প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১ইং।। ১৬ই বৈশাখ ১৪২৮ বঙ্গাব্দ(গ্রীস্মকাল)। ১৬ রমজান ১৪৪২ হিজরী
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : আজ থেকে ৩০ বছর আগের কথা। ২৯ এপ্রিল উপকূলবাসীর বেদনার দিবস হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের দিবাগত মধ্যরাতে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনাসহ দেশের উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। এতে দুই লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটার পাশাপাশি নিখোঁজ হয় এক লাখ মানুষ। ৭০ হাজার গবাদিপশু মারা যায়। ওই রাতের তাণ্ডবে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে সরকারি হিসাবে বলা হয়। তবে বেসরকারি হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৬০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৩৩টি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হেনেছে। দেশে প্রচণ্ডতম ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর। এতে ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলের সবকটি উপকূলীয় জেলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে ছিল প্রায় ৩৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস। প্রাণহানির সংখ্যা সরকারিভাবে বলা হয়েছিল পাঁচ লাখ।
কিন্তু বেসরকারি হিসাবে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। দেশের ইতিহাসে ১৯৭০-এর ওই ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সেই ঘূর্ণিঝড়ে এত ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির প্রধান কারণ যথাসময়ে পূর্বাভাস বা সতর্কসংকেত না দেওয়া। কেউ বুঝতেই পারেনি এত প্রচণ্ড ও ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় উচ্চ জলোচ্ছ্বাস নিয়ে ধেয়ে আসছে।
ঘূর্ণিঝড়ের পর উদ্ধার কাজ ও ত্রাণ তৎপরতাও মোটেই পর্যাপ্ত ছিল না। তখন পাকিস্তানি শাসনামল। এতবড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ পাকিস্তান সরকারের কাছে কোনো গুরুত্ব পায়নি। সরকারের এ অবহেলা পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের ক্ষোভ ও ঘৃণা আরও তীব্র করে তোলে। এর প্রতিফলন ঘটে ওই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে।
জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের যোগ্যতা পায়।
১৯৭০-এর পর ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ই দেশের দ্বিতীয় প্রচণ্ডতম ঘূর্ণিঝড়। এই ঝড়ে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় অঞ্চল এবং সবকটি দ্বীপ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চট্টগ্রাম শহর ও নৌবন্দরও ঝড়ের কবলে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়টির উৎপত্তি হয় ২৪ এপ্রিল বঙ্গোপসাগরে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছে। এটি ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উত্তরদিকে অগ্রসর হয় এবং ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে। দীর্ঘস্থায়ী এ ঘূর্ণিঝড়টি প্রায় ১২ ঘণ্টা ধ্বংসলীলা চালায়।
ঘূর্ণিঝড়ের খবর ২৯ এপ্রিল রাতেই ঢাকায় পৌঁছায় এবং সেই রাতে টেলিভিশনে এবং পরদিন সংবাদপত্রে আংশিক খবর প্রচারিত হয়। কিন্তু প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির সঠিক বিবরণ পাওয়া যাচ্ছিল না।
বাংলা সনের চৈত্র-বৈশাখ মাসের তীব্র গরমে মাঠঘাট ফেটে চৌচির ছিল ওই ঘূর্ণিঝড়ের সময়। শুকনো ছিল খাল, বিল, নদীনালা ও পুকুর। সারা দিন আকাশে মেঘ জমাছিল, গুঁড়িগুঁড়ি হালকা বৃষ্টিও পড়ছিল সারা দিন। সপ্তাহের সোমবার দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা যতই ঘনিয়ে আসছে, বাতাসের একটানা গতিবেগ ততই বাড়তে থাকে।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবিরা প্রচার করতে থাকে দুর্যোগের খবর। কিন্তু ভুক্তভোগীরা কেউ পাত্তাই দিলো না- করল অবহেলা। ওই অবহেলাই কাল হলো অনেকের। ঘূর্ণিঝড়ের ছোবলে সন্তান হারায় মা-বাবাকে, মা হারান তাঁর প্রিয় সন্তানদের, স্বামী হারান স্ত্রীকে, স্ত্রী হারান তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্বামীকে। সে ভয়াল রাতের স্মৃতি মনে পড়লে উপকূলবাসী এখনও আঁতকে উঠে।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর এ রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয় আরও হয়েছে। কিন্তু তাতে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল অনেক কম। কারণ বিপৎসংকেত ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে, সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি হওয়ামাত্র সতর্কবার্তা ও বিপৎসংকেত দেওয়া শুরু হয়। উপকূল অঞ্চলে সাইক্লোন শেল্টার আরও বাড়ানো হয়েছে। এখন শুধু রেডক্রসের স্বেচ্ছাসেবী নয়, জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও উপদ্রুত এলাকার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সহায়তা করেন। উপকূলবাসীর সচেতনতাও বেড়েছে।
এরপরও ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর যে ঘূর্ণিঝড় হয় তাতে প্রায় ১০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এই ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সিডর’। উপকূলের ১১টি জেলা সেই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড়টি ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী, বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার। ২০০৯ সালের ২৫ মে ‘আইলা’ নামের আরও একটি প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় পটুয়াখালীসহ কয়েকটি জেলায় আঘাত হানে। এতে প্রায় ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়। গবাদি পশু, ফসল, বৃক্ষ ও ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রচুর।
ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি যাতে না হয় বা কম হয় সেজন্য গৃহীত ব্যবস্থা কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। উপকূলে সামাজিক বনায়ন সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে করা গেলে তা অবশ্যই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা পর্যাপ্ত পরিমাণে কমিয়ে আনতে পারে। সুন্দরবন এর একটি উদাহরণ। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা সুন্দরবন খুলনা বিভাগের জেলাগুলোকে ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করছে দীর্ঘকাল থেকে। প্রাকৃতিক সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে, সামাজিক বনায়নও করতে হবে উপকূলবাসীকে বাঁচাতে।
২৯ এপ্রিল নিহতদের স্মরণে আজ দেশের উপকূলের প্রতিটি বাড়িতে ফাতেহা চলছে। কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল, দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভা, কাঙালিভোজ, চিত্র প্রদর্শনীসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন নানা সংগঠন।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com
আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।