মরমী আঙিনা : (চোকদার বাড়ি)
প্রকাশিত : রবিবার,২১ জুন ২০২০ ইং ।। ৭ই আষাঢ় ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।। বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক :
অধ্যাপক ঝর্না রহমান
বিক্রমপুরের গনাইসার গ্রামে আমার নানাবাড়ি ‘চোকদার বাড়ি’তে আমার প্রজাপতির মত ফুরফুরে রঙিন শৈশব বয়ে যেতে লাগলো রোমাঞ্চকর কৈশোরের দিকে। সে বাড়িতে অল্প সময়ের ব্যবধানে আমার দুই মামাতো বোন মরিয়ম আপা আর নীহার আপার বিয়ে ঠিক হল। এই বিয়েকে কেন্দ্র করে আমি গ্রামজীবনের নতুন এক ধরনের গানের সন্ধান পেলাম। সেটা হল বিয়ের গীত! (শৈশবে যে গানকে আমার কাছে নতুন ধরনের মনে হয়েছিল, তা আসলে আবহমান বাংলা সংস্কৃতির শেকড় থেকে উদ্ভুত লোক গান। বিক্রমপুরের লোকগানের সম্ভার বৈচিত্র্যপূর্ণ। সে বিষয় নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ আছে, যা এখানে করার সুযোগ নেই।) নানাবাড়িতে আমি তখন রীতিমত বিখ্যাত গায়িকা। চোকদার বাড়ি অনেক বড়। আম্মার বাপচাচা সাত জন। সুতরাং চোকদার বাড়ির সাত হিস্যা। এক-এক হিস্যায় আম্মার চাচাতো ভাইদের, মানে আমার মামাদের কয়েকটা করে চৌচালা ঘর। তার কোমর সমান উঁচু পাকা ভিত। দরজা থেকে নেমে এসেছে কয়েক ধাপের সিঁড়ি। সিঁড়ির দু পাশ প্রজাপতির শুঁড়ের মত গোল করে পেঁচানো। কোনো কোনো ঘর বিক্রমপুরের ঐতিহ্য অনুযায়ী পাটাতন করা।*১ পাটাতন করা ঘরের সিঁড়িও কাঠের। একপাশে রান্নাঘর, ঢেঁকি ঘর। মাঝখানে চৌকো উঠোন। ভেতর বাড়ির উঠোনের এ মাথা ও মাথা জুড়ে উঁচু করে তার টাঙানো। তাতে মেলে দেয়া হয় শাড়ি লুঙ্গি ভেজা কাঁথা গামছা। মামাদের পুত্র কন্যা পুত্রবধূ নাতিনাতনীতে চোকদার বাড়ি সবসময় গমগম। সুযোগ পেলেই সমবয়সীদের সাথে হয় গল্পে নয় খেলায় মেতে উঠি। উঠোনের তারে লম্বা করে মেলে দেয়া শাড়ির গায়ে লেগে থাকা লালনীল রোদ্দুর আর আলোভরা ছায়া মেখে আমরা, কিশোরী হয়ে ওঠা মেয়েরা লাজুক স্বপ্ন কুড়োই। ভাবীরা দেখতে পেলেই আমাকে ডেকে নিয়ে ব্লাউজের ছাঁট শেখেন আর সিনেমার গান শোনেন। আমিও গান শোনাতে পেয়ে বর্তে যাই। কাজেই মামাতো বোনদের বিয়েতে হলদি বাটা, মেন্দি তোলা, কনেকে ঘিরে বিয়ের গীত গাওয়া, সব কিছুতে আমার অংশগ্রহণ অপরিহার্য হয়ে গেল।
যারা বিয়ের গানগুলো জানে, ওদের কাছ থেকে দু একবার শুনেই আমি শিখে নিয়েছিলাম। অনেক গান জানা হয়ে গিয়েছিল আমার। এখন স্মৃতির পাতায় ধুলো জমেছে। সবই প্রায় ভুলে গেছি। ছিটে ফোঁটা একটু আধটু মনে আছে। যেমন নীহার আপার বরের নাম ছিল সোনা মিয়া। আমরা গীত গাইলাম, সোনামিয়া ঘোড়ায় চলছে উত্তর পাথার দিয়া/ নীহার তোমার মনে লইলে ছাতি ধর গিয়া/ পরান কান্দেরে সোনা মিয়ার লেইগা..। এ গীত অনেক লম্বা। বর কখনো খেতে বসছে, তখন কনেকে বলা হয় পাখা করতে, কখনো মাছ ধরছে, কনেকে বলা হয় ডুলা রাখতে, এভাবে গীত এগিয়ে যেতে থাকে। আবার মরিয়ম আপার বিয়েতে এ গীতে বরের নামের জায়গায় বসাতে হল ‘কালু পুস্তি’। কালু পুস্তি ঘোড়ায় চলছে উত্তর পাথার দিয়া/ মইরম তোমার মনে লইলে ছাতি ধর গিয়া পরান কান্দে রে, কালু পুস্তির লেইগা…। (বিক্রমপুর অঞ্চলের বংশনাম হিসেবে পুস্তি বংশ সেবারই প্রথম শুনি। আমি বালিকা মনের কৌতুকে ভাবতাম নিশ্চয়ই বংশে কেউ কুস্তিগির ছিল, সে কারণে বংশের নাম হবে কুস্তি!) বিয়ে বাড়িতে আপা ভাবীদের অনুরোধে বিয়ের গীত ছাড়াও আমি নিজের জানা গান গাই। আমার সোনার ময়না পাখি, সাগর কূলের নাইয়া রে অপর বেলায়, দোল দোল দুলুনি, নয়নে নয়ন রেখেছো যখন, সই তরে কি বলি আমি বলার কথা নয়, শোনেন শোনেন জাহাপনা…কতরকম গান! আধুনিক গানের পাশাপাশি জোয়ার ভাটা, এতটুকু আশা, মোমের আলো, আয়না ও অবশিষ্ট, মনের মত বউ, নীল আকাশের নিচে, আরও সব হিট সিনেমার আশ্চর্য সুন্দর সুন্দর গানে আমার ভাণ্ডার ভরতি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাইলেও শেষ হয় না!
গ্রামের বিয়েবাড়ি এক হুলস্থুল ব্যাপার। বাড়িতে মেয়েরা সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত। দাউ দাউ করে বড় বড় চুলো জ্বলছে। ঝুলকালির শেকল ঝোলানো প্রচণ্ড উত্তপ্ত রান্নাঘর যেন এক টগবগে জীবনকুণ্ড। বড় বড় হোগলা পেতে চার পাঁচজন মহিলা বসে যান তরিতরকারি কোটাবাছা করতে। নায়রী আর অতিথমেমানের জন্য চাঙারি ভরে কাটা হয় লাউ, কুমড়ো, আলু, ডাঁটা। কেউ পেঁয়াজ কাটে, কেউ পাটা ভরতি করে মসলা বাটে। কিন্তু এ সমস্ত কাজে কারো ক্লান্তি নেই। হাস্যপরিহাসের মধ্য দিয়ে কাজ এগিয়ে চলে। তার সাথে চলে গীত। বউঝিয়েরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে এক একটা গীত। অসাধারণ সে ঐকতান। সুরের ভেতর থেকে ঝরতে থাকে জরিঝিলমিল লাল নীল সুতো। নানাবাড়িতে একজন বয়স্কা নানী ছিলেন। তার নাম ছিল রাজির মা। তিনি হাতের কাছে যা পেতেন, তারে মেলে দেয়া ভেজা গামছা, গরু বাঁধার দড়ির গোছা, তরকারি খাওয়ার জন্য এনে রাখা শাপলার বিড়া, সেটাই মালার মত গলায় ঝুলিয়ে কোমর দুলিয়ে গীত শুরু করেন। নানীর নৃত্য দেখে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে। গ্রামে এমন আরও দু একজন নাচুনি গাউনি নারী থাকতেন। বিয়ে বাড়িতে গীত গাওয়া ও নাচ করার জন্য তাদের ডাক পড়তো। ঐ সমস্ত গানগুলো গ্রাম্য রসিকতায় ভরপুর থাকতো। যেমন মরিয়ম আপার বিয়েতে গীত গাওয়া হচ্ছে, উড়ই উড়ই চড়ইরা যায় হে/ দুলার বইনে হারানি গেছে পাওয়া যায় না হে। তার উত্তরে পরে বলা হচ্ছে, পাওয়া গেছে পাওয়া গেছে হে/ কন্যার ভাইয়ের লেপের তলে পাওয়া গেছে হে! এসব গান গেয়ে হাসিতে গড়িয়ে পড়ি আমরা। বর পক্ষকে খুব ঢিট করা গেছে! (ছেলের বিয়ে হলে এখানে বলা হবে কন্যার বইনে হারানি গেছে। বোনের পর ভাই, ভাবী, দুলাইভাই মা, বাবা, চাচা চাচী সবাইকে নিয়ে এই রসিকতার গীত চলতে থাকে।) গানের কথার আড়ালে যে আদিরসাত্মক ইঙ্গিত আছে সেটা বুঝতে পেরে লজ্জাও লাগে। আসলে গ্রামীণ মানুষের সরল প্রাণের নিষ্কলুষ আনন্দের এক অনিন্দ্য উৎস এই গীতগুলো।
এদিকে গান গান করে আমি আমার বিপদ ডেকে আনতে থাকি। আমাদের বাড়িতে তরুণ ভাই বেরাদরের আসাযাওয়া বাড়তে থাকে। তারা আমাকে ঘিরে গুনগুন করে! মিছরি মাখা হাসি আর রোমাঞ্চভরা চাহনি দেয়। আমার বড় খালার শ্বশুরবাড়ি শিলই গ্রামে। খালাম্মার শ্বশুর বাড়ির লোকজন পীর জাহেদ আলীর মুরীদ। এই মুরীদ গোষ্ঠী খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির অনুসারী। তাদের ধর্মাচরণের তরিকা আলাদা। পাঁচওয়াক্ত নামাজ রোজা এসব করে না, ওরা মাঝে মাঝে ভক্তিমূলক মাইজভাণ্ডারি গানের আসর করে। আর একদল আছে, তারা মাদার পীরের অনুসারী। মাদার পীরের ওফাত দিবসে ওরশ করে। ওরশের নাম মাদার বাঁশ। মাদার বাঁশ অনুষ্ঠানে উৎসবের সাড়া পড়ে যায়। মুরীদানগণ লোকের বাড়ি বাড়ি থেকে চালডাল নুন তেল হলুদ মরিচ সব ভিক্ষান্ন হিসেবে সংগ্রহ করে। তারপর নুনঝালতিতামিঠাদুগ্ধমধুতেঁতুলবেথুল যা পাওয়া গেল সব একসাথে মিলিয়ে রান্না করা হতো। রন্ধনকৃত সেই খাদ্য অনেকটা শক্ত ইটের ঢেলার মত রূপ পেত। প্রচণ্ড ঝালনুন। অনুসারী সবাই সেই পিঠার তক্তি ভেঙে ভেঙে ভক্তিভরে খায়। পিঠারূপী প্রসাদের নাম ‘বস্তু’। ওরশের সময় আমরা কয়েকবারই শিলই গ্রামে গিয়েছি। খালাম্মাই আমাদের যাওয়ার জন্য দাওয়াত পাঠাতেন।
আমার বড় খালাম্মার পাঁচ ছেলে। খাজাবাবা আর মাদার বাবার তরিকার প্রভাবে ওরাও বেশ ভালো গান করে। মেজো জন, এসব মারফতি গান ছাড়াও, শ্যামল মিত্র সতীনাথ মুখোপাধ্যায় এদের গান গাইতেও খুব ভালোবাসেন। খালাতো ভাইরা সবাই আমার গানের ভক্ত বনে যায়। মাঝে মাঝে ওরা কেউ আসেন, নানা উপলক্ষে আমাদেরকে, কখনো বা শুধুই আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যেতে। বড় খালাম্মার শ্বশুর বাড়ির নাম সরকার বাড়ি। সরকার বাড়িতে যেতে আমার বেশ ভাল লাগতো। জ্ঞাতিগোষ্ঠি ভরা বিশাল বাড়ি। বাড়ির উঠোনে নানরকম শস্যের রোদ গনগন করে। গাছগাছালির পাতা থেকে চুঁয়ে পড়ে বন্য গন্ধ। খড়ের গাদার ভেতর থেকে কেমন একধরনের ধোঁয়াশা ভাপ ওঠে। উঠোনের চারপাশ ঘিরে বড় বড় ঘর। পুরোনো দালানবাড়িও আছে। দালানবাড়ির ভেতরে দেয়াল আলমারিতে থাক থাক করে রাখা ‘উঠানো’ জামাকাপড়, মোরব্বার বৈয়ম, হাতে কাটা জিরে সেমাই আরও কত কী। সব কিছুর ভেতরে ভূতের মত বসে থাকে গা শিরশির করা রোমাঞ্চকর গল্প। খালাম্মা আমাকে সবার ঘরে নিয়ে যান। এক-এক ঘরে গিয়ে আমি বসে যাই গান গাইতে। আমার খালাতো ভাইরাও আমাকে উপস্থাপন করতে পেরে মহা খুশি। ভাবখানা এই, দেখ, আমার বোন কত সুন্দর গান করে! মেজোও আমাকে গান শোনান, আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা এখনি নামবে অন্ধকার, মরমীয়া তুমি চলে গেলে দরদী আমার কোথা পাবো! বালিকা হলে কী হবে, আমার সিক্সথ সেন্স প্রখর। আমার মনে হয় মেজো কাজিনের গানের ভাষায় কিছু একটা ঘাপলা আছে! আম্মা ঠিকই তাঁর বড় বুজির মনোবাসনা বুঝতে পারলেন। সুতরাং সোজাসুজি সবাইকে শুনিয়ে দেন, তার কন্যাটির পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে কোনো বিয়েটিয়ে নাই। তা ছাড়া মেয়ের তো বিয়ের বয়সও হয় নাই! জননীর বিচক্ষণতার জন্য এগারো না পেরুতে আমার কয়েকটা বিয়ের ‘প্রস্তাব’ এভাবে ঠেকানো গেছে (যদিও শেষ রক্ষা হয়নি!!!)। যাই হোক, শিলই গ্রামের গানের প্রসঙ্গে আসি।
শিলইয়ে বড় খালাম্মার বাড়িতে যতবার গিয়েছি, ওরশ বা মাদার বাঁশ ছাড়াও, মারফতি বা ভক্তিমূলক গানের আসর প্রায় প্রতিবারই দেখতে পেয়েছি। খালাম্মাদের পাটাতন করা ‘টপ বারান্দা’ওয়ালা ঘরের এক পাশে মাদার পীরের মাজার ঘর (একটা ঘরের ভেতর গিলাফ ঢাকা কবর ছিল)। সে ঘরে নারী পুরুষ মিলে উন্মাদনা নিয়ে সমস্বরে গান করে। উদ্বাহু হয়ে তালি দিয়ে দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে নাচে। পরে বুঝেছি এসব গানে রয়েছে এক ধরনের মরমীবাদ বা সুফিবাদ। অধ্যাত্মচেতনা বা ভক্তি এ গানের মূল প্রেরণা। গানের মধ্যে ভক্তির জোয়ার তীব্র হয়ে উঠলে কারো কারো ‘ভার’ উঠতো। ওঁরা উন্মাদের মত জিকির করতেন, নৃত্য করতেন, তারপর কেউ কেউ চোখ উল্টে পড়ে থাকতেন! খালাম্মার ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট রুনু আমার সমবয়সী। রুনুই আমাকে নিয়ে যেত সেই মারফতি গানের আসর দেখাতে। গানওয়ালাদের তেলেসমাতি দেখে আমার বালিকামনে কিছুটা ভীতির সঞ্চার হলেও গানগুলো দারুণ লাগতো। মনে লেগে যায় কয়েকটা গান। তবে গানগুলো ভালো লাগার পেছনে কোনো সুরের জাদু কাজ করতো না। ঐ বয়সে গানের বাণীর ভক্তিরস বা আধ্যাত্মিক তত্ত্বও বুঝতাম না। গান ভালো লাগতো তার বিটের জন্য। এক-একটা গানে সত্যিই শরীরে কেমন পাগলা মাতন লাগতো! বাবা ভাণ্ডারি/ লাইন ছাড়া চলে না রেলগাড়ি। অথবা, মাওলা ধন রে, কে পারে বুঝিতে তোমার শান/ গুরু ধন রে, কে পারে বুঝিতে তোমার শান/ তিন জগতে ডংকা বাজে চৌদ্দ ভুবন কম্পমান…। আর একটা গান আমরা বোনরা মিলে রীতিমত আখড়া স্টাইলে গাইতাম, আমি মইলে যেন পাই তোমারে গো/ পূর্ণ জনম লইয়া/ আমি মইলে এই করিও/ না পুড়িও না গাড়িও/ না ভাসাইও যমুনার জলে/ বন্ধু বন্ধু বন্ধু বলে/ নাম শুনাইও কর্ণমূলে/ আমি বন্ধুর নামটি যাই শুনিয়া গো..। এটি বৈষ্ণব তত্ত্বের গান। বিক্রমপুরে এক সময় বৈষ্ণব ধর্ম বেশ প্রসার লাভ করেছিল।* বিভিন্ন গ্রামে গড়ে উঠেছিল বৈষ্ণব আখড়া। এমন কি বর্তমানেও কোনো কোনো গ্রামে বৈষ্ণব ধর্মের নানারকম আচরণ রয়েছে। শিলই গ্রামেও বৈষ্ণব ধর্ম সাধনা চলতো। তারই প্রভাব পড়েছিল আমার খালাম্মার শ্বশুর বাড়ির ঐ পীরমুরীদান গোত্রের মধ্যে। আমরা বোনেরা খুব পছন্দ করতাম এই গান। নেচে নেচে কতদিন এসব গান করেছি! খালাতো ভাইদের দেখলেই আমরা ছেঁকে ধরতাম, এসব গান করার জন্য। কিন্তু আমার আম্মা এই গান পছন্দ করতেন না। বলতেন যত্ত সব বেদাতি কারবার। মেয়ে পুরুষ মিলে এক জায়গায় নাচগান করে। নামাজ রোজা করে না। রাধাকিষনো গান করে! কবর পুজা করে! তোবা তোবা!
আম্মার ভক্তিপ্রণত চিত্ত মগ্ন থাকতো ইসলাম ধর্মের বিষয়গুলোতে। আমার নানা পীয়ার বখশ চোকদার ছিলেন বুজুর্গ আলেম। তাঁকেও গনাইসার গ্রামের লোকজন পীরের মত ভক্তি করতো। আমার নানী আম্মার শৈশবে প্রয়াত হয়েছিলেন। আমার নানাও তার কিছুকাল পরে অন্ধ হয়ে যান। নানা চোকদার বাড়ির বহির্বাটিতে স্থাপিত মসজিদেই দিন কাটিয়ে দিতেন। জনশ্রুতি আছে আমার নানার সাথে রাতে মসজিদে জ্বিনেরা নামাজ পড়তো। এসব কাহিনিতে আমার আম্মার গভীর বিশ্বাস ছিল। আম্মাকে তাই সারা জীবনে নামাজ রোজা ক্বাজা করতে দেখিনি আর দেখিনি কোরান তেলাওয়াত না করে দিন শুরু করতে। তাই আম্মা একান্ত সময়ে আপন মনে যে গানগুলো গাইতেন সেগুলো কোনো সিনেমার গান নয়, জনপ্রিয় কোনো আধুনিক গানও নয়। আম্মা গাইতেন নবী রাসূলের প্রশস্তিমূলক গান আর ইসলামী গান। কয়েকটি গান আজও আমাদের স্মৃতির পাতা আলোকিত করে রেখেছে ~ হেই মুসলামান ঠিক রাখো ঈমান যেন মুসলমান ডুবে না/ নবীর ত্বরিক যেন ডুবে না/ নবী বলে বেনামাযী আমার কাছে এস না/ তোমার ও মুখ দেখলে আমি, আমার খাওন মিলে না…। অথবা, বাদশা ছিল সেকান্দর/ চন্দ্র সূর্য দিছে কর/ সে তো গেল খালি হাতে কিছুই সাথে নিল না/ সকলই চলিয়া গেল আমার জীবন কেন ফুরায় না…। কিংবা, খোদা তোরে ডাকতে জানি না/ ডাকার মত ডাকলে খোদায় কেন শুনবে না/ এক ডাকিয়াছিলেন মুসা নবী/ কোহিতুরে খোদার ছবি/ খোদার নূরে পাহাড় জ্বলে তবু মুসা জ্বলে না… (এভাবে আয়ুব নবী, ইউনুস নবী, ইব্রাহীম নবীর বিভিন্ন আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কাহিনি জুড়ে জুড়ে লম্বা গান) আমাদের ছোট ভাইবোনদের ঘুম পাড়াতে গিয়ে, কখনো দোলনায় দোলা দিতে দিতে আম্মা এসব গান গাইতেন। আমার গানের রত্নগৃহে এসব ভক্তিরসাশ্রিত আনত চিত্তের গান এখনও সযত্নে সংরক্ষিত আছে। (চলবে)
*১ বিক্রমপুরের বিভন্ন উপজেলায় অনেক গ্রামেই এখনও সেই ঐতিহ্যবাহী উপকরণ ও নকশায় ঘর তৈরি হয়। তবে ঐতিহ্যের সাথে অবশ্যই মিশে গেছে আধুনিকতা। অনেক বাড়িতেই উঠোনের তিনদিকে তিনটি পাটাতন করা আর শানবাঁধানো ভিত্তির চৌচালা ঘর থাকলেও প্রধান ঘরটি তৈরি হয়েছে পাকা দোতলা তিনতলা কিংবা আরও উঁচু আধুনিক কেতার বিল্ডিং রূপে।
*২ হিন্দু জমিদার চন্দ্রবিনোদ পাল চৌধুরীর (১৮৬৭) নাম শোনা যায় যিনি বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী ছিলেন এবং বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে সচেষ্ট ছিলেন। ‘শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব ও প্রেমধর্ম’ শিরোনামে একটি বইও লিখেছিলেন। তিনি তাঁর অধীনস্থ ডহরি গ্রামের নাম ‘গৌরগঞ্জ’ রেখেছিলেন। গৌরগঞ্জ গ্রাম পদ্মার গ্রাসে কবলিত হয়েছে বহু আগেই। বিক্রমপুরের সিরাজদিখানে আবিরপাড়া গ্রামের নামকরণেও এমনি বৈষ্ণব প্রভাব লক্ষ করা যায়। আবীরপাড়া গ্রামের বিদ্যোৎসাহী জমিদার কুঞ্জবিহারীর নামও বৈষ্ণব সাহিত্যিক হিসেবে সারা বিক্রমপুরে খ্যাত ছিল। ‘বঙ্গদেশে শ্রীচৈতন্য’ তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত প্রবন্ধ, যা পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল শ্রী হিমাংশুমোহন চট্টোপাধ্যায়ের ১৩৫০ সনে প্রকাশিত ‘বিক্রমপুর’ পত্রিকার তৃতীয় খÐে। (সূত্র: অধ্যাপক মো.শাহজাহান মিয়া রচিত প্রবন্ধ ‘বিক্রমপুরে বৈষ্ণব ধর্ম’: ‘অগ্রসর বিক্রমপুর’ পত্রিকা, ১০ম সংখ্যা, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০১৯)
ছবি: ১, বিক্রমপুরের ঐতিহ্যবাহী পটাতন করা ঘর, সিরাজদিখানে রাজদিয়া গ্রামে আমার ফুপুর বাড়িতে।
ছবি ২, সিরাজদিখানে রাজদিয়া গ্রামে একটি হিন্দু বাড়িতে বৈষ্ণব সমাধিগৃহ।
ঝর্না রহমান
পোস্ট: ২১ জুন, ২০২০
================ অধ্যাপক ঝর্না রহমান ==============
বিক্রমপুরের কৃতী সন্তান অধ্যাপক ঝর্না রহমান-এর জন্ম ২৮ জুন ১৯৫৯ সালে। তাঁর গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ সদরের কেওয়ার গ্রামে। ঝর্না রহমান একজন কথাসাহিত্যিক,কবি ও সংগীত শিল্পী। চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি লেখালিখির সাথে জড়িত।
গল্প উপন্যাস কবিতার পাশাপশি লেখেন প্রবন্ধনিবন্ধ, ভ্রমণসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, নাটক। ১৯৮০ সনে বাংলাদেশ পরিষদ আয়োজিত একুশের সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ছোটগল্পে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ। চারটি সম্পাদনা গ্রন্থসহ এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৫০। তাঁর একাধিক গল্প ও কবিতা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে এবং তা দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন মর্যাদাসম্পন্ন সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। কানাডার ভ্যাংক্যুভার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য Trevor Carolan সম্পাদিত দক্ষিণ এশিয়ার গল্প সংকলন The Lotus Singers গ্রন্থে তাঁর গল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত পাঞ্জাবী সাহিত্যিক অজিত কৌর আয়োজিত সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে একাধিকবার সাফল্যের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর পড়াশোনার বিষয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর।
পেশাগত ক্ষেত্রে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, বাংলা। অবসরে তাঁর কর্মক্ষেত্র লেখালিখি। ঝর্না রহমান একাধারে একজন গীতিকার সুরকার এবং বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত কণ্ঠশিল্পী।
এ ছাড়া তিনি কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ পরণকথা এবং অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের মুখপত্র ত্রৈমাসিক অগ্রসর বিক্রমপুর সম্পাদনা করেন ।
তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই:গল্পগ্রন্থ: ঘুম-মাছ ও এক টুকরো নারী, স্বর্ণতরবারি, অগ্নিতা, কৃষ্ণপক্ষের ঊষা,নাগরিক পাখপাখালি ও অন্যান্য,পেরেক, জাদুবাস্তবতার দুই সখী,নিমিখের গল্পগুলো,বিপ্রতীপ মানুষের গল্প,বিষঁপিপড়ে, Dawn of the Waning Moon (অনূদিত গল্প) ,তপতীর লাল ব্লাউজ, উপন্যাস: ভাঙতে থাকা ভূগোল, পিতলের চাঁদ, কাকজোছনা। কাব্য: নষ্ট জোছনা নষ্ট রৌদ্র, নীলের ভেতর থেকে লাল, জল ও গোলাপের ছোবল, জলজ পঙক্তিমালা, ঝরে পড়ে গোলাপি গজল, চন্দ্রদহন, উড়ন্ত ভায়োলিন, হরিৎ রেহেলে হৃদয়। কিশোর উপন্যাস: আদৃতার পতাকা, হাতিমা ও টুনটুনি, নাটক: বৃদ্ধ ও রাজকুমারী, প্রবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ: সেঁজুতি, রৌদ্রজলের গদ্য।
মা:রহিমা বেগম,বাবা:মোঃ মোফাজ্জল হোসেন,গ্রামের বাড়ি:কেওয়ার,মুন্সিগঞ্জ। জন্ম:২৮ জুন,১৯৫৯।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com
আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।
https://www.facebook.com/BikrampurKhobor