গান নয় জীবনকাহিনি : পর্ব-৯

0
102
অধ্যাপক ঝর্না রহমান

ইতিহাসের চোখ ও ইন্দ্রপুরীর জানালা (সূত্রাপুর)

প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ২৫ জুন ২০২০ ইং ।। ১১ই আষাঢ় ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।। বিক্রমপুর খবর : অফিস ডেস্ক :

অধ্যাপক ঝর্না রহমান

ঢাকা থেকে গ্রামে চলে আসার পর ১৯৬৭-র ভাঙা বছরটা ছাড়াও ঝাড়া দু বছর আমার লেখাপড়া শিকেয় তোলা ছিল। ১৯৭০ এর রাজনৈতিক উত্তাল সময়ে এসে সে শিকে ছিঁড়লো! মাঝখানের এই সময়টাতে বেশ গায়ে হাওয়া লাগছিল আমার। গাঁয়ের খোলা জল হাওয়ায় আমার দেহতরুও দিব্যি ডালপালা ছড়াতে থাকে! এদিকে হুড়মুড় করে দেশের পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। কিন্তু গাঁয়ের দুলালী আমি তার খবর রাখি না, বা রাখতে চাই না। যেসব বিষয় মাথার ভেতর ভার হয়ে থাকে, রাতে ঘুমুতে গেলে পেটের ভেতর গুড়গুড় করে, সেসব বিষয় দু হাতে দূরে ঠেলে রাখি। কারণ মাথাটা বিকিয়ে দিয়েছিলাম গানের কাছে আর মনটা ভাবের কাছে! গান শোনা, লিখে রাখা, গল্পের বই পড়া, সেলাই করা, সখীদের সাথে কিশোরী মনের রঙ্গিলা সব ফিসফিসানি গল্প নিয়ে শান বাঁধানো ঘাটে বসে দুপুর বিকেল কুড়িয়ে ফ্রকের কোচড়ে ভরে ফেলা ~ এই নিয়েই বুঁদ ছিল আমার মন। তাই গ্রামজীবনে সত্তরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়টা যতখানি টের পেয়েছিলাম, উনসত্তর বা সত্তরের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা ঠিক ততখানি টের পাইনি। হয় তো বড়দের কারণে হালকাভাবে কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম।

তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা মামলা আর এগারো দফা নিয়ে শহরে তুমুল আন্দোলন চলছে। এগারো দফার মধ্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসনের সাথে কৃষক শ্রমিকদের স্বার্থও যুক্ত হওয়াতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আন্দোলনও এর সাথে মিলেমিশে এক হয়ে যায়। কৃষক শ্রমিকের স্বার্থের বিষয়টি সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। গণমানুষের সমর্থন পায় এ আন্দোলন। ফলে এ আন্দোলনের ধাক্কা গ্রামেও এসে লাগে। চোকদার বাড়িতে আমাদের মামা মামাতো ভাইরা এই আন্দোলন নিয়ে আলাপ করতেন। খরব শোনার জন্য প্রায়ই কেউ না কেউ আমাদের রেডিওটা নিয়ে যেতেন। মামাতো ভাই মতি দাদা, হবি দাদা, বাশেদ দাদা, ছানু দাদা*১ এঁরা নানারকম সংবাদ এনে আমাদের সামনে হাজির করতেন। এই ভাইদের প্রায় সবারই গনাইসার গ্রামের সিদ্ধেশ্বরী বাজারে পৈতৃক দোকান, আড়ত ইত্যাদির ব্যবসা ছিল। ফলে হাটে ফেরি-করা সব খবর চলে আসতো বাড়িতে।

আমরা শুনতে পাই, সরকার নাকি ঢাকায় মিছিল মিটিং-করা মানুষ সব মেরে সাফ করে ফেলছে! আব্বা ঢাকায় থাকেন। আমাদের মন এসব খবর শুনে উচাটন হয়ে থাকে। শুনি, আইউব খানের শয়তান ফৌজ স্কুলের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের গুলি করে মেরে ফেলেছে। মতিউর রুস্তম, কী মায়ামাখা এদের নাম! আব্বা বাড়ি এলেই সারাক্ষণ রেডিও নিয়ে পড়ে থাকেন। তবে তখন গান শুনতে পাই না বলে খারাপ লাগে না, বরং আব্বা দুশ্চিন্তা করছেন, দেশের পরিস্থিতি কী হবে, কোন দিকে যাবে আন্দোলন, তা নিয়ে আম্মার সাথে আলাপ করেন, এসব দেখে মন কেমন কুঁকড়ে থাকে। এর মধ্যে আসাদুজ্জামান নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে বিক্ষোভ মিছিলের মধ্যে গুলি করে মেরে ফেললো পুলিশ। এ ঘটনায় জনতা প্রচÐ ক্ষেপে যায়। শহরে মন্ত্রীর বাড়িতেও লোকেরা আগুন দিতে লাগলো। গ্রামে এসে লাগলো সেই আগুনের শিখা। প্রশাসনের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা কারো কারো ওপর জনতা চড়াও হল। আমরা শুনলাম কোন গ্রামের একজন অসৎ চেয়ারম্যানের গলায় জুতার মালা পরিয়ে গ্রামের রাস্তায় ঘোরানো হয়েছে। এর মধ্যে একদিন শুনি, ঢাকায়, নাখালপাড়ায় এক ঘরের ভেতরে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় মাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে পুলিশ। আব্বা থাকেন নাখালপাড়াতে। এ খবর শুনে আমাদের কলিজা শুকিয়ে গেল। আম্মা ভয়ে কাঁদতে লাগলেন। তবে আব্বা নিরাপদেই চলে এসেছিলেন বাড়িতে। সময়টা এভাবে চলতে থাকে। টালমাটাল। উত্তাল। অস্থির। আন্দোলন গণজাগরণে রূপ নিল। গণঅভ্যুত্থানের চাপে আইউব খান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালো। আগরতলা মামলা ডিসমিস হল। একদিন শুনি আইউব খানও ডিসমিস! এখন প্রেসিডেন্ট আর এক খান! তার নাম ইয়াহিয়া খান। আব্বা পেপার নিয়ে এলেন বাড়িতে। ইয়া আল্লাহ! ইয়াহিয়ার কী চেহারা রে বাবা! ঝাঁটার মত গোঁফ! ভাঁটার মত চোখ! মনে হল রাক্ষসের মামাতো ভাই! মোটেও ভালো লাগে না। এর চেয়ে আইউব খানের চেহারার ফিল্ড মার্শাল জেল্লাটা ছিল বেশ! যাই হোক, এক খান গেল আর এক খান এলো! আর এরা তলে তলে আমাদের দেশটাকে দলে মুচড়ে খানখান করে দেবার ফন্দি আঁটতে লাগলো। আব্বার মুখে একটা নতুন শব্দ শুনি ‘মার্শাল ল’। এটা এক শাসন ব্যবস্থা! মার্শাল ল’র পাশাপাশি আন্দোলনও চলতে থাকলো।

সাদা ফুল শার্ট পরা আমার আব্বা, তার বাম দিকে সেজ মামা সর্ব বামে আমার দুলাভাই এডভোকেট আবুল হোসেন, দাঁড়ানো এবং বসা বাকি চার তরুণ আমার মামাতো ভাই মতি দাদা (মতিয়ার), ছানু দাদা (ছানোয়ার), বাশেদ দাদা ও হবি দাদা (হবিবর) ছোট তিনজনও আমার মামাতো ভাইবোন – আমার খেলার সাথী। গনাইসারে ফসলের ক্ষেতে বসে ১৯৬৯ সনে তোলা ছবি! 
আব্বা, সেজ মামা, দুলাভাই তিনজনই প্রয়াত। তাঁদের প্র‌তি আমার গভীর শ্রদ্ধা।

আমার আব্বা ছিলেন সহজ-সরল সংসার বিষয়ে উদাসী প্রকৃতির মানুষ। সংসারের ঝামেলা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। কারণ আব্বা জানতেন, আম্মাই ওসব দেখবেন। আম্মার ওপর আব্বার অসীম নির্ভরতা। আম্মাই সংসারের সমস্যা সংকট কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তার কোনো না কোনো পথ বের করতেন। আম্মা দেখলেন, আব্বা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে যতটা চিন্তিত তার একাংশও বড় মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে নন। মেয়ের বিদ্যের ঝুলি সেই টুনিই রয়ে গেল, আর মেয়ে যে কলাগাছ ছাড়িয়ে তালগাছ ধরার জন্য পাল্লা দিচ্ছে, সে ব্যাপারে আব্বার কোনো চিন্তা নেই। এদিকে কনে-সন্ধানীদের ‘পয়গাম’ বাতিল করতে করতে আম্মা বিরক্ত। মৃদু ভর্ৎসনাও করেন আব্বাকে, তোমার কি কোনো চ্যাদভ্যাদ নাই? মেয়ে কি এভাবেই মুর্খ হয়ে থাকবে? আম্মা কদিন চিঠি লেখালেখিও করলেন ভাইবেরাদরকে। তারপর শুনলাম, প্রবলেম সলভড! আমাকে ঢাকায় আমার সেজো মামার (আবু সায়ীদ চোকদার) বাসায় নিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হবে! মামার বাসায় থাকবো, মামার হাতের মোয়া খাবো! মামাবাড়ি তো ভারি মজা, কিলচড় নাই, মামী দেবে দুধভাত, পেট পুরে খাবো, কেউ লাঠি নিয়ে আসবে না! পালাবোও না! কিন্তু আমি কখনো অন্যের বাসায় জীবন যাপন করিনি। হাজার হোক আপন মামা, পর তো! আমার ভয় করতে লাগলো। তবুও আব্বা আম্মার সিদ্ধান্তের ওপরে কথা বলতে শিখিনি। একদিন শুভক্ষণে আমি গাঁটরি বোঁচকা নিয়ে আব্বার সাথে আমার সেজো মামার বাসায় গিয়ে উঠলাম। মামা থাকেন পুরান ঢাকায়, সূত্রাপুরে, ৪২ হেমেন্দ্র দাস রোড-এ। ওটা ছিল মূলত আমার বড় মামার মেয়ে শান্তি আপার বাড়ি। দুলাভাই এডভোকেট আবুল হোসেন সে বাড়ি কিনেছিলেন তাঁর এক আইনজ্ঞ বন্ধুর কাছ থেকে। বেশ বড় সুন্দর বনেদী বাড়ি। সে বাড়ির একটা ঘর আর বারান্দার এক অংশ সাবলেট নিয়ে সেজ মামা থাকেন। মামার তখন তিন পুত্র আর দুই কন্যা নিয়ে মোট সাতজনের সংসার। আমি তো গিয়ে অনেকটা কাদম্বিনীর বাড়িতে কেষ্টর মত হাজির হলাম। মামী নিজের ছেলেপুলে নিয়েই খাবি খাচ্ছেন, আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া হলাম আমি! যদিও আমাকে মামামামী সাদরে গ্রহণ করেন, তবুও ভয়ে আমার বুক দুরু দুরু করে। আবার স্কুলে ভর্তি হতে হলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে! মামী বলেন পড়রে সোনা, মামা বলেন মন দে, কিন্তু পাঠে আমার মন বসে না। পরীক্ষা দেয়ার কথা ভেবেও ভয় লাগে। স্বল্পভাষী মামীকেও খুব ভয় লাগে। রাতে চিলেকোঠার সিঁড়ি-ঘরে শুতে ভয় লাগে। আর ভিন্ন পরিবেশে এসে ভয় পেয়ে আমার গানবিহঙ্গ কোথায় হুশ করে পালালো তার খবর নেই!

সেজ মামা চাকরি করেন এফআইডিসি-তে (স্বাধীনতার পরে প্রতিষ্ঠানটির নাম হয় বিএফআইডসি), অফিস আরামবাগে। মামার দিন কেটে যায় অফিসে। দুলাভাইও তাঁর কোর্টকাচারি নিয়ে ব্যস্ত। অতএব ভরসা মামাতো বোন শান্তি আপা। তিনি ছিলেন ইডেনে কলেজের মেধাবী ছাত্রী। আমাকে শান্তি আপাই শিখিয়ে পড়িয়ে ভর্তির জন্য ‘মানুষ’ করলেন। তারপর একদিন স্থানীয় স্কুলে নিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিইয়ে আনলেন। স্কুলের নাম ফকির আব্দুল মান্নান গার্লস হাই স্কুল।*২ কোন তেলেসমাতিতে যেন ঝাড়া আড়াই বছর পড়ালেখা চাঙ্গে-তোলা আমি সেভেনের ভর্তি পরীক্ষায় টিকে গেলাম! ভয় তফাৎ গেল। গাল ভরতি হাসি নিয়ে যথাসময়ে ফকির আব্দুল মান্নানে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়ে গেলাম। বাসা থেকে স্কুল পনর বিশ মিনিটের হাঁটাপথ। আমি বুকে বইখাতা চেপে রোজ লক্ষ্মীবাজারের অপরিসর গলির দুপাশে নানারকম পুরোনো বাড়ি আর দোকানপাট দেখতে দেখতে স্কুলে যাই। আর তখন বোধ হয় স্কুল মানেই ছিল বুকে বইখাতা চেপে দলবেঁধে হেঁটে যাওয়া আসা! তবে আমি যেতাম একা। আশেপাশে আমার কোনো সহপাঠি বা সতীর্থ ছিল না। ৪২ হেমেন্দ্র দাস রোডের বাসা থেকে বের হয়ে একটু সামনে এগোলেই একটা ফেব্রিক প্রিন্টিং সেন্টার। টেবিলের ওপর এক রঙা কাপড় ফেলে কারিগরেরা নানারকম কাঠের ছাঁচ রঙে চেপে লাইন মেপে কাপড়ের ওপর চেপে ধরেন, তারপর ছাঁচ তুলে নিলেই চমৎকার ডিজাইন ফুটে ওঠে! কতরকম ডিজাইন! কাঠ খোদাই করে বানানো ডিজাইন। ছোট ফুল, বড় ফুল, জামদানী ফুল। কাঁচা রঙের ছাপ লাগানো কাপড়গুলো দোকানের ভেতর ঝুলিয়ে রাখে, বাইরেও দেয়ালের ওপর মেলে দেয়া হয়। রঙের ঘ্রাণ আমাকে মদের মত আচ্ছন্ন করে ফেলে। কাপড়ে ডিজাইনে প্রজাপতি মৌমাছি ফুল, পাতা, তারা, লাল ছোপ, নীল ডুরে ~ কোনটা বেশি সুন্দর! আমি রাস্তা ভুলে হাঁ করে সেই কাপড়ে ছাপ দেয়া দেখি। যেতে যেতে স্বর্ণকারের দোকান দেখি, চায়ের স্টল দেখি, মিষ্টির দোকান, হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান, দরজির দোকান আর বই বাাঁধাইয়ের দোকান দেখি। প্রত্যেকটা দোকানে রহস্যভরা আলো আর রঙ খেলা করে। প্রত্যেকটার আলাদা গন্ধ। প্রত্যেক মানুষের চেহারায় ফুটে থাকে আলাদা গল্প। আমি এইসব শব্দগন্ধবর্ণ আস্বাদ করতে করতে হাঁটি। এই করে একদিন একটা ঘটনা ঘটলো। সে কথায় আসছি। তার আগে ইমন রাগিণীর সুরে একটা ইন্দ্রপুরীর জানালা খুলে যাওয়ার গল্প বলি।

স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরে শান্তি আপার বাসায় এক মায়ালু বিকেলে আবিষ্কার করি, আমার পালিয়ে যাওয়া গানবিহঙ্গ ফিরে এসেছে! সে এসে বসেছে একটা জাদুকরী জানালার আধখোলা পর্দার নিচে। সে জানালাটি পাশের দোতলা বাড়ির একটা ঘরের। বাড়িটার সীমানাদেয়াল আমাদের বাসারও সীমানাদেয়াল! উঠোনে দাঁড়ালে দেখা যায় সেই জানালা। জানালায় নিচের অংশে ফ্রকের ঝুলের মত পর্দা। ওপরের অংশ খোলা। সেখান দিয়ে ঘরের ভেতরের কোনো দৃশ্য দেখা যায় না। সেই বিকেলে আবিষ্কার করি জানালা দিয়ে ভেসে আসছে সুর! কোনো বালিকা হারমোনিয়াম বাজিয়ে সে ঘরে বসে গান গাইছে! হয়তো বালিকা আমারই বয়সী কিংবা একটু ছোট। বালিকা কী গাইছে? আমি কান পাতি। সারেগামা দিয়ে বানানো একটা সুর। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বালিকা বারবার সেটি গায়। এত মিষ্টি, এত মাতোয়ালা করা সেই সুর! সরগমগুলো বুঝি না। কিন্তু সুর আমার কানে লেগে থাকে। এরপর প্রতিদিন বিকেল হওয়ার জন্য আমার মন ছটফট করে। কখন বালিকা হারমোনিয়াম নিয়ে বসবে, কখন গাইবে গান! তবে রোজ বসতো না। ওর নিশ্চয়ই একটা রুটিন ছিল। মাঝে মাঝে মেয়েটির সাথে একজন পুরুষের কণ্ঠ শুনতাম। বুঝতাম, সেটি ওর সংগীত শিক্ষকের কণ্ঠ। (পরবর্তী সময়ে গানের ছিটেফোঁটা বিদ্যে হওয়ার পর বুঝেছিলাম, বালিকা গাইত ইমন রাগিণীর একটা বন্দীশ। আর সে বন্দীশের একটা অবরোহী তান সানিধাপাহ্মাগাহ্মাপারেগানি‌রেসা আজও আমার কাছে সেই ইন্দ্রপুরীর জানালা!)। মাঝে মাঝে ক্লাসিক্যাল চর্চার পরে মেয়েটি একটা গান করতো ~ লাল ঝুটি কাকাতুয়া ধরেছে যে বায়না। ঐ ইমনলাগা বিকেলের জানালায়, ঐ লালঝুঁটি কাকাতুয়াটি হয়ে গেল আমার গানতুয়া মন! যেন আমিই বসি হারমোনিয়াম নিয়ে। ইন্দ্রপুরীর গবাক্ষের আলোয় গানের খাতা খুলে বসি আমি এক গানরাজার মেয়ে! আমার পোষা কাকাতুয়া জানালায় বসে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে সুরযন্ত্রের ওপর আমার রোদমাখা আঙুলের খেলা! কেমন লাগে হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল রাখতে? কেমন করে সেখান থেকে সুর বেরিয়ে কণ্ঠস্বরের সাথে মিতালি পাতায়! কী তীব্র ইচ্ছে ছিল ঐ বালিকাকে একবার দেখি, একদিন যাই ওদের বাসায়, কিন্তু প্রচণ্ড মুখচোরা স্বভাবের জন্য সে ইচ্ছের কথা শান্তি আপার কাছে বলতে পারিনি। তবে ঐ জানালা, ঐ অদেখা বালিকা, ঐ হালকা হাওয়ায় ভেসে আসা ইন্দ্রলোকের বন্দীশ আমার ভেতরে গান শেখা আর শিল্পী হওয়ার ইচ্ছেটাকে ‘কড়ি মা’-তে ছুঁয়েছিল, বলাই বাহুল্য!
জানালা ছেড়ে স্কুলে যাই এবার! স্কুলে নিত্য নতুন জিনিস শিখতে লাগলাম। শিখলাম বাংলা ইরেজিতে ফার্স্ট পেপার সেকেন্ড পেপার বলে একটা ভাগ আছে, শিখলাম, গোটা বই ভাগ ভাগ করে ‘সিলেবাস’ করে দেয়া হয়! কত কী! কয়েকদিনেই ভালো লেগে গেল স্কুল। ভালো লাগার আর একটি কারণ হচ্ছে, আফরোজা নামের একজন সহপাঠি পেলাম, সেও বাসায় গান শেখে! সুতরাং আফরোজার সাথে আমি ঘনিষ্ঠ হতে চাই। সহজাত লজ্জা আর দ্বিধা আমার পায়ে পায়ে জড়ানো থাকলেও আফরোজা আমার বন্ধু হল। জানলাম, আফরোজার বাসায় হারমোনিয়াম আছে। খুব ইচ্ছে ওর হারমোনিয়ামটা দেখি! কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারি না। তবে ঐ স্কুলে বেশিদিন পড়তে পারলাম না। তিনচার মাস পরেই জানলাম, মামা মুগদাপাড়া বাসা নিয়েছেন। সূত্রাপুরের এই সাবলেট বাসা ছিল অস্থায়ী। মামার অফিসও সূত্রাপুর থেকে দূরে হয়ে যায়। মামা মাস-পহেলা সূত্রাপুরের বাস তুলে মুগদাপাড়ায় উঠে যাবেন। কিন্তু সামনে আমার একটা পরীক্ষা ছিল বলে মামা আমাকে আপা-দুলাভাইয়ের তত্ত¡াবধানে রেখে নতুন বাসায় চলে গেলেন। পরীক্ষা শেষ হলে আব্বা আমাকে মুগদাপাড়ায় রেখে আসবেন।

মা ও ভাইবোনের সাথে ছবির বামে বুকে হাত জোড়া করে দাঁড়ানো আমার সপ্তম শ্রেণীর সহপাঠি আফরোজা।

আমার স্কুল ছাড়ার কথা শুনে আফরোজারও খুব মন খারাপ। একদিন স্কুল ছুটির পরে আফরোজা নিয়ে গেল ওর বাসায়। তখন আমার মামামামীও নেই। একটু সাহস বেড়েছে। তবে লজ্জা ভয় তেমন কাটেনি। আফরোজাদের বাসায় পা দিয়েই মনে হল ওরা বড়লোক! আর ভয়ে আমার বুক দুরু দুরু করতে লাগলো। আফরোজা আমাকে বসিয়ে গল্প করে, মা আর ছোট ভাইবোনদের ডেকে এনে দেখায়, জেলি মাখিয়ে টোস্ট বিস্কুট খাওয়ায়। জেলিটাকেই মনে হল বড়লোকদের খাবার! যাই হোক, ওর হারমোনিয়াম দেখার কথা আর লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারি না। ফেরার পথে আফরোজা আমাকে রাস্তা বাৎলে দিল। এই সোজা তারপর ডানে তারপর বামে। পরে একদম সোজা। পারবে তো? হুম! খুব পারবো! আমারও মনে হচ্ছিল প্রতিদিনের চেনা রাস্তা, একেবারে বইয়ের পাতার মত মুখস্থ। কিন্তু দুবার টার্ন নিয়েই আমার মনে হতে লাগলো সব অচেনা। আমার মনে হল, আফরোজাদের বাসা থেকে বেরিয়ে আসলে আমি রাস্তাটাস্তা কিছুই খেয়াল করিনি, কেবল ওর সাথে কাটানো সময়টারই জাবর কাটছিলাম। ওদের বাড়িটার কথা ভাবছিলাম। ঘরের ভেতর সুন্দর সুন্দর আসবাবগুলোর কথা ভাবছিলাম। আর হারমোনিয়ামটাতো দেখা হল না, সেই দুঃখটার কথা ভাবছিলাম ~ এসব ভাবতে ভাবতে আমি তো কোথায় যেন চলে এসেছি! এসব রাস্তায় তো কখনো যাইনি! তখন সন্ধে হয়ে গেছে প্রায়। দোকানে দোকানে আলো জ¦লছে। আমি ভয়ে চিপে চিপে কাঁদতে লাগলাম আর রাস্তা খুঁজতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল, রাস্তার সবাই টের পেয়ে গেছে, এই ধিঙ্গি মেয়েটা হারিয়ে গেছে! এখনই মেয়েধরা আসবে! আমাকে মিঠিমিঠি কথা বলে গলির ভেতর নিয়ে যাবে! সে যে কী ভয়? কাকে জিজ্ঞেস করি রাস্তার কথা! ঠিকানা তো একদম মুখস্থ! বেয়াল্লিশ হেমেন্দ্র দাস রোড! চারপাশ জরিপ করে এক দরজির দোকানে ঢুকলাম। দরজি সাহেব বয়স্ক মানুষ। নিশ্চয়ই লোক ভালো হবেন! তাঁকে গিয়ে সরাসরি বললাম, আমি হারিয়ে গেছি। (চোখ তো তখন টাবুসটুবুস! কী কষ্টে যে তাকে সমস্যার কথা বলললাম! সেই দরজি মিয়া আমাকে অভয় দিয়ে সযতেœ বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। তখন দেখলাম, আমি ছিলাম ঠিক রাস্তাতেই আর বাসারও প্রায় কাছেই! আপা দুলাভাই আমার হারিয়ে যাওয়ার কাহিনি শুনে হেসে সারা। তবে আফরোজাকে বলিনি। পাগল!) স্কুল ছাড়ার সময় আফরোজার জন্য খুব খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল বুক ফেটে যাবে। বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ ও আমাকে একটা পারিবারিক গ্রুপ ছবি দিয়েছিল। জীবনের ঝড়ঝঞ্ঝার আঘাতে কত কিছু হারিয়ে গেছে কিন্তু সে ছবি আমার কাছে এখনও রয়ে গেছে! (চলবে)

*১ সে সময়ে বিক্রমপুরে মুসলিম পরিবারগুলোতে বাঙালি হিন্দু পারিবারিক সম্বোধন অনুযায়ী বড় ভাইকে দাদা বা বড়দা মেজদা সেজদা, বড় বোনকে দিদি বা বড়দি মেজদি সেজদি বলার চল ছিল। বিক্রমপুরের যাঁরা এখন বর্ষীয়ান ব্যক্তি আছেন, এই সম্বোধনটি তাঁরা বাঁচিয়ে রেখেছেন। তবে সেকালে সম্বোধনটির মধ্যে হিন্দু বা মুসলিম এই ধর্মীয় লেবেল লাগানো ছিল না। সার্বজনীন সম্বোধন হিসেবেই তা ব্যবহৃত হতো। আমরা শহরবাসী হলেও আমাদের পরিবারেও আমার ভাইদেরকে ছোট ভাইবোনেরা নামের সাথে ‘দা’ জুড়ে দিয়েই সম্বোধন করে। তবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে আর তা দেখা যায় না।
*২ ইউটিউব সূত্রে তথ্য পেলাম ১৯৭০ সনেই এ স্কুলের নাম হয় ঢাকা সেন্ট্রাল গার্লস হাই স্কুল। কিন্তু ১৯৭০ এর প্রথমদিকে যে কমাস আমি এখানে পড়েছি, তখনও স্কুলের নামের পরিবর্তন দেখিনি। সম্ভবত পরিবর্তন হয়েছে বছরের শেষ দিকে, কিংবা পরে নাম বদলালেও অফিসিয়ালি গণ্য করা হয়েছে ১৯৭০ থেকে। অথবা পরিবর্তন হলেও তখনও লোকের মুখে নতুন নামটি বলার অভ্যাস আসেনি । যাই হোক, আমি মনে করি, স্কুলটির আদি নামের শেষ বছরের ছাত্রী আমি।

ঝর্না রহমান
পোস্ট: ২৫ জুন ২০২০

================ অধ্যাপক ঝর্না রহমান ==============

 বিক্রমপুরের কৃতী সন্তান অধ্যাপক ঝর্না রহমান-এর জন্ম ২৮ জুন ১৯৫৯ সালে। তাঁর গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ সদরের কেওয়ার গ্রামে। ঝর্না রহমান একজন কথাসাহিত্যিক,কবি ও সংগীত শিল্পী। চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি লেখালিখির সাথে জড়িত। গল্প উপন্যাস কবিতার পাশাপশি লেখেন প্রবন্ধনিবন্ধ, ভ্রমণসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, নাটক। ১৯৮০ সনে বাংলাদেশ পরিষদ আয়োজিত একুশের সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ছোটগল্পে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ। চারটি সম্পাদনা গ্রন্থসহ এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৫০। তাঁর একাধিক গল্প ও কবিতা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে এবং তা দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন মর্যাদাসম্পন্ন সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। কানাডার ভ্যাংক্যুভার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য Trevor Carolan সম্পাদিত দক্ষিণ এশিয়ার গল্প সংকলন The Lotus Singers গ্রন্থে তাঁর গল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত পাঞ্জাবী সাহিত্যিক অজিত কৌর আয়োজিত সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে একাধিকবার সাফল্যের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর পড়াশোনার বিষয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। পেশাগত ক্ষেত্রে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, বাংলা। অবসরে তাঁর কর্মক্ষেত্র লেখালিখি।

ঝর্না রহমান একাধারে একজন গীতিকার সুরকার এবং বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত কণ্ঠশিল্পী।

এ ছাড়া ‌তি‌নি কথাসা‌হি‌ত্যের ছোট কাগজ পরণকথা এবং অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশ‌নের মুখপত্র ত্রৈমা‌সিক অগ্রসর বিক্রমপুর সম্পাদনা ক‌রেন ।

তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই: গল্পগ্রন্থ: ঘুম-মাছ ও এক টুকরো নারী, স্বর্ণতরবারি, অগ্নিতা, কৃষ্ণপক্ষের ঊষা, নাগরিক পাখপাখালি ও অন্যান্য, পেরেক, জাদুবাস্তবতার দুই সখী, নিমিখের গল্পগুলো, বিপ্রতীপ মানুষের গল্প, বিষঁপিপড়ে, Dawn of the Waning Moon (অনূদিত গল্প) , তপতীর লাল ব্লাউজ, আয়নাম‌মি, উপন্যাস: ভাঙতে থাকা ভূগোল, পিতলের চাঁদ, কাকজোছনা। কাব্য: নষ্ট জোছনা নষ্ট রৌদ্র, নীলের ভেতর থেকে লাল, জল ও গোলাপের ছোবল, জলজ পঙক্তিমালা, ঝরে পড়ে গোলাপি গজল, চন্দ্রদহন, উড়ন্ত ভায়োলিন, হরিৎ রেহেলে হৃদয়। কিশোর উপন্যাস: আদৃতার পতাকা, হাতিমা ও টুনটুনি, নাটক: বৃদ্ধ ও রাজকুমারী, প্রবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ: সেঁজুতি, রৌদ্রজলের গদ্য।

মা:রহিমা বেগম,বাবা:মোঃ মোফাজ্জল হোসেন,গ্রামের বাড়ি:কেওয়ার,মুন্সিগঞ্জ। জন্ম:২৮ জুন,১৯৫৯।

নিউজটি শেয়ার করুন .. ..

‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।

আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’

Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com

আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।

https://www.facebook.com/BikrampurKhobor/

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন