প্রকাশিত :মঙ্গলবার,৩০জুন ২০২০ইং ।। ১৬ই আষাঢ় ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : ‘মুক্তা, আমিও তো তোদের সঙ্গেই ছিলাম। মাকে নিয়ে তুই চলে গেলি বোন! তোকে আমি কত ভালোবাসি জানিস না! পানির মধ্যে আমি অনেক খুঁজেছি তোকে, মাকে। পাইনি। চোখের নিমেষেই তোরা ডুবে মারা গেলি, আমি কেন বেঁচে ফিরলাম!’
গতকাল রোববার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গ চত্বরে বসে এভাবেই আর্তনাদ করছিলেন বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবিতে বেঁচে ফেরা তরুণ সাইফুল ইসলাম রিফাত। মা ময়না বেগম (৪৩) ও ছোট বোন মাহমুদা আক্তার মুক্তাকে নিয়ে ‘মর্নিং বার্ড’ লঞ্চে ঢাকায় ফিরছিলেন রিফাত। সঙ্গে রিফাতের এক বন্ধুও ছিলেন, ইরফান। রিফাত ও ইরফান ডুবন্ত লঞ্চ থেকে বেঁচে ফিরে আসেন। কিন্তু ফিরতে পারেননি রিফাতের মা আর বোন।
২১ বছরের সাইফুল ইসলাম রিফাত পুরান ঢাকার চকবাজারে একটি অনলাইন শপিংয়ে ডেলিভারিম্যান হিসেবে চাকরি করেন। তার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের মিল্ক্কিপাড়ায়। তারা দুই বোন ও এক ভাই। পাঁচ বছর ধরে সোয়ারিঘাট এলাকায় বসবাস করেন তিনি। বছরখানেক আগে ছোট বোন মাহমুদা আক্তার মুক্তা ও মা ময়না বেগমকে নিয়ে আসেন ঢাকার ভাড়া বাসায়। মাঝেমধ্যেই মা ও বোনকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যেতেন।
কর্মস্থল থেকে তিন দিন ছুটি নিয়ে সর্বশেষ গত শুক্রবার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন রিফাত। সঙ্গে ছিলেন মা ও বোন। ছুটি শেষে গতকাল সোমবার চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল রিফাতের। তাই সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে মুন্সীগঞ্জ কাঠপট্টি থেকে ‘মর্নিং বার্ড’ লঞ্চে ওঠেন মা ও বোনকে নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু ইরফান। মাঝপথে এসে ইরফান দোতলা লঞ্চের ছাদে উঠে যান। মা-বোনের সঙ্গে দোতলায় পাশাপাশি বসেছিলেন রিফাত। সারাপথ বোনের সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে আসেন তিনি। সদরঘাটের কাছাকাছি এসে চোখের নিমেষেই তাদের বহনকারী লঞ্চটি ডুবে যায়।
রিফাত ও তার বন্ধু ইরফান ভাগ্যক্রমে জীবন বাঁচাতে পেরেছেন। রিফাতের ডান পায়ের হাঁটু কেটে গেছে ডুবন্ত লঞ্চ থেকে বের হওয়ার সময়। উদ্ধারকারী দল রিফাতকে পুরান ঢাকার একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে ছুটে যান তিনি। কারণ, বুড়িগঙ্গা থেকে লাশ উদ্ধারের পর নেওয়া হয় ওই মর্গে। রিফাতের বড় বোন মুন্নি আক্তারসহ আত্মীয়-স্বজনরাও ছুটে আসেন মর্গে। সাদা কফিনে সারিবদ্ধভাবে রাখা লাশের মধ্যে মা ও বোনের মৃতদেহ খোঁজেন স্বজনরা। পায়ে আঘাতের কারণে মর্গ চত্বরে বসে আহাজারি করছিলেন রিফাত এবং মুন্নি আক্তার। ভিড়ে লাশ শনাক্ত করতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় পার হয়ে যায় স্বজনদের। বিকেল ৩টার দিকে লাশ শনাক্ত হয়।
মুন্নি ও রিফাতের বুকফাটা কান্নায় কেউই চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি। একই সঙ্গে বোন ও মা-হারা দুই ভাইবোনকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেন স্বজনরা। আর্তনাদ করতে করতে রিফাত বলেন, ‘পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তবুও ডুবন্ত লঞ্চের মধ্যে মা-বোনকে খুঁজেছি। কিন্তু খুঁজে পাইনি। মুহূর্তেই চোখের সামনে মা-বোন ডুবে মরল! আমি কেন বেঁচে ফিরলাম। লঞ্চে ওঠার পর সারাপথ মা-বোনের সঙ্গে কত কথা হলো আমার। মা আমাকে করোনাভাইরাসের মহামারির কথা বারবার মনে করিয়ে দিয়ে বলছিলেন, তোমার চাকরি তো মানুষের বাসায় খাবার বা বিভিন্ন পণ্য পৌঁছে দেওয়া। মহামারির মধ্যেও কাজ করতেই হবে। এরপরও যতটুকু পার সাবধানে থাকার চেষ্টা করবা।’
লঞ্চ দুর্ঘটনা সম্পর্কে রিফাত জানান, এটি একটি ছোট লঞ্চ। তার ধারণা, ৬০-৭০ জন যাত্রী ছিল। ৯টার দিকে সদরঘাটের কাছাকাছি ফরাশগঞ্জ বরাবর আসে। এ সময় একটি লঞ্চ ব্যাকগিয়ার করে তাদের বহনকারী লঞ্চের পেছনে সজোরে ধাক্কা মারে। চোখের নিমেষেই লঞ্চটি এক ধাক্কায় উল্টে ডুবে যায়। ভেতরে যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। রিফাত বলেন, ধাক্কা মারার সঙ্গে সঙ্গে আমি মা-বোনকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করি। কিন্তু এর আগেই লঞ্চ ডুবে যায়।
রিফাতের মামা বাবুল মোল্লা সমকালকে বলেন, বিকেল ৩টায় লাশ শনাক্ত করেন তারা। সন্ধ্যায় মা-মেয়ের লাশ নিয়ে তারা গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের মিল্ক্কিপাড়ায় পৌঁছান।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..