প্রকাশিত: রবিবার,১২মে ২০১৯। ২৯শে বৈশাখ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। বিক্রমপুর খবর ডেস্ক :
আমার মায়ের ছবি
— ড.নূহ-উল-আলম লেনিন
তোমার একটা ছবি আঁকব ভেবে রং-তুলি
নিয়ে ইজেল সাজাতেই আকাশ জুড়ে বর্ষা
আমার সব রং-তুলি ভাসিয়ে নিল।
আমার মনটাও গেল ভিজে এবং মনের ভেতরে
তোমার ছবিটাও।
অবাক বিস্ময়ে অনুভব করলাম আমি শৈশবে
ফিরে গেছি। বৃষ্টি ভেজা দুপুরে দুই দুরন্ত কিশোর-কিশোরী
মেজদি ও আমি, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। হঠাৎ সূর্যালোকের উদ্ভাস।
খেঁকশিয়ালের বিয়ে হবে। ও পাড়ায় শারদীয় ঢাকের শব্দ।
মায়ের সাথে খুঁনসুটি। কলা চুরি করেছি আমি; আর মারটা খেলো মেজদি।
আহা! সেদিন মেজদিটার জন্য আমার বড্ডো মায়া লেগেছিল।
মেজদি ও আমি, মায়ের ন্যাওটা, কিন্তু এঁড়ে বাছুরের মতোই দুরন্ত,
কখনো অবাধ্য, কখনো একান্ত সহায়।
ভাবলাম, আজ মাকে নিয়ে কয়েকটি পঙ্ক্তি রচনা করব।
কলমটা খুঁজে পেতে ঘরে ঢুকতেই দেয়ালে মায়ের প্রসন্ন মুখ,
বললেন, ‘খোকা তোর কলমে কালি নেই, তুই অযথাই পঙ্ক্তি
মেলাতে যাস নে। এই তো আমি আছি, তুই বরং একবার পদ্মায়
ডুব দিয়ে আয়। অনেকদিন তোকে ছুঁতে পারি না।
পদ্মার ভাঙনে আমাদের গ্রাম পতনের পর মানুষের
স্থায়ী আসন কবর থেকে আমার মায়ের মমির মতো লাশটাকে
বড়দা পদ্মায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে
আমার মা পদ্মার জলে মিশে আছেন। পদ্মা আমার মা।
ওই জলে আমার জীবন জুড়ায়।
‘আমাদের মা‘
–-হুমায়ুন আজাদ।
আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।
আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।