প্রকাশিত : শনিবার, ১৫ আগস্ট ২০২০ইং ।। ৩১শে শ্রাবণ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।। বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক :
প্রকৌশলী আবুল হোসাইন
“আর মানুষের মুণ্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়
যে ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে।“
পড়েছিলাম নাজিম হিকমতের লিখা অনুবাদিত কবিতা জেল খানার চিঠিতে । নাজিম হিকমত বেচেঁ থাকলে হয়তো থমকে যেতেন বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেখে।বাংলাদেশে মানুষের মুণ্ডুকে বোঁটার ফুলের চেয়েও অনেক সহজে ছিঁড়ে ফেলা যায়। যার আরম্ভ হয়েছে ১৯৭৫এর ১৫ই আগস্ট থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি স্বপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে।
সেই সময়ে তাৎক্ষণিক বিচারহীনতার রক্ষা কবচ ইনডেমনিটি (শাস্তি এড়ানো )বিল আনেন খন্দকার মোশতাকের সরকার এবং বর্বোরচিত হত্যাযজ্ঞে সংশ্লিষ্ট প্রায় সকলকে খন্দকার মোশতাক, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, মেজর জেনারেল হোসাইন মো: এরশাদ পুনর্বাসিত শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের উপটৌকন হিসাবে প্রদান করেছেন সরকারের উচ্চপদ দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাদেশ মিশনে । হত্যার রাজনীতির বিষবৃক্ষ সেই দিন থেকে বপন করা হয়েছিল। আজ তা মহিরুহ রূপ ধারন করেছে ।
নিচের দু’টি ঘটনার মতো শত শত ঘটনা ঘটে চলেছে বছরের পর বছর জানিনা এর শেষ কোথায় ? “২০১৩ সালের ৬ মার্চ নগরের শায়েস্তা খান রোডের বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হয় ত্বকী। দুদিন পর ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী শাখা খাল থেকে ত্বকীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই বছরের ১২ নভেম্বর আজমেরী ওসমানের সহযোগী সুলতান শওকত ভ্রমর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানান, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ত্বকীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালের ৫ মার্চ তদন্তকারী সংস্থা র্যা ব সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের নির্দেশে তাঁদেরই টর্চার সেলে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। অচিরেই তারা অভিযোগপত্র আদালতে পেশ করবে। কিন্তু অদ্যাবধি অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়নি।“ (প্রথম আলো, আগস্ট ০৮, ২০২০ )
“এ কথা সত্য, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ড অতীতের সব ঘটনাকে ছাপিয়ে গেছে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের ভেতর যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে, মেজর (অব.) সিনহা একজন তরুণ চৌকশ সেনা কর্মকর্তা ছিলেন।
তিনি সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। তার বয়সী অধিকাংশ তরুণ কর্মকর্তাই এখন সেনাবাহিনীর সৈনিকদের সরাসরি কমান্ড করছেন।“
(যুগান্তর, আগস্ট ০৭, ২০২০ )
বাংলাদেশের স্বাধীনতায় জাতির জনক স্বপ্ন দেখতেন ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্র্য মুক্ত এবং সুশিক্ষায় শান্তিময় দেশ গড়ে তোলার চিত্র যার নির্দেশনা ছিল মহান সংবিধানে।আমাদের পবিত্র সংবিধানের ছিল চারটি স্তম্ভ, গনতন্ত্র , সমাজতন্ত্র , ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ । অরাজনৈতিক রাজনীতির দৌরাত্ম্য আর স্বাধীনতা বিরোধীদের ক্রমাগত ছোবলে পড়ে উঁইপোকায় কাটা দলিল হয়ে উঠেছে পবিত্র সংবিধান । সংবিধানের চার স্তম্ভের তিন স্তম্ভ ছেঁটে ফেললেও শুধুমাত্র গনতন্ত্রকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সংবিধানটির কফিনে শেষ পেরেকটিও ঠোকা শুরু করেছে চলমান রাজনীতি। ভোটারহীন ভোটে নির্বাচিত (তথাকথিত)প্রতিনিধি দ্বারা চলছে স্বদেশ। অবৈধদের হাতে পেতে হয় আজ বৈধতার আমল নামা “ হায় সেলুকাস !”
আমাদের স্বাধনীতার স্বপ্ন আজ প্রায় ধূলিসাৎ,এখন দানবীয় উন্মত্ততায় রাষ্ট্র ধ্বংসে উঠে পড়ে লেগেছে দুর্নীতি বাজরা, কি ভাবে আরো রাষ্ট্রের বিবেকবোধের মুণ্ডুকে কঁচু কাটা করা যায় হীন স্বার্থে, অসৎ রাজনীতি ও তালেবানি চিন্তায়। এসবের মূল কারন রাষ্ট্রের জবাবদিহিতার অভাব, বিচারহীনতা ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নতা, মেরুদণ্ডহীণ সরকারী বিচার ব্যবস্থা । ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকরা বেছে নিয়েছেন নানা কৌশল । যেমন – ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলির অদ্ভুত দাবি দাওয়া মেনে নেওয়া, অসাম্প্রদায়িক শিক্ষার মূলউৎপাটন করা, আদর্শ ভিত্তিক সৎ রাজনীতিকে চরিত্রহীন করাI তারই ধারাবাহিকতায় এই অসৎ রাজনীতির হিংস্র ছোবলে ছাত্র ও যুব সমাজ হয়ে উঠেছে মাদকাসক্ত ও সন্ত্রাসী । মানবিক মূল্যবোধ চর্চার বিপরীতে চাঁদাবাজ, ধর্ষক, ছিনতাইকারী হওয়ার ক্ষেত্র তৈরী হচ্ছে প্রতি নিয়ত ।
এর সবই ক্ষমতার লোভ এবং অবৈধ ভাবে বার বার ক্ষমতায় টিকে থাকা ও জনসাধারণের অধিকার, নির্বাচনী অঙ্গীকার অস্বীকার করার কৌশল মাত্র ।
রাষ্ট্র ও সরকার আজ পালকি সেঁজেছে অসৎলোকদের কাঁধে চরে, যারা মুক্তিযুদ্ধ্বের বুলি আওড়াচ্ছে নানা সভায়, টক শো’তে নব্য দেশপ্রেমিক সেঁজে বয়ান দিচ্ছে অবলীলায় । সরকারের সুনাম করতে গিয়ে স্তুতি বাক্যর ঝড়ে ঠোঁটের দু’পাশে উড়াচ্ছে থুথুর ধোঁয়া । বিভিন্ন নীতিকথার আবেগে টেবিল চাপড়াচ্ছে, উন্নয়নের মূলা ঝুলাচ্ছে কথায় কথায় অথচ সারা দেশের মানুষের জীবন নিরপত্তার অভাবে উৎকণ্ঠায় এবং সীমাহীন দুর্নীতিতে মানুষের জীবন উষ্ঠাগত, সাধারণ মানুষ অবর্ণনীয় বিচারহীন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে হাটে, ঘাটে, ঘরে, বাইরে নানা কারণে।
আমার চোখে দেখা আশির দশকের রাজনীতির মাঠ ছিল স্বাধীনতার পক্ষে প্রগতিশীল, বিপক্ষে বি,এন,পি তার সহযোগী প্রতিক্রিয়াশীলদের মাঝে লড়াই । আমি লৌহজংএর প্রাণ কেন্দ্র দিঘলীর সন্তান। স্কুল কলেজ শেষ করেছি লৌহজং থেকে মেধাবী ও আদর্শিক ছাত্র হিসাবে । নিজ চোখে দেখেছি ৭৫ পরবর্তী ৮০র দশকে লৌহজংবাসী বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগের রাজনীতি করা ত্যাগী নেতাদের। আমি ছিলাম ছাত্রলীগ থেকে ভিন্নমতাবলম্বী ছাত্র সংগঠনের কর্মী । দেখেছি নি:স্বার্থ ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের সাংগঠনিক কাজ ।বিশেষ করে অলক কুমার মিত্র,অশোক কুমার মিত্র, নুর মোহাম্মেদ খাঁন, জাকির হোসেন খাঁন (প্রয়াত), আব্দুর রশিদ মোড়ল, কামাল হোসেন (মঞ্জুরী কমিশনের ডিরেক্টর),খোরশেদ আলম বাবুল,আলম শহীদ, নেসার আহমেদ খাঁন,মনোজ খাঁন, শিব শংকর দাস, কমল দাস, তপন দাস, অজিত দাস, পার্থ সারথী দাস,মোহাম্মদ আলী মোল্লা লিংকন,জাকির হোসেন বেপারী, নজরুল ইসলাম খাঁন হান্নান,ইউসুফ আলী রতন, মিজানুর রহমান তারা, দিদার হোসেন, জামাল হোসেন, রফিকুল ইসলাম লিটন, ঢালী হারুন,শংকর কুমার মল্লিক, আবুল কালাম আজাদ সহ আরো অনেক ত্যাগী ছাত্র নেতাদের ।
শুনিনি সেই সময়ে তাদের দ্বারা কোনো অরাজনৈতিক কাজ বা দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ততার কথা। আমরা লৌহজং এর বিভিন্ন খেলার মাঠে,পথে,ঘাটে পথ নাটক করেছি সমাজের অসঙ্গতি তুলি ধরেছি,ছাত্রদের ফ্রি কোচিং দিয়েছি । কখনো কাজির পাগলার মাঠে, কখনো ব্রাম্মনগাঁয় স্কুলের খেলার মাঠে, কখনো লৌহজং কলেজের ছাত্রাবাস মাঠে, কখনো লৌহজং কিশোর সংঘের আঙ্গিনায় নাটক করেছি জাতীয় দিবস গুলিতে ।
পেয়েছি সকল শ্রেনীর মানুষের সরল প্রীতি ভালবাসা, শ্রদ্ধা ছিল একে অপরের প্রতি । এখন রাজনীতি করা মানেই নেতার সাথে মিলে লুটপাটের দানবীয় লীলায় উন্মত্ত থাকা, আখের গুছানোর ধান্দায় ব্যস্ত থাকা । আমি মনে প্রাণে কামনা করছি লৌহজং যেন বর্তমান অপরাজনীতির বন্যায় সয়লাব না হয় ।
৮০ দশকের একটি ঘটনা আজ মনে শিহরণ জাগায় – তখন শুধু লৌহজং নয়, সারা বাংলাদেশে ছিল প্রকাশ্যে রাজনীতির নিষেধাজ্ঞা -ছিল ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি । আমরা সেই নিয়ম ভেঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ মিলে মিছিল করেছিলাম ঘরোয়া রাজনীতি ও স্বৈরাচারী শাসক এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে । আমাদের বিরুদ্ধে পুলিশি মামলা হয়ে যায়,সেই রাতে মিছিলের জন্য এবং মামলার মদদ দাতা ছিল লৌহজং এর এককালের ত্রাস, স্বাধীনতা পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন পার্টির নেতা, পরে জাতীয় পার্টির নেতা এবং পরিশেষে চক্র পূর্ণ করে আবার লৌহজংএর আওয়ামীলীগেরও নেতা হয়ে ছিলেন জীবনের শেষ সময়ে।আমাদের ধরতে পুলিশী হানা দেয় বাড়ি বাড়ি । সেই খবর লৌহজং এর সকল প্রগতিশীল নেতাদের কাছে পৌঁছে যায় ।
পরদিন লৌহজং তথা সারা বাংলার যুবলীগ এর অবিসংবাদিত নেতা বীর মুক্তিযুদ্ধা ঢালী মোয়াজ্জেম এসে গান্ধীর মাঠে আমাদের বুকে টেনে নিয়ে মিটিং করে ঘোষণা দিয়ে ছিলেন “ এই আমি ঢালী মোয়াজ্জেম সারা বাংলাদেশে গনতান্ত্রিক রাজনীতির অধিকার আদায়ের জন্য নেতা কর্মী নিয়ে দিঘলীর গান্ধী মাঠে এসেছি, পারলে ওসি সাহেব এসে আমাদের এরেস্ট করেন । আর যদি আমার একটি কর্মীকে হয়রানি করা হয়, তাহলে সারা লৌহজংএ আগুনে জ্বলবে, তার দায় দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে, আমি মুক্তি যোদ্ধা, অস্ত্র জমা দিয়েছি কিন্তু আদর্শ,বিবেক জমা দেইনি “ ।
সেই দিন আমাদের সবার বুকের শুকনো পাতায় আগুন জ্বালিয়ে ছিলেন ঢালী মোয়াজ্জেম। সেই ঢালী মোয়াজ্জেম লৌহজং এ এখন আবেহেলিত, অপাংতেয়। তার মতো ত্যাগী নেতা আজ আবার খুবইপ্রয়োজন বাংলাদেশের জনপদে। আজ সেই সময়ের রাজপথের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, সাহসী ও ত্যাগী সকল লৌহজং এর দেশপ্রেমিক নেতাদের স্যালুট জানাই ।
আগে নেতারা কর্মী লালন করতো আদর্শ ও সততা দিয়ে । এখন বেশির ভাগ নেতাই কর্মী লালন লালন করে লোভ, হিংস্রতাআর লালসা দিয়ে । আজ সর্বত্রই যুবসমাজে নৈতিকতার অভাব, সেই সাথে অভাব আদর্শিক রাজনৈতিক নেতারও। কিন্তু আজ দেখি বেশির ভাগ নেতাবক্তৃতার সময় তৈল মর্দনে ব্যস্ত থাকেন, মানুষের মনের কথা বলার চেয়ে, বুঝার চেয়ে, মাটি ও মানুষের দিকে তাকানোর চেয়ে, বেশি তাকায় উপরের নেত্রী ও নেতার দিকে । ধিক্ বাটপারির রাজনীতি !
আজ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মানবতার প্রহরী, বাংলার মানুষকে স্বপ্ন দেখার জাদুকর বঙ্গবন্ধুর অকাল প্রায়ান ও শোকের আগষ্ট মাস। শুধু এটুকুই বলবো, আমাদের দেশকে ৭৫ এর পটভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে খুনি মোশতাকের প্রেতাত্মারা ।তাই আজ সকল দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবহনকারী সবার পক্ষ থেকে বিশেষ অনুরোধ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি সচেতন হোন ! আপনার চারিপাশেরদুর্নীতিবাজ, চাটুকার মুক্ত অভিযান শুরুর এখনই সময় ।দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করুন । তা না’হলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ হারিয়ে যাবে অন্ধকারে, শকুনেরা আবার পাখা মেলবে কোন এক আগষ্টের কালো রাতে। জয় হোক মানবতার ! পূরণ হোক জাতির পিতার স্বপ্ন !
(বি:দ্র : আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি সেই সময়ের অনেক বন্ধু , রাজপথের সহযোদ্ধার নাম যদি উল্লেখ করতে ভুলে যেয়ে থাকি )
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..