ্রিতে তিনি আমাদের বিজ্ঞান পড়াতেন।জোরালো আওয়াজ, স্পষ্ট উচ্চারণ ও সহজ ভাষায় তিনি আমাদের মননে অবলীলায় ঢুকিয়ে দিতেন বিজ্ঞানের কঠিন-নিরস বিষয়।তাঁর আপন ভাতিজা দেলোয়ার ছিল ক্লাস থ্রিতে আমার সহপাঠী। অবশ্য এক বছরের মাথায় ১৯৬৫ সালে সরকারি চাকরি পেয়ে তিনি চলে যান করাচী। যোগ দেন পাকিস্তান ব্যুরো অফ স্ট্যাটাটিক্সে।ইতোমধ্যে কেটে গেল কয়েক বছর।আবার তাঁর সাথে দেখা হলো ১৯৭০ সালে।বিয়ে করতে বাড়ি এসেছেন।আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র।তারপর দীর্ঘ বিরতি।ফের দেখা হলো দীর্ঘ ১৩ বছর পর,১৯৮৩ সালে।ততোদিনে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করে চাকরি করছি একটি খ্যাতনামা বিজ্ঞাপনী সংস্থায় আর বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। পিতা সুলতান আহমেদ ইত্যবসরে ব্রাহ্মণগাঁও হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। ঈদের ছুটিতে বেড়াতে এসেছি বড়’পা রওশন আরা বেগমের বাসায়। ভগ্নিপতি খলিলুর রহমান তখন লৌহজং উপজেলা শিক্ষা অফিসার।বড়’পার কনকসারের বাড়ি এসে শুনি,ঈদের ছুটিতে জাব্বার স্যারও বাড়ি এসেছেন।তিনি স্কুলের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রের সাথে প্রাক্তন ছাত্র সমিতি গঠনের সম্ভাব্যতা নিয়ে মতবিনিময় করবেন কনকসার বাজারে। ঐদিন বিকেলে আমি আমার ভগ্নিপতি স্কুলের ১৯৫৫ ব্যাচের ছাত্র,কিয়ৎকালের শিক্ষক ও লৌহজং উপজেলা শিক্ষা অফিসার খলিলুর রহমানের সাথে কনকসার বাজারে যাই।গিয়ে দেখি,সুধাংশু ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছেন আবদুল জাব্বার। এক-এক করে সমবেত হন ১৯৫৫ ব্যাচের ছাত্র ও স্কুলের শিক্ষক সাধন চন্দ্র দাস, লৌহজং কলেজের উপাধ্যক্ষ কেশব চন্দ্র দাস(ব্যাচ ১৯৬৪), মন্টু ঘোষ(ব্যাচ ১৯৬৯), রহুল আমিন মোড়ল (ব্যাচ ১৯৭০), ডা.গোবিন্দ চন্দ্র দাস (ব্যাচ ১৯৭১), খলিলুর রহমান(ব্যাচ ১৯৭১), নাছির উদ্দিন জুয়েল(ব্যাচ ১৯৮১) এবং আরও কেউ কেউ।দুধপট্টির টিনের ছাউনিতলায় আমরা সবাই সমবেত হই। জুয়েল তড়িৎগতিতে কয়েকটি চেয়ার ও টুলের ব্যবস্হা করে ফেলে। আবদুল জাব্বার তাঁর লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা উপস্হাপন করলে সবাই ব্যাপক উৎসাহ ও উল্লাসের সাথে সমর্থন করেন। সিদ্ধান্ত হয়, ঈদের পরদিন আমরা সবাই মিলিত হব স্কুল প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিক এক সভায়।এর আগে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এই সমাবেশের কথা মাইকযোগে প্রচার করা হবে সমগ্র লৌহজং উপজেলায়।পরদিন একটি কেরাইয়া নৌকায় মাইক লাগিয়ে প্রচারে নেমে পড়ে সর্বকনিষ্ঠ নাছির উদ্দিন জুয়েল।
১৯৮৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শতাধিক প্রাক্তন ছাত্র একটি সমিতি গঠনের লক্ষ্য নিয়ে সমবেত হয় স্কুল প্রাঙ্গণে।প্রাক্তন ছাত্র খলিলুর রহমানের(ব্যাচ ১৯৫৫) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেই সভায় প্রাক্তন ছাত্র ও স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান একেএম নুরুল হক মোড়লকে(ব্যাচ ১৯৫৯) আহ্বায়ক ও আবদুল জাব্বারকে(ব্যাচ ১৯৬০) যুগ্ম আহ্বায়ক করে ৯-সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়।সেই কমিটিতে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলাম আমি মুনীর মোরশেদ(ব্যাচ ১৯৭২)।একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য কমিটির ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়।আবদুল জাব্বার দ্রুততম সময়ের মধ্যে গঠনতন্ত্রের একটি খসড়া তৈরি করে তা আহ্বায়ক কমিটির কাছে পেশ করেন।প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন ও পরিমার্জনের পর সেটি অনুমোদিত হলে সেই গঠনতন্ত্র মোতাবেক ১৯৮৩ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ব্রাহ্মণগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র সমিতির প্রথম সাধারণ সভা।সাধারণ সভার সকল প্রস্তুতি কাজে আমিই ছিলাম আবদুল জাব্বারের সার্বক্ষণিক সাথি।সেই সভায় সবচেয়ে সিনিয়র প্রাক্তন ছাত্র, বাংলাদেশ সরকারের উপ সচিব কাজী খলিলুর রহমানকে (ব্যাচ ১৯৪৮) সভাপতি ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপ পরিচালক আবদুল জাব্বারকে(ব্যাচ ১৯৬০)সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় ২১- সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি।সেই কমিটিতে সহ সভাপতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন মো.খলিলুর রহমান(ব্যাচ ১৯৫৫) এবং আমি মুনীর মোরশেদ(ব্যাচ ১৯৭২) হই প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক।
১৯৮৪ সালের ৫ অক্টোবর স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। স্মরণিকা সম্পাদনা ও প্রকাশের দায়িত্ব অর্পিত হয় আমার ওপর।আমি স্মরণিকাটির নামকরণ করি ‘স্মৃতির প্রদীপ জ্বলছে অনির্বাণ’।আজিমপুরের প্যারামাউন্ট প্রেসে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা হতে রাত ১০টা অবধি একটানা দুই সপ্তাহ কাজ করে সম্পন্ন করি স্মরণিকার কাজ।জাব্বার স্যার মাঝেমাঝেই কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য ঢুঁ মারতেন প্রেসে। এই স্মরণিকার উপদেশকও ছিলেন তিনি।
পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের পরপরই আমি সরকারি চাকরি নিয়ে চলে যাই চট্টগ্রাম। যোগ দিই সমবায় অধিদফতরে, সহকারী নিবন্ধক পদে।৬ বছর পর ১৯৯০ সালে আমি যখন তৎকালীন ত্রাণমন্ত্রী মামদুদুর রহমান চৌধুরীর সহকারী একান্ত সচিব, তখন আবার যুক্ত হই সমিতির কাজে।ফের ঘনিষ্ঠ হই সাধারণ সম্পাদক আবদুল জাব্বারের সাথে।এবারও আমার ওপর অর্পিত হয় স্মরণিকার কাজ।
১৯৮৪ থেকে ১৯৯৬ অবধি টানা ১২ বছর ব্রাহ্মণগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।১৯৯৬ সালের সাধারণ সভায় তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব হাওলাদার আবদুর রাজ্জাকের (ব্যাচ ১৯৬২) ওপর অর্পণ করে সহ সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৯৮ সালের পুনর্মিলনী শেষে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিচালক পদ থেকে অবসরগ্রহণ করে স্ত্রী ও সন্তানদ্বয় নিয়ে চলে যান আমেরিকায়।শেষজীবনে সেখানেই তিনি থিতু হন।তবে মাটি ও মানুষের টানে তিনি মাঝেমাঝে আসতেন প্রিয় স্বদেশে।
অবশেষে এই প্রিয় মানুষটি ৮২ বছর বয়সে গত ২৯ নভেম্বর, শুক্রবার, বাংলাদেশ সময় সকাল ১১টায় আমাদেরকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে।
আবদুল জাব্বার দেহত্যাগ করেছেন বটে, কিন্তু তিনি থাকবেন আমৃত্যু আমাদের অন্তরে।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর–আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন–বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com
আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।
জাস্ট এখানে ক্লিক করুন। https://www.facebook.com/BikrampurKhobor
email – bikrampurkhobor@gmail.com