গান নয় জীবনকাহিনি: পর্ব -৬

0
80
গান নয় জীবনকাহিনি: পর্ব -৬

প্রকৃতির জল ও গজল এবং কানা মাস্টারের প্রেম: (গনাইসার)

প্রকাশিত : শনিবার,২০ জুন ২০২০ ইং ।।  ৬ই আষাঢ় ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।।  বিক্রমপুর খবর : অফিস ডেস্ক :

অধ্যাপক ঝর্না রহমান

গ্রামজীবনে আমার আম্মা খুব কষ্ট করছিলেন। আব্বা একদিকে আমরা আর একদিকে। আব্বা শহরে মেসে থাকেন। কখনো কখনো তেজগাঁও, কখনো নাখালপাড়া। খাওয়াদাওয়া ভালো হয় না। আব্বার অল্প বয়স থেকেই গ্যাস্ট্রিক সমস্যা। মেস জীবনে গৃহপরিচারিকার রান্না করা ঝালমসলা খেয়ে আব্বার শরীর খারাপ হতে লাগলো। আম্মাও অল্প বেতনে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে লাগলেন। তবু বাসা ভাড়া দেওয়া লাগে না আর শহরের মত সব কিছু কিনে খেতে হচ্ছিল না বলে অনেকটা বাঁচোয়া। কিন্তু আমার দারুণ লাগতে লাগলো গ্রামীণ জীবন। চারপাশে গাছপালা, ফসলের মাঠ, নদীখাল পুকুর ডোবা আর ছোট ছোট পাড়া! অবারিত মুক্ত প্রকৃতি। মৌসুমে মৌসুমে ফলন হচ্ছে ধান, কাউন, বিন্নি, পাট, আলু, মটর, কলাই, মরিচ আর ধঞ্চে। সে সব ফসলের ঋতুগুলোর এক এক রকম রূপ, এ এক রকম ঘ্রাণ, ফসলকে ঘিরে জনজীবনে এক এক রকম কোলাহল আর ব্যস্ততা।
পদ্মানদী বিধৌত বিক্রমপুরের গনাইসার গ্রাম অনেকটাই প্লাবিত অঞ্চল। বর্ষাকালে এ অঞ্চল পুরোপুরিই জলাঙ্গী। দিনরাত আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। গ্রামের আশপাশ সব পানিতে ডুবে যায়। দ্বীপের মত ভেসে থাকে এক-একটা গ্রাম। এ জন্য এ অঞ্চলের অনেক গ্রামের নামে ‘সার’ আর ‘দিয়া’ শব্দ যুক্ত থাকতে দেখা যায় ( কনকসার, টুনিসার, কাঠাদিয়া, হলদিয়া)। সার এসেছে সাগর বা সায়র থেকে আর দিয়া এসেছে দ্বীপ থেকে। হয়তো গনাইসার নামটিও ‘গহীন’ বা ’গহন সাগর’ শব্দ থেকে বিকৃত হয়ে এসেছে। গনাইসারের জলডোবা খালবিলপুকুর দিঘিতে প্রতিফলিত মেঘলা আকাশ আর সজল প্রকৃতি আমার ভাবুক মনকে আরও কল্পনাবিলাসী করে তোলে। স্কুল নেই, লেখাপড়া নেই, কিন্তু আমার খাতা ভরে ওঠে কবিতায়, গানে, গল্পে। নিজেকে মনে হয় পৃথিবীর অজানা কোনো দ্বীপে হারিয়ে যাওয়া এক মেয়ে! বর্ষার জলের সাথে, শরতের নীলের সাথে, হেমন্তের সোনালি রোদের সাথে ঝরতে থাকে গান। রেডিওতে এক-একটা গানের সাথে বদলে যায় আমাদের ঘর, রান্নাঘরের আঙিনা, উঠোনে মেলে দেয়া কাউনের ছড়া বা পাটের গুচ্ছ! কাজ করতে করতে গান গাই সারাক্ষণ! পরবর্তী সময়ে, যখন কলেজে পড়ি, আমাদের ইংলিশ ফার্স্ট পেপারের সিলেবাসে ফারমার্স ডটার (লেখকের নাম ভুলে গেছি।) নামে একটা গল্প পাঠ্য ছিল, সেখানে ইংকিং নামে এক কৃষক কন্যা ছিল, ইংকিং সারাদিন বাবার সাথে ক্ষেতে আর বাড়িতে মায়ের সাথে ফসল বোনা তোলা ইত্যাদি কাজ করতো আর সারাক্ষণ গান গাইতো। কলেজ জীবনে গিয়ে আমি ঐ সময়ের আমাকে এই ইংকিংয়ের সাথে মেলাতাম! গনাইসারে আমিও হয়ে উঠলাম ফারমার্স ডটার! আব্বা শহুরে ‘সার্ভিস হোল্ডার’ হলে কী হবে, তাঁর অন্তর প্রকৃতি ছিল গ্রামীণ কৃষকের! তিনি ছিলেন মাটির সন্তান, মাটির মানুষ! আব্বা ছুটিছাটায় যখন বাড়ি আসেন, সকাল হলেই খন্তা কাঁচি মুগুর কোদাল নিয়ে বের হয়ে পড়েন। পতিত জায়গায় আগাছা পরিষ্কার করে সেখানে শাকসবজির বীজ বোনেন, লাউকুমড়া-শিম-চিচিঙ্গা-ধুন্দুল-ঝিঙ্গা-উস্তাকরলার গাছ লাগান, বেড়া দিয়ে ঘিরে দেন, জাংলা দিয়ে লতাগুলোকে তুলে দেন। আম্মাও গাছ লাগান, পুঁই, মরিচ, ঢেঁড়শ। চাল-ধোয়া, মাছ-ধোয়া পানিটা গাছের গোড়ায় দেন, কীটনাশক হিসেবে দেন বাসি চুলোর ছাই! মাচার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট সবুজ বাচ্চার মত লাউকুমড়াধুন্দুল ঝিঙ্গা দুলতে থাকে। টসটসে পাতা আর ফুল নিয়ে জাংলা জুড়ে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে লতাবতী সবুজিয়া তরকারি গাছ! আমাদের তরিতরকারি কিনতে হয় না। আমার পিঠাপিঠি ছোট বোন কাজল বড়শি আর চাঁই দিয়ে মাছ ধরায় পটু হয়ে ওঠে। তারপর সপ্তাহে দুদিন হাট তো আছেই! আম্মা একটু আয় বাড়ানোর জন্য জমি বর্গা নেন, তাতে ধানপাট আলুকলাইমরিচ ইত্যাদি চাষ করেন। আব্বা ঢাকায় থাকতেন বলে আম্মা আমি আর আমার ছোটবোন কাজল, আমরাই ক্ষেতপাথারের কাজ কর্ম দেখাশোনা করতাম। কষ্ট হলেও ভালোই চলতে থাকে আমাদের প্রকৃতিলগ্ন সহজিয়া সাদামাটা সরল জীবন। সুতরাং দ্বীপে থাকি আর সমুদ্দুরে থাকি, অর্থের সাশ্রয় তো হচ্ছে! তাই কষ্ট হলেও আমরা গনাইসার গ্রামে থেকে যাই ৬৭ থেকে ৭২ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
তবে আম্মা-আব্বার জীবন-সংগ্রাম আমাকে খুব কাতর করে। বাকি ভাইবোনেরা ছোট ছোট। ওরা কিছুই বোঝে না। আমি আম্মাকে কাজে সাহায্য করি, কীভাবে সংসারের খরচ বাঁচানো যায়, কীভাবে জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা যায়, অপচয় রোধ করা যায়, সামান্য শাকপাতা কুমড়োর ফুল, পুঁইয়ের বিচি, কচুর লতিকে কীভাবে অসামান্য খাদ্যে পরিণত করা যায়, প্রতিনিয়ত শিখতে থাকি আম্মার কাছে। আমার গানপাগল মনটাও এই ব্যয়সংকোচ চেষ্টার ভেতরে ঢুকে যায়। রেডিও যত বাজানো হবে, ততই ব্যাটারি খরচ। ব্যাটারির দামও আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। তাই হিসেব করে রেডিও চালাই। খবর-টবর, কথিকা, জীবন্তিকা, বাজার দর, পাটের দর, আবহাওয়া – এসব শোনা বাদ দিয়ে শুধু নাটক আর গানের অনুষ্ঠানগুলো শুনি। তবে আম্মা কৃষি অনুষ্ঠান বুনিয়াদি গণতন্ত্রের আসর খুব পছন্দ করেন। ঐ আসরের মজিদের মায়ের নাটকের ঢংয়ে কৃষিবিষয়ক প্রশ্নোত্তর শুনতে শুধু আম্মা নয়, আমারও ভালো লাগতো। কোনো কোনো অলস বিকেলে আম্মার প্রিয় জ্ঞাতি বোন ভাবিরা মিলে শুনতো মজিদের মায়ের আসর (মজিদের মায়ের অভিনয় করতেন চলচ্চিত্রাভিনেত্রী আয়েশা আখতার)। সে আসরে কণ্ঠ বিকৃত করে একজন কমেডিয়ান বোকার অভিনয় করতো, বোকা বোকা প্রশ্ন করে হাস্যরসের মধ্য দিয়ে শ্রোতাদের কাছে কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য পৌঁছে দেওয়াই ছিল এর উদ্দেশ্য। আমরা মহানন্দে সেই কমেডিয়ানের ডায়লগ নকল করে সুর ধরতাম, ‘আঁমি গঁবর খাঁবো!’ খবরে আমার মোটেও আগ্রহ ছিল না। ওটা ছিল আব্বার এরিয়া। আব্বা বাড়ি এলেই রেডিওর প্রত্যেকটা খবর কান পেতে শুনতেন। বাড়ির অন্য লোকজনও খবর শুনতে আর আব্বার সাথে আলোচনা করতে আসতেন। তখন দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আন্দোলন সংগ্রামের কাল চলছিল। গ্রামে বসে ছাত্রদের মিছিল মিটিং ধরপাকড় এসব দেখতে না পেলেও খবর চলে আসতো। রেডিওর খবরে আর লোকজনের আলোচনায় তুমুলভাবে আসতে থাকে ছয় দফা, এগারো দফা, শেখ মুজিব, ন্যাপ, ভাসানি, ছাত্র সংগ্রাম কমিটি কথাগুলো। নানাবাড়ির অন্যান্য হিস্যা থেকে আমাদের মামা কিংবা মামাতো ভাইরা মাঝে মধ্যে এসব রাজনৈতিক সংবাদ শোনার জন্য আমাদের রেডিওখানা হাওলাত নিয়ে যায়। অনেকক্ষণ বাদে যখন ফিরে আসে, তখন দুরুদুরু বুকে রেডিও চালাই। ব্যাটারি সব খেয়ে ফেলেনি তো? সাউন্ড ঠিক আছে তো? রাতে নাটক শুনতে হবে! অনুরোধের আসর আছে! ব্যাটারি শেষ হয়ে যখন ভূতের গলায় ভোম ভোম আওয়াজ করতে থাকে রেডিও, তখন ব্যাটারি চেম্বারের ঢাকনা খুললে দেখা যেত গলিত ব্যাটারি থেকে রক্তপুঁজ বেরিয়ে ফোকর ভরে গেছে!
গ্রামের খোলা হাওয়ায় ছুটোছুটি করে আমরা ধাঁই ধাঁই করে বড় হয়ে উঠতে থাকি। আমি তো কমলাপুরে থাকতেই ধিঙ্গি হয়ে গিয়েছিলাম। তবে, বড় হচ্ছি বটে, কিন্তু আমার লেখাপড়া তো শিকেয় তোলা আছে! আমার পরের পিঠেপিঠি তিন বোনকে স্থানীয় দুটি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়েছে। নানাবাড়ির সবচেয়ে কাছে যে স্কুল সেটা হল বাইনখারা প্রাইমারি স্কুল। বর্ষাকালে জোরে ডাক দিলে বিলের পানির ঢেউয়ের সাথে শব্দ তরঙ্গও তরতর করে বাইনখারা চলে যায়। সেখানে ভর্তি হল তিন আর চার – মিনু, রিনা। দু নম্বর বোন কাজল গেল মান্দ্রা প্রাইমারিতে। ওই স্কুলটা একটু ভাল। কারণ, কাজলের তখন ক্লাস ফাইভ। যাই হোক, দুই-তিন-চারের হিল্লে হল, কিন্তু পালের গোদা এক নম্বরের কোনো হিল্লে হল না! হবে কেমন করে, গায়েপায়ে তখন আমার বিয়ের বয়স হয়ে গেল বলে! মানে গাঁয়ের বিয়ের বয়স! আম্মা আমার স্কুল নিয়ে ভাবতে লাগলেন। গ্রামে একটু বড় হয়ে ওঠা মেয়েদের জন্য স্কুল তখনও ততটা সহজ নয়। ১৯৬৮তে, আমার তখন ক্লাস সিক্সে ভর্তি হওয়া দরকার (কারণ ’৬৭ তে গ্রামে আসার পর আমার পঞ্চম শ্রেণীর ভাঙা বছরটা এমনি এমনি বয়ে গেছে।)। কাছেপিঠে হাই স্কুল নেই। রাউৎভোগ হাই স্কুল গনাইসার গ্রাম থেকে বেশ দূরে। আম্মা আমাকে সেখানে পাঠাবেন না। আম্মা আমার পড়াশোনা নিয়ে চিন্তিত বটে। কিন্তু আমার দারুণ মজা। ছাত্রত্ব শিকেয় তুলে আমি কানাই মাস্টারিত্ব ফলাচ্ছি। ‘বেড়াল ছানা’ ভাইবোনদের হারিকেনের আলোয় বই খুলিয়ে বসিয়ে নিজে লো ভলিউমে রেডিও খুলি। রেডিও সিলোন বা সন্ধ্যার ‘ফৌজি অনুষ্ঠান’*১ (স্বাধীনতার পরে এ অনুষ্ঠানটির নাম হয়েছিল ‘সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান দুর্বার’। দুর্বার অনুষ্ঠানের টেলপ মিউজিক চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল শুনলে সতিই বুকের ভেতর মাদলের দ্রিমি দ্রিমি শুনতে পেতাম।) শোনার জন্য রেডিওর নব ঘোরাই। ফৌজি অনুষ্ঠানে মিশ্র ছাড়াও নানারকম গানের অনুষ্ঠান হত। দেশাত্মবোধক, পল্লীগীতি, আধুনিক। সবচেয়ে আনন্দ লাগতো যেদিন থাকতো ছায়াছবির গান! স্বাধীনতার আগে রেডিওতে (রেডিও পাকিস্তান ঢাকা) দারুণ সুন্দর সুন্দর ঊর্দু গানও বাজতো। রুনা লায়লা ও রফিক চৌধুরীর দাইয়ারে দাইয়ারে কাঁটা চুভা (ছায়াছবি: ফির সুভা হোগী), আহমদ রুশদীর আচ্ছা কিয়া দিল না দিয়া (ছায়াছবি: পয়সা), আহমদ রুশদি ও মালা বেগমের গাওয়া ও মেরি মেহবুবা (ছায়াছবি: নয়ী লায়লা নয়া মজনু), বশীর আহমেদ ও নূরজাহানের তুম জো মিলে প্যায়ার মিলা (ছায়াছবি: মিলন), আহমেদ রুশদীর জিয়া হ্যায় তো প্যায়ার কারেগা নিভানা (ছায়াছবি: দিল মেরা ধাড়কান তেরি), নূরজাহান ও মেহেদী হাসানের গাওয়া আপ কো ভুল যায়ে হাম (ছায়াছবি: তুম মিলে প্যায়ার মিলা), বশীর আহমদের তুম সালামত রাহো (ছায়াছবি: মিলন), মেহেদী হাসানের জিন্দেগী ম্যায় তো সাবহি প্যায়ার কিয়া ক্যারতে (ছায়াছবি: আজমত) এসব গান শুনতে কেমন যেন মদের মত মাতাল মাতাল লাগতো। বিশেষ করে মেহেদী হাসানের গজলগুলোর সুরের মাদকতা ছোট হলেও আমাকে বিবশ করে রাখতো। তবে বিজাতীয় ভাষা বলে গানগুলো সে বয়সে পুরোপুরি মুখস্থ করতে পারতাম না, লিখতেও পারতাম না। আর স্বাধীনতার পরে তো সে সব গান প্রচার বন্ধই হয়ে গেলো! ফলে আমার গানের ভাণ্ডারে কোনো উর্দু গান নেই! কিন্তু সে সময়ে গানগুলো কানের ভেতর যে অদ্ভুত সুরতরঙ্গ তুলে যেত আজও সেই সুর মনের ভেতর দোলা দিয়ে যায়!
ছোট বোনদের ইশকুলে একদিন দাওয়াত পেলাম। বাইনখারা স্কুলে কী একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। আমার বোনরাও এক একজন তখনই গানের ব্যাপারে ভালই সমঝদার হয়ে উঠছে। তারা আমাকে নিয়ে গেল। গ্রামের সাধারণ প্রাইমারি স্কুল। টিনের চালা দেয়া বাখারি বেড়ার ঘর। খুঁটির সাথে ঘরের চারদিক জুড়ে তক্তা লাগানো। সেসব হল ছাত্রছাত্রীদের বেঞ্চ। প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠান। কিছুটা খেলাধুলা। তারপর স্যারদের সামনে দাঁড়িয়ে গান। সম্ভবত ‘যে যা পারে’ ধরনের প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। আমি সেখানে রীতিমত দাওয়াতপ্রাপ্ত গানজানা অতিথি! মাঠের একপাশে একটা টেবিল পেতে স্যাররা বসেছেন। টেবিলের ওপরে পুরস্কারের সামগ্রী সাজানো। আমাকে গান গাইতে বলা হল। বুক দুরু দুরু করলেও মনে মনে খুব খুশি! বোনদের ইশকুলের অনুষ্ঠানে গান গাইবো! সে সময় সাবিনা ইয়াসমিন নামে একজন মধুকণ্ঠী শিল্পী সিনেমায় আশ্চর্য সুন্দর সুন্দর সব গান গাইছেন। খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে এই শিল্পী আমার! তখন সুজাতা রাজ্জাক অভিনীত ‘এতটুকু আশা’ নামের সিনেমা খুব হিট। সেই ছায়াছবিতে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া একটা গান, মিছে হল সবই যে মোর আঁধার ঘনায় নয়নে, হারিয়ে গেল অনাদরে যা ছিল এই জীবনে’ আমার রক্ত কনিকার মধ্যে যেন ঢুকে গিয়েছিল। মন প্রাণ ঢেলে সেটাই গাইলাম। মনে হল দারুণ গাইলাম! একেবারে গলার ভেতর থেকে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে যাচ্ছিল গানের পাখি! স্যাররা খুব প্রশংসা করলেন। হেড স্যার গান শুনে এত খুশি, এক চোখ (স্যারের একটা চোখ খারাপ ছিল। তাই তাঁর আর এক নাম ছিল কানা মাস্টার) পিটপিট করে আমাকে খুব করে দেখে বললেন, তোমার গানের গলা ত খুব সোন্দর! প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণছাড়াই তিনি আমাকে ফার্স্ট ঘোষণা করে দিলেন! পুরস্কারও তুলে দিলেন! সে-ই আমার জীবনে প্রথম গানের প্রতিযোগিতা (!), আর তাতে প্রথম পুরস্কার অর্জন! পুরস্কার পেলাম কালির দোয়াত। বাড়ি এসে আম্মার হাতে সেই কালির দোয়াত তুলে দিতে গিয়ে মনে হয়েছিল রাজ্য জয় করে রাজধানীতে প্রবেশের সোনার চাবিটি তুলে দিচ্ছি।
তবে গানের পাখি উড়াল দিয়ে বেশি দূর যেতে পালো না, একদিন ‘কানা মাস্টার’ হেড স্যার আম্মার কাছে আমার জন্য লোকমারফত নিজের বিয়ের পয়গাম পাঠালেন! আমি তখন দশ বছরের খুকিটি! আম্মা পারেন তো ঘটক মিয়াকে লাঠি নিয়ে তাড়া করেন। সঙ্গে চোখা বুলি, বজ্জাত মাস্টার, ব্যাটার একটা চক্ষু আছে, সেইটাও কানা কইরা দেওন দরকার! কানা মাস্টারের প্রেমের তো কলি না ফুটিতেই ঝরিয়া গেল, এতদসঙ্গে গ্রামীণ জীবনে আমার পড়ালেখার চিন্তাও সুদূর পরাহত হইয়া উঠিল!
সুতরাং আমার লেখাপড়া-ছাড়া মুক্ত জীবন চলতে থাকে একটানা আরও দু বছর। দুটো নেশায় জড়িয়ে পড়ি তখন। এক হল সেলাই*২ আর একটি হল বই পড়া। আমার আম্মার খুব বই পড়ার নেশা ছিল। অনেক বই ছিল তাঁর সংগ্রহে। বইগুলো আম্মা তাকের ওপর সাজিয়ে রেখেছেন। নানাবাড়িতে ঘরের একপাশ জুড়ে নকশা করা কাঠের জাফরিকাটা ঝালর দেয়া লম্বা তাক। সেই তাক ভরতি আম্মার বই। আমি আম্মার সংগ্রহের পাঠ্য-অপাঠ্য সব বই পড়তে থাকি। নজিবর রহমানের আনোয়ারা, গরীবের মেয়ে, মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু, মোকসেদুল মোমেনিন, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের চিতা বহ্নিমান, ফিরে পেলো, আকবর হোসেনের কী পাইনি, ঢেউ জাগে, ছেলে কার (লেখকের নাম মনে নেই), কার পাপে (লেখকের নাম মনে নেই), শাহাদাৎ হোসেনের মরুর কুসুম, আরব্য রজনী, গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী, বিবি খাদিজা (লেখকের নাম মনে নেই), স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য, মরনের আগে ও পরে, মদনকুমার ও মধুমালা পুঁথি, আলেকজান্ডার দ্যুমার দা প্রিন্স এন্ড দ্যা পপার, জোনাথান সুইফটসের গালিভার্স ট্রাভেলস, এমন কি এমিল জোলার নানা পর্যন্ত! এক-একটা বই হাতে নিয়ে দ্বীন দুনিয়া সব ভুলে যাই। স্বপ্নময় রোমান্টিকতা ঘিরে ধরে আমাকে। কিছুটা ইঁচড়ে পাকা হয়ে উঠি। যেমন, কার পাপে উপন্যাস পড়ে যৌন রোগ, সিফিলিস, গনেরিয়া এ শব্দগুলো শিখে ফেলি, এমিল জোলার নানা উপন্যাস পড়ে জেনে ফেলি পতিতা নারীর জীবনের বঞ্চনা আর দুঃখব্যথার অন্ধকার অধ্যায়গুলো। নজিবর রহমানের আনোয়ারা উপন্যাস পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আমিও আনোয়ারার মত ‘পতিব্রতা’ বউ হবো আর বিয়ের দিন বাসর ঘরে স্বামীর পা ছুঁয়ে সালাম করবো! (চলবে)

*১ ফৌজি অনুষ্ঠান পুরোটাই উর্দু গানের হত কি না, মনে করতে পারছি না। বন্ধুদের কারো কাছে এ অনুষ্ঠানটি সম্বন্ধে সঠিক তথ্য থাকলে জানাতে উনুরোধ করছি। অনুষ্ঠানটি করাচি কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হত এটুকু জানা হয়েছে।
*২ ‘সেলাইজননী ও দরজিকন্যা’ শিরোনামে কিছুদিন আগে তিন পর্বের একটি স্মৃতিগদ্য পোস্ট করা আছে আমার টাইম লাইনে।
ঝর্না রহমান
পোস্ট: ১৯ জুন ২০২০
ছবি: আমার লেখা ও গাওয়া দেশাত্মবোধক গানের অ্যালবাম ‘শ্যামাঙ্গিনী বাংলা আমার’-এর উৎসর্গপত্র।

================ অধ্যাপক ঝর্না রহমান ==============

বিক্রমপুরের কৃতী সন্তান অধ্যাপক ঝর্না রহমান-এর জন্ম ২৮ জুন ১৯৫৯ সালে। তাঁর গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ সদরের কেওয়ার গ্রামে। ঝর্না রহমান একজন কথাসাহিত্যিক,কবি ও সংগীত শিল্পী। চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি লেখালিখির সাথে জড়িত।

গল্প উপন্যাস কবিতার পাশাপশি লেখেন প্রবন্ধনিবন্ধ, ভ্রমণসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, নাটক। ১৯৮০ সনে বাংলাদেশ পরিষদ আয়োজিত একুশের সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ছোটগল্পে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ। চারটি সম্পাদনা গ্রন্থসহ এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৫০। তাঁর একাধিক গল্প ও কবিতা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে এবং তা দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন মর্যাদাসম্পন্ন সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। কানাডার ভ্যাংক্যুভার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য Trevor Carolan সম্পাদিত দক্ষিণ এশিয়ার গল্প সংকলন The Lotus Singers গ্রন্থে তাঁর গল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত পাঞ্জাবী সাহিত্যিক অজিত কৌর আয়োজিত সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে একাধিকবার সাফল্যের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর পড়াশোনার বিষয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর।

পেশাগত ক্ষেত্রে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, বাংলা। অবসরে তাঁর কর্মক্ষেত্র লেখালিখি। ঝর্না রহমান একাধারে একজন গীতিকার সুরকার এবং বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত কণ্ঠশিল্পী।

এ ছাড়া ‌তি‌নি কথাসা‌হি‌ত্যের ছোট কাগজ পরণকথা এবং অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউ‌ন্ডেশ‌নের মুখপত্র ত্রৈমা‌সিক অগ্রসর বিক্রমপুর সম্পাদনা ক‌রেন ।

তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই:গল্পগ্রন্থ: ঘুম-মাছ ও এক টুকরো নারী, স্বর্ণতরবারি, অগ্নিতা, কৃষ্ণপক্ষের ঊষা,নাগরিক পাখপাখালি ও অন্যান্য,পেরেক, জাদুবাস্তবতার দুই সখী,নিমিখের গল্পগুলো,বিপ্রতীপ মানুষের গল্প,বিষঁপিপড়ে, Dawn of the Waning Moon (অনূদিত গল্প) ,তপতীর লাল ব্লাউজ, উপন্যাস: ভাঙতে থাকা ভূগোল, পিতলের চাঁদ, কাকজোছনা। কাব্য: নষ্ট জোছনা নষ্ট রৌদ্র, নীলের ভেতর থেকে লাল, জল ও গোলাপের ছোবল, জলজ পঙক্তিমালা, ঝরে পড়ে গোলাপি গজল, চন্দ্রদহন, উড়ন্ত ভায়োলিন, হরিৎ রেহেলে হৃদয়। কিশোর উপন্যাস: আদৃতার পতাকা, হাতিমা ও টুনটুনি, নাটক: বৃদ্ধ ও রাজকুমারী, প্রবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ: সেঁজুতি, রৌদ্রজলের গদ্য।

মা:রহিমা বেগম,বাবা:মোঃ মোফাজ্জল হোসেন,গ্রামের বাড়ি:কেওয়ার,মুন্সিগঞ্জ। জন্ম:২৮ জুন,১৯৫৯।

নিউজটি শেয়ার করুন .. ..

‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর

আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’

Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com

আমাদের পেইজ লাইক দিন শেয়ার করুন

https://www.facebook.com/BikrampurKhobor

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন