প্রকাশিত: সোমবার,৩০ নভেম্বর ২০২০ইং ।। ১৫ই অগ্রাহায়ণ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)।। ১৪ই রবিউস-সানি,১৪৪২ হিজরী।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : আজ ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন আশ্চর্যজনক যন্ত্রের আবিষ্কারক হিসেবে বিশ্বে সুপরিচিত বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর ১৬২তম জন্মদিন । ১৮৫৮ সালে ৩০ নভেম্বর ময়মনসিংহ শহরে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে এক বাঙ্গালী সন্তান একশরও বেশি আশ্চর্যজনক যন্ত্র আবিস্কার করে সারা বিশ্বের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। আঙ্গো বাড়ি বিক্রমপুর বলতে আমরা যারা গর্ববোধ করি সেই আঙ্গো বিক্রমপুরের কৃতি সন্তান মহামনীষা বিশ্বাবিখ্যাত বৈজ্ঞানীক স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু।
জগদীশ চন্দ্র বসুর বাবার নাম ভগবান চন্দ্র বসু। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বাবার চাকরির সুবাদে জগদীশ ছেলেবেলার বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন ফরিদপুরে। পড়াশুনার হাতেখড়ি ও হয় ফরিদপুরের এক জেলা স্কুলে। স্কুল বন্ধ থাকাকালীন সময় ছুটে আসত জগদীশ চন্দ্র বসু গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর শ্রীনগর রাঢ়িখালে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা প্রমত্ব পদ্মার ঢেউ তার মনকে স্পর্শ করত। সময় সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন পদ্মার তীরে। জলরাশির ঢেউ, নদীর বিশালতা তার উপরে ভেসে থাকা নৌকা, জাহাজ তার সহজ সরল মনে প্রশ্ন তারিয়ে বেড়াত সবসময়।
মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৮৬৯ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন। ১৬ বছর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উর্ত্তীন হন সর্বোচ্চ মেধা তালিকায় বৃত্তি নিয়ে। ১৮৭৭ সালে এফ.এ পাশ করেন। পিতা ভগবান চন্দ্র বসুর হচ্ছে ছিল ছেলেকে চিকিৎসক বানাবে। সে স্বপ্ন পূরন করার লক্ষে ১৮৮০ সালে ডাক্তারি পড়ার জন্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে বিদেশে পাঠান। কিন্তু অসুস্থতার কারনে তার ডাক্তারি পড়া আর হয়ে ওঠেনা। ১৮৮১ সালে শিক্ষা বৃত্তি নিয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮৮৪ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রী লাভ করেন। তারপর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
ক্যামব্রিজ কলেজের অধ্যাপক লর্ড র্যালে ছাএ জগদীশের ভিতর বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর সন্ধান পান। তার অনুপ্রেরনায় প্রকৃত বিজ্ঞানে অনুপ্রানিত হন। ১৮৮৫ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে ভৌত বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে জগদীশ চন্দ্র বসু নিযুক্ত হন। ১৮৮৭ সালে ২৭শে ফেব্রয়ারি জগদীশ চন্দ্র বসু অবলা বসুকে বিয়ে করেন। অবলা বসু ছিলেন সে সময়ের হিন্দু সমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দূর্গা মোহন দাসের কন্যা ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভাতিজি। এ ছাড়া বিজ্ঞানী বসু বেতার তরঙ্গ নিয়ে নিবিড় গবেষনা করেন। তিনি একজন পদার্থ বিজ্ঞানী হিসেবে তরঙ্গ আবিস্কার করেন যার নাম কোহেরের। মূলত জগদীশ চন্দ্র বসুই রেডিও বেতার যন্ত্রের আবিস্কারক।
তার আবিস্কৃত যন্ত্রগুলোর ক্রোস্কোগ্রাফ এর মাধ্যমে প্রানীর ন্যায় উদ্ভিদেরও জীবন আছে। বিভিন্ন জৈবিক কার্যাবলী সম্পাদন করেন একাধিকবার প্রমান পত্র বিজ্ঞানীদের বিশ্ব সংস্থঅ রয়্যাল সোসাইটিতে উপস্থাপন করেন। গাছ ও মানুষের মত উত্তেজনায় সাড়া দেয় এবং খাদ্য দ্রব্য গ্রহন করে দ্রুতলয়ে বৃদ্ধি ঘটায়।
১৮৯৬-৯৭ সালে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ও রয়্যাল ইনষ্ট্রিটিউশনে বক্তৃতা দেয়ার জন্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে আমন্ত্রন জানায় এবং তার পুরানো কাগজ পত্র ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির ১৮৯৭ এর মিটিং এর দলিল ইত্যাদি সংগ্রহ করে তার সাহায্য প্রমান করার চেষ্টা করেন। যে মার্কোনী নয় জগদীশ চন্দ্র বসুই প্রথম বেতার তরঙ্গের সাহায্যে সংবাদ প্রেরণের উপায় বের করেন। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুই পৃথিবীর প্রথম মাইক্রোওয়েভ যন্ত্র আবিস্কার করেন। যা আজ যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। ১৯১৬ সালে তাকে নাইটহুট উপাধী দেয়া হয়।
বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন তার খুব কাছের মানুষ। বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ গোপাল কৃষ্ণ গোখলে বিভিন্ন সময় তাকে সহায়তা করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। তাছাড়া মহাত্মা গান্ধী ও স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুকে ভালোভাবে জানতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। স্বামী বিবেকানন্দর অন্যতম অনুসারী সিষ্টার নিবেদিতা ছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসুর একজন ভক্ত। প্যারিসে ভ্রমনকালে অসুস্থা হয়ে পড়লে সিষ্টার নিবেদিতা প্যারিসে ছুটে যান এবং তাকে সেবা সুস্থতা দিয়ে সারিয়ে তুলেন।
তিনি ১৯১৭ সালে কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ত্রিশ বছরের অধ্যাপনা জীবনের উপার্জিত অর্থ সর্বস্ব দান করেন। ১৯২০ সালে ১মে রয়্যাল সোসাইটিতে তিনি মনোনিত হন। ২০শে মে চূড়ান্ত সদস্য পদ লাভ করেন। জগদীশ চন্দ্র বসু শুধু বিজ্ঞানীই ছিলেন না, সেই সাথে তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক, সুসাহিত্যিক এবং দেশ প্রেমীক। ১৯২৪ ও ১৯২৬ সালে তার দুইটি গবেষণা মূলক বই প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে একটি বই উৎসর্গ করেন প্রিয় বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। রবি ঠাকুর বন্ধু জগদীশকে দেখতে তার বাড়িতে ছুটে যান। তার জন্য চম্পক ফুল রেখে আসেন। এবং তাকে আমন্ত্রন জানিয়ে আসেন তার বাড়িতে আসার জন্য। ১৯২১ সালে জগদীশ চন্দ্র বসুর গ্রামের বাড়ি রাঢ়িখালে প্রতিষ্ঠা করেন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইনষ্টিটিউট। ১৯২৭ সালে লন্ডনের ডেইলী এক্রপ্রেস পত্রিকায় লিখেছিল জগদীশ চন্দ্র বসু, গ্যালিলিও এবং নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী।
আর বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য যতগুলো তথ্য দান করেছিলেন তাহার যে কোনটির জন্য স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা উচিত। ঐ বছরই জগদীশ চন্দ্র বসুকে নির্বাচিত করা হয় ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে। ১৯২৮ সালে ভিয়েনা একাডেমী অব সায়েন্সের সদস্য পদ লাভ করেন।
১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর পৃথিবীর বিজ্ঞান জগৎ এর মহামানব বিক্রমপুরের কৃতি সন্তান স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু বিহারের গিরিডিতে মৃর্ত্যূবরণ করেন। অন্ধকার কুসংস্কারে আবৃত পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের ধারায় এক অতুলনীয় আলোর ভূমিকা জ্বেলে গেছেন আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম মহামানব স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। তার আবিস্কৃত ডায়োড, ট্রায়োড, ট্রানজিষ্টর থেকে যে ইলেকট্রনিক যন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আজ কম্পিউটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
জগদীশ চন্দ্র বসুর বসত বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি বিদ্যালয়। পরবতী সময়ে তা মহাবিদ্যালয়ে পরিনত হয়। তার নাম অনুসারেই প্রতিষ্ঠানটির নাম করন করা হয় স্যার জে সি বোস ইনষ্ট্রিডিউট স্কুল এন্ড কলেজ। বসত বাড়ির জরাজীর্ণ একটি পুরানো ভবনে করা হয়েছে বসু জাদুঘর। তার মধ্যে ভবনের দেয়ালগুলি সাজানো হয়েছে বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর কিছু র্দূল্যভ ছবি ও তার সৃষ্টিকর্মের কিছু নির্দেশন। ভবনটি জরাজীর্ণ তবু কলেজ কতৃপক্ষ জনগনের সুবিধার্থে খুব যত্ন সহকারে সাজিয়ে রেখেছে। জাদুঘরের সামনে তার একটি পাথরের মর্মর মূর্তি স্থাপিত রয়েছে। এবং বাড়ির পাশে তাদের বাগান বাড়িতে ২০১৪ সালে গড়ে তোলা হয়েছে জগদীশ চন্দ্র বসু কমপ্লেক্স ও পিকনিক স্পট। শীত ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি ছাড়া বছরের প্রায় বিভিন্ন সময়েই বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর পৈতিক বাড়িটি দেখতে দেশ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তর থেকে দর্শণার্থীদের আগমন ঘটে শ্রীনগর উপজেলার রাঢ়িখাল গ্রামে।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’