প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার ১০ অক্টোবর ২০২৪, খ্রিষ্টাব্দ।। ২৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ(শরৎকাল )।। ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের আজ ১০০তম জন্মদিন। ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট বাংলাদেশের নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রামে মেছের আলী ও মাজু বিবি দম্পতির ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নড়াইলবাসীর কাছে ‘লাল মিয়া’ হিসেবেও বেশ পরিচিত তিনি।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী এস,এম সুলতান এর ৩১-তম প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই।
প্রতিটি মানুষ মাত্রই যেন একজন চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার কোমল বাসনা মনের গহীনে ধারণ করে থাকেন। কেননা একজন চিত্রশিল্পীই পারেন সাদা ফ্রেমে জলরঙের ছাপে জীবনকে বাস্তবরুপে ফুটিয়ে তুলতে, জীবন সম্পর্কে নিজের অনুভূতিগুলোকে আলাদা আলাদা রং দিতে। এমনই একজন বিখ্যাত চিত্রকর হলেন শেখ মোহাম্মদ সুলতান, যিনি এস এম সুলতান নামে দেশে এবং বিদেশে সমধিক পরিচিত।
শৈশবকাল :
এস. এম. সুলতান ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত তথা বর্তমান বাংলাদেশের নড়াইল জেলার মাছিমদিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবা শেখ মোহাম্মদ মেছের আলী পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী। শৈশবে পরিবারের সবাই তাকে লাল মিয়া বলে ডাকতো। অবধারিতভাবে তাঁকে বিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো সামর্থ্য তাঁর দরিদ্র পিতার ছিল না। তবুও বহু কষ্টে মেছের আলি তার সন্তান লাল মিয়াকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করান। এস এম সুলতান এখানে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন। এরপর স্কুল ছেড়ে বাড়ি ফিরে বাবার সাথে রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন। রাজমিস্ত্রীর কাজ করার পাশাপাশি তিনি সেই দালানগুলোর ছবি আঁকতেন। ১০ বছর বয়সে স্কুলে পড়ার সময় ড: শাম্যপ্রসাদ মুখার্জ্জী স্কুল পরিদর্শনে এসে তাঁর আঁকা ছবি দেখে প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল ছবি আঁকা শিখবেন। এজন্য প্রয়োজন হলে কলকাতায় যাবেন। কিন্তু এরকম আর্থিক সঙ্গতি তাঁর পরিবারের কখনোই ছিলনা। পরবর্তীতে তাঁর এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। জমিদারের সাহায্য নিয়ে সুলতান ১৯৩৮ সালে কলকাতা যান। এরপরে তিনি ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। এখানে তিন বছর পড়াশোনা করেন এবং পাশ করে তিনি ফ্রিল্যান্স চিত্রশিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তার আরেকটা চমৎকার গুণ ছিল তিনি অনবদ্য বাঁশি বাজাতেন।
স্বাধীনচেতা সুলতান :
বিখ্যাত এই চিত্রকর চেতনায় ছিলেন ব্যক্তিস্বাধীন এবং প্রকৃতিগতভাবে ছিলেন ভবঘুরে এবং ছন্নছাড়া। প্রকৃতিকে তিনি সবসময় রোমান্টিক কবির আবেগ দিয়ে ভালোবেসেছেন একই সাথে যান্ত্রিক নগর জীবনকে ঘৃণা করেছেন। এস এম সুলতানের কাছে আধুনিকতা কেমন ছিলো এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘তাঁর কাছে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি, তাঁর আধুনিকতা ছিলো জীবনের শাশ্বত বোধ ও শিকড়ের প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং ঔপনিবেশিক সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন। এটাই তাঁর কাছে ছিলো ‘আধুনিকতা’, অর্থাৎ তিনি ইউরো-কেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের কর্মবিশ্বকে।’
এস এম সুলতানের বিশেষত্বঃ
সুলতানের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, নিজ দেশ ও জাতি নিয়ে এক হিমালয়সম গর্ব, সাধারণ মানুষকে নিয়ে তাঁর দুর্নিবার অহংকার, ভালবাসা, মমত্ববোধ পাশাপাশি সমাজের অন্যায়ের প্রতি প্রচন্ড প্রতিবাদ, ক্ষোভ, আন্দোলন তাঁর তুলির পরশে বিশাল বিশাল ক্যানভাসে জীবন্ত রুপায়িত হয়েছে। বিষয়বস্তুুতে গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষ, শ্রমিক, কৃষাণ, এদেশের কাদাজলের সাথে যাদের আত্মিক সম্পর্ক, যাদের রুটি-রুজির উৎপত্তি স্থল সেই মাঠ, প্রান্তর, সবুজ ধানক্ষেত, যেখানে জমি কর্ষণরত চাষী, রাখালেরা বাঁশীর সুরে মগ্ন, জেলে মাছ ধরায় ব্যস্ত, গৃহস্থালীর কাজে মনোযোগী পল্লীবালা, মাছকোটা, ধানবোনায় ব্যস্ত সুখী পরিবারের চিত্র। কুঁড়েঘর, উঠোন, খড়ের পালা, কলাগাছের সারি, অলস দুপুরে গৃহিনীরা গল্পে ব্যস্ত। গোধূলী বেলায় দূরে কোথাও মেঠোপথে ধূলো উড়িয়ে পল্লী-বধূর বাবার বাড়ি যাওয়ার দৃশ্য। সারি সারি তাল, নারকেল গাছ, বনজঙ্গল, নদীতে পালতোলা নৌকা, মাঝির ভাটিয়ালী সুর, জাল দিয়ে মাছ ধরা, গুনটানায় ব্যস্ত মাল্লা, নদীর ঘাটে কলসীতে জল আনতে গ্রাম্য বধূর সলাজ চাহনী।
চিত্রকর্মে কৃষি :
তিনি শুধু বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন তাঁকে বিশ্বজুড়ে কাল্পনিক কৃষিসভ্যতার জনক বলা হয় । তাঁর জীবনের মূল সুর-ছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, কৃষক এবং কৃষিকাজের মধ্যে। আবহমান বাংলার সেই খেটে খাওয়া কৃষিজীবী মেহনতি মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ, বিপ্লব-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তাঁর শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। তাঁর চিত্রকর্মে গ্রামীণ জীবনের পরিপূর্ণতা, প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি শ্রেণীর দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির সংগ্রামীরূপ ফুটে উঠেছে শিল্পীর একান্ত নিজস্ব মহিমায় ও স্বকীয়তায়। তাঁর ছবিগুলোতে বিশ্বসভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে গ্রামের মহিমা উঠে এসেছে এবং কৃষককে এই কেন্দ্রের রূপকার হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাঁর জীবনকে কৃষি এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তিনি শেষ জীবনে তার পরিপূর্ণতা নিয়ে এইভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন- ‘আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে’।
চিত্রকর্মে কৃষকদের বলিষ্ঠ করার প্রবণতা :
এস এম সুলতানের আঁকা ছবিগুলোতে বাঙালি কৃষকদের দৈহিকভাবে একরকম বলিষ্ঠ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং চিত্রকর বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃষকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো -সেটাও রোগা…। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা আমার মনের ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি সেভাবেই তাদের তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের দেশের এই কৃষক সম্প্রদায়ই একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিলো। দেশের অর্থবিত্ত ওরাই যোগান দেয়। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা র্গ্নু কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়, ফসল ফলায়। ওদের বলিষ্ঠ হওয়া উচিৎ।’
চিত্রে গ্রামীণ রমণীরা :
তাঁর চিত্রগুলোতে সুডৌল ও সুঠাম গড়নে গ্রামীণ নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি যেন নারীর মধ্যে উপস্থিত চিরাচরিত রূপলাবণ্যের সাথে শক্তির সম্মিলন ঘটিয়েছেন। একই সাথে তাঁর ছবিগুলোতে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের শ্রেণী-দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির কিছু ক্রুর বাস্তবতা উঠে এসেছে। তাঁর এরকম দুটি বিখ্যাত ছবি হচ্ছে হত্যাযজ্ঞ (১৯৮৭) এবং চরদখল(১৯৮৮)।
উল্লেখ্য, বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান তার কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮২ সালে পেয়েছেন একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮৪ সালে রেসিডেন্ট আর্টিস্ট স্বীকৃতি, ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননাসহ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’, নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন।
শেষজীবন :
শেষ বয়সে তিনি শিশু শিক্ষার প্রসারে কাজ শুরু করেছিলেন যা নিয়ে তাঁর অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল। তিনি নড়াইলে শিশুস্বর্গ এবং চারুপীঠ নামে দুটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড় তোলেন। এছাড়া সেখানে ‘নন্দন কানন’ নামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি উচ্চ বিদ্যালয় এবং ‘নন্দন কানন স্কুল অব ফাইন আর্টস’ নামে একটি আর্ট স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন।
অসুস্থ অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। প্রিয় জন্মভূমি নড়াইলের কুড়িগ্রাম এলাকায় সংগ্রহশালা চত্বরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এসএম সুলতান।
(বিজ্ঞাপন) https://www.facebook.com/3square1
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর–আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন–বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com
আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।
জাস্ট এখানে ক্লিক করুন। https://www.facebook.com/BikrampurKhobor