প্রকাশিত: সোমবার, ১৯ অক্টোবর ২০২০ইং ।। ৩রা কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)।। ০১ রবিউল আউয়াল, ১৪৪২ হিজরী
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : মুসলিম রেনেসাঁর কবি হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত। কারণ তার কবিতা তৎকালীন বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণা জোগায়। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ, অনাহার ক্লিষ্টের করুণ পরিণতি, সমকালের সংকট, জরাগ্রস্ত বাস্তবতা এবং সাম্প্রদায়িকতার হিংস্রতা দেখে তিনি দগ্ধ। আর এ সকল অসঙ্গতি-ই তাকে সাহিত্য সাধনায় অনুপ্রেরণা জোগায়।
বলছি, প্রখ্যাত কবি ফররুখ আহমদের কথা। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামী ভাবধারার বাহক হলেও তার কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন ও বাকপ্রতিমা অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার নানা সৌকর্য তার কবিতায় পরিব্যাপ্ত।
‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?/ এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে? /সেতারা হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে? / তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে; / অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি….’ এমনি অসংখ্য জনপ্রিয় এবং কালজয়ী কবিতার জনক কবি ফররুখ আহমদ।
আজ ১৯ অক্টোবর প্রখ্যাত কবি ফররুখ আহমদের ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৪ সালের এইদিনে ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেনে বিপ্লবদীপ্ত এই কবি মৃত্যুবরণ করেন। কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০জুন মাগুরা জেলার মাঝআইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ হাতেম আলী। মাতা বেগম রওশন আখতার। গ্রামের পাঠশালাতেই তার শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি।
পরবর্তীতে কোলকাতায় গিয়ে তালতলা মডেল এম.ই স্কুলে ভর্তি হন। পরে কোলকাতার বিখ্যাত বালিগঞ্জ সরকারি হাই স্কুলে ভর্তি হন। ঐ সময় কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রাথমিক জীবনে কবিত্ব বিকাশে কবি গোলাম মোস্তফা ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেন।
১৯৩৭সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৯ সালে কোলকাতার রিপন কলেজ হতে আই.এ পাস করেন। ১৯৪১ সালে কোলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজে, প্রথমে দর্শন ও পরে ইংরেজীতে অনার্সে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বিএতে ভর্তি হন। কিন্তু নানাবিধ কারণে পড়াশুনা আর শেষ করতে পারেননি।
১৯৪৩ সালে আই.জি প্রিজন অফিসে চাকুরীর মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইয়ে এবং ১৯৪৬সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকুরী করেন। ১৯৪৫সালে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৮সালে কোলকাতা থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। ঢাকা বেতারে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন তিনি। ঢাকা বেতারে তিনি ‘ছোটদের খেলাঘর’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। কবি ফররুখ আহমদ প্রথম যৌবনে ভারতবর্ষের বিখ্যাত কমরেড এম.এন রায়ের শিষ্য ছিলেন। কিন্তু জন্মসূত্রে ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্যের অধিকারী কবি একসময় ধর্মীয় চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়েন। তার কবিতায় ইসলামী সমাজতন্ত্র মূর্ত হয়ে ওঠে।
কবি ফররুখ আহমদ সৃষ্ট সাহিত্যসম্ভার ভাষা তথা বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। দর্শনগতভাবে তিনি ছিলেন মানবতাবাদী কবি। নীতি আদর্শের প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। কবি ফররুখ আহমদের চিন্তাচেতনা দর্শন সবই ছিল এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। তার কবিতা ছিল মানবতাবাদী দর্শনে পরিপূর্ণ। কিন্তু কাব্যে রসবোধেরও কমতি নেই।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-স্বীকৃত একজন অসাধারণ জননন্দিত কবি ফররুখ আহমদ। কবির সাহিত্য জীবনের শুরুতে ‘সওগাত’ পত্রিকায় ফররুখ সম্পর্কে আবু রুশদ লিখেছেন- ‘ফররুখ আহমদ রোমান্টিক কবি, অর্থাৎ তার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তব-বোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তার কাব্যে সৌন্দর্যের জয়গান অকুণ্ঠ, সুদূরের প্রতি আকর্ষণও তার কাব্যের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবুও তিনি নিঃসন্দেহে আধুনিক। এমনিভাবে প্রখ্যাত অনেক সমালোচক সাহিত্যিক ফররুখ আহমদ সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন।
মানবতাবাদী ও জাতীয় জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ একজন আধুনিক ও সৃষ্টিশীল কবি হওয়ার পরও আত্মপরিচয় ভোলেননি কখনো। সাহিত্য সাধনার দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় তিনি আত্মবিমুখ হননি বরং তার কাব্য ও রচনায় ‘বাঙালি মুসলিম’ পরিচয়টি জাগিয়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন বারংবার।
পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অমানবিকতা ও রূঢ়তার বিরুদ্ধে কবি লেখেন, ‘ত হানি/নিয়ে যাবো জাহান্নাম দ্বারপ্রান্তে টানি/আজ এই উত্পীড়িত মৃত্যু-দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও/ধ্বংস হও, তুমি ধ্বংস হও।’ কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক।১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং বাঙালির অধিকারের পক্ষে কলম ধরেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে। যদি তা-ই হয়, তাহলে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।’ তিনি পাকিস্তানি শাসকদের সমালোচনা করে ‘রাজ-রাজরা’ নামে নাটক রচনা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটকটি মঞ্চায়িত হয়। প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরী এতে অভিনয় করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার ‘মধুর চেয়েও মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা’ গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়। কবি ফররুখ আহমদকে চরম দারিদ্রের সাথে জীবন যাপন করতে হয়েছে। কিন্তু অর্থের প্রতি, ক্ষমতার প্রতি তার কোন মোহ ছিল না। দারিদ্রতাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। ভোগ বিলাসিতা তিনি ঘৃণা করতেন। তার কবিতার মতই ছিল কবির দৈনিক জীবন।
বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ এর পরে অন্যতম সফল মহাকাব্য ফররুখ আহমদ রচিত ‘হাতেম তায়ী’। মুসলিম কবিদের মধ্যে কাব্যনাটক রচনার পথিকৃৎ তিনি। তার ‘নৌফেল ও হাতেম’ একটি সফল ও জনপ্রিয় কাব্যনাটক। সনেট রচনায়ও সফল তিনি। শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, নাটক, অনুবাদসাহিত্যেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য।
ছন্দের কবি, সঙ্গীতঝঙ্কারের কবি ফররুখ আহমদের কাব্যে ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, স্বদেশ, সমকাল ফুটে উঠেছে সার্থকভাবে। অফুরাণ সৌন্দর্য, উদাস কল্পনা, রূঢ় বাস্তবতা, প্রদীপিত আদর্শ, সমুদ্রবিহার, রোমান্টিকতা, প্রেম প্রভৃতি তার কবিতার এক মৌলিক চরিত্র নির্মাণ করেছে।
তার প্রথম ও সেরা কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া আজাদ কর পাকিস্তান (১৯৪৬), সিরাজাম মুনিরা (১৯৫২), নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১), মুহূর্তের কবিতা (১৯৬৩), হাতেম তায়ী (১৯৬৬), পাখির বাসা (১৯৬৫), হরফের ছড়া (১৯৬৮), নতুন লেখা (১৯৬৯), ছড়ার আসর (১৯৭০), নয়া জামাত (১৯৫০), হে বন্য স্বপ্নেরা (১৯৭৬), ইকবালের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮০), চিড়িয়াখানা (১৯৮০), কাফেলা (১৯৮০), হাবেদা মরুর কাহিনি (১৯৮১), সিন্দাবাদ (১৯৮৩), কিসসা কাহিনি (১৯৮৪), ফুলের জলসা (১৯৮৪), তসবির নামা (১৯৮৬), মাহফিল (১৯৮৭), ফররুখ আহমদের গল্প (১৯৯০), ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক কাব্য (১৯৯১), দিলরুবা (১৯৯৪) প্রভৃতি তার অমর সাহিত্যকীর্তি।
গানের ভুবনেও তার পদচারণা ছিল সর্বত্র। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে শিল্পী ও গীতিকার হিসেবে তিনি ব্যাপক খ্যাতি পান। ফররুখ আহমদের লেখা গান আজো আত্মবিশ্বাসী করে তোলে নতুন প্রজন্মকে। ‘তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া, তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাড়া’- এমনি অসংখ্য গান-কবিতা আর সাহিত্যর মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ে যুগ যুগ প্রেরণার বাতিঘর হয়ে বেঁচে থাকবেন কবি ফররুখ আহমদ।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর–আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন–বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’