প্রকাশিত:বৃহস্পতিবার,১০ জানুয়ারি ২০১৯ ::বিক্রমপুর খবর::অনলাইন ডেস্ক :
আজ ১০ জানুয়ারি,বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক দিন। আজ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।১৯৭২ সালের এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসেন। এর মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায় বাঙালির স্বাধীনতা।বিশেষজ্ঞরা বলছেন,দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। একাত্তরে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর শহীদের রক্তস্নাত বাংলার মাটি ও মানুষ এই দিন ফিরে পেয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধু তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’হিসেবে।
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করেছিল বীর বাঙালি।দেশ স্বাধীন হলেও যার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা,সেই অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন
অবশেষে দেখা মিললো ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের কমেট বিমানটির।অপেক্ষায় তখন লাখো জনতা।উৎকণ্ঠা ছাপিয়ে গগনবিদারী জয় বাংলা ধ্বনি।বিজয় অর্জনের পরেও প্রিয় নেতার ফিরে আসার জন্য রনক্লান্ত বাঙালিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২৫ দিন।বাহাত্তর সালের ৮ জানুয়ারি মুক্ত হবার পর ইংল্যান্ড ও ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু।সেই থেকে দিনটি পালন করা হচ্ছে‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’ হিসেবে।
প্রতিবছরের মতো এবারও দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো ছাড়াও বিভিন্ন দল ও সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন,সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন হলেও প্রকৃতপক্ষে জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই বিজয় পূর্ণতা লাভ করে। জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন,এ বছর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসটি আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।দেশের জনগণ জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে টানা তৃতীয়বারের জন্য সরকার পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেছে। নির্বাচনের এ রায় বঙ্গবন্ধু ও তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাদের গভীর আস্থা ও অকৃত্রিম ভালোবাসারই প্রতিফলন।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন,একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে বিজয়ী করেছে।আমাদের ওপর দেশের মানুষ যে দৃঢ় আস্থা রেখেছে, আমরা তার পরিপূর্ণ মূল্যায়ন করব।আমরা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশে পরিণত করব ইনশা আল্লাহ। তিনি আরও বলেন, ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের দ্রুত দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বন্ধু দেশগুলো দ্রুত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধুর ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে অতি অল্পদিনের মধ্যেই বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান তৈরি হয়।
দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়,বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারাদেশে দলীয় কার্যালয়ে দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন।সকাল ৭টায় জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন এবং বিকাল ৩টায় রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনাসভা।এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।এ ছাড়াও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের জন্য প্রতিটি জেলা,মহানগর,উপজেলা,থানা,ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এবং এর সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কেন্দ্রীয় কমিটির অনুরূপ কর্মসূচির আয়োজন করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে আয়োজিত সব কর্মসূচি যথাযথভাবে পালনে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানম-ির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তাকে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দি করা হয়। বাঙালি যখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে, বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় অর্জন হওয়ার পর বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। আন্তর্জাতিক চাপে পরাজিত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত বন্দিদশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুযন্ত্রণা শেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান। এদিন তাকে লন্ডনগামী বিমানে তুলে দেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তিনি পৌঁছেন লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে। যুক্তরাজ্যের বিমানবাহিনীর একটি বিমানে করে ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন বঙ্গবন্ধু। ১০ জানুয়ারি সকালে তিনি নামেন দিল্লিতে। সেখানে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সে দেশের মন্ত্রিসভা, প্রধান নেতারা, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান।
সেদিন বিশেষ বিমানে ঢাকার পথে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়েছিলেন ভারতীয় কূটনীতিক বেদ মারওয়া। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের মানসিক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন,দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকা সত্ত্বেও শেখ মুজিবকে বেশ চাঙ্গা দেখাচ্ছিল। সবকিছুতেই তার মধ্যে প্রচ- উৎসাহ কাজ করছিল। এদিকে সেদিন ঢাকা বিমানবন্দরে তখন অপেক্ষার প্রহর কাটছিল না এ দেশের মানুষের। বঙ্গবন্ধু দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে পা রাখেন তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশের সৃষ্টি, সেই দেশের মহান স্বাধীনতার স্থপতির ফেরার দিনটি ছিল অনন্য এক দিন। সেদিন দেশের সব রাস্তা গিয়ে মিলেছিল তৎকালীন তেজগাঁও বিমানবন্দরে। ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল তার আগমনের পথ। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানান। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা,তোমার আমার ঠিকানা’ধ্বনিতে সেদিন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল।
যে দেশ,যে স্বাধীনতার জন্য জীবনভর লড়াই করেছেন বঙ্গবন্ধু,সেই মাটিতে পা দিয়েই আবেগে কেঁদে ফেলেন তিনি।বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে যারা গিয়েছিলেন, অস্থায়ী সরকারের সদস্য,মুক্তিযোদ্ধা তারাও অশ্রুসজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের এই বরপুত্রকে। বিকাল ৫টায় জননন্দিত শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে তার ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালোবাসি,আমি জানতাম না,সে বাংলায় আমি যেতে পারব কিনা।আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে।বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’