সুরের মায়ায় কালজয়ী হয়ে আছেন শচীন দেববর্মণ

0
15
সুরের মায়ায় কালজয়ী হয়ে আছেন শচীন দেববর্মণ

প্রকাশিত:শনিবার,৩১ অক্টোবর ২০২০ইং ।। ১৫ ই কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)।। ১৩ই রবিউল আউয়াল,১৪৪২ হিজরী।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : শুধু সঙ্গীতশিল্পী হিসেবেই নয়, গীতিকার হিসেবেও তিনি সার্থক। বহু চলচ্চিত্রে সাফল্যের সাথে সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। শতবর্ষ পেরিয়েও বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে তাঁর কালোত্তীর্ণ গানের আবেদন বিন্দুমাত্র কমেনি। বলছি, বিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় বাংলা গানের কিংবদন্তীতুল্য ও জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী শচীন দেববর্মণের কথা। ‘নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক পায়েলখানি বাজে’ কিংবা ‘ঘাটে লাগাইয়া ডিঙ্গা’র মত অসংখ্য জনপ্রিয় গান তার অন্তরসৃত।
উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরকার তিনি। যে কী-না কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় অনেক গানের সুরকার। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- পদ্মার ঢেউ রে। এছাড়াও শচীনের গাওয়া অথবা সুর করা গানের মধ্যে রয়েছে- ‘তুমি এসেছিলে পরশু’, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’, ‘কে যাস রে ভাটি গাঙ’, ‘নিশিথে যাইওরে ফুলবনে’, ‘শোনো গো দখিন হাওয়া’, ‘রঙিলা রঙিলা’, ‘ঝিলমিল ঝিলমিল’, ‘নিটল পায়ে’, ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে’, ‘তুমি আর নেই সে তুমি’, ‘টাকডুম টাকডুম বাজে’, ‘আঁখি দুটি ঝরা’ ইত্যাদি।
বিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি গানের কিংবদন্তীতুল্য ও জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার, গায়ক ও লোকসঙ্গীত শিল্পীকে এস ডি বর্মণ হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। কিছুটা অনুনাসিক কণ্ঠস্বরের জন্য তিনি তাঁর শ্রোতাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত।
আজ ৩১ অক্টোবর কীর্তিমান এই সঙ্গীতজ্ঞের প্রয়াণদিন। প্যারালিটিক স্ট্রোক হয়ে পাঁচ মাস কোমায় থাকার পর ১৯৭৫ সালের এইদিনে তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর উপমহাদেশের আলোচিত এই সঙ্গীতশিল্পীর জন্ম কুমিল্লায়। ছোটবেলা থেকে সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী ছিলেন শচীন। তিনি ত্রিপুরার চন্দ্রবংশীয় মানিক্য রাজপরিবারের সন্তান। বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করেন। তৎকালীন ত্রিপুরার অন্তর্গত কুমিল্লার রাজপরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তাঁর মা মণিপুরি রাজবংশের মেয়ে নিরুপমা দেবী।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ঐ কলেজ থেকে আইএ এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ তে ভর্তি হন। ত্রিপুরার মহারাজারা কুমিল্লায় তৈরি করেন টাউনহল, নাট্যশালা, লাইব্রেরি এবং নানা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের দিকে শচীন দেবের বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, অজয় ভট্টাচার্য, মোহিনী চৌধুরী, সমরেন্দ্র পাল, কাজী নজরুল ইসলাম, শৈলবালা দাম, ধ্রুপদীয়া সৌরেন দাশ, সুধীন দাশ প্রমুখ। সেখানে নিয়মিত আসতেন চলচ্চিত্র পরিচালক সুশীল মজুমদার, ননী মজুমদার, ব্রজেন ব্যানার্জি, জিতু দত্ত, অরুণ মহলানবিশ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। তাঁর গানের ধরন ছিল ভোরকীর্তন, নগরকীর্তন, কবিগান, ঢপযাত্রা। সাহিত্যিক, সুরকার, গীতিকার, কবি ও সঙ্গীতজ্ঞগণ ইয়ংমেন্স ক্লাবে একত্রিত হতেন। তাদের আড্ডা থেকে ভেসে আসত নজরুল ও শচীন দেবের গান।
নজরুল কুমিল্লা এলে থাকতেন তালপুকুরের পশ্চিমপাড়ের একটি ঘরে। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে শচীন দেব কুমিল্লা থেকে কলকাতা চলে যান। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে তিনি প্রথম গান করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে পিতা নবদ্বীপচন্দ্র কলকাতায় দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী। শচীন দেব তখন থাকতেন কলকাতার ত্রিপুরা প্যালেসে।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয় হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস থেকে শচীন দেবের প্রথম রেকর্ডকৃত দুটি গান হল পল্লীগীতির ঢঙে গাওয়া “ডাকিলে কোকিল রোজ বিহানে” যার গীতিকার হেমেন্দ্র কুমার রায় এবং খাম্বাজ ঠুমরি অঙ্গের রাগপ্রধান ‘এ পথে আজ এসো প্রিয়’ যার গীতিকার শৈলেন রায়।
১৯৩০-এর দশকে তিনি রেডিওতে পল্লীগীতি গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পূর্ব বাংলা এবং উত্তর-পূর্ব বাংলার পল্লীগীতির উপর তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে অল ইন্ডিয়ান মিউজিক কনফারেন্সে তিনি গান গেয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে ঠুমরি পেশ করে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁকে মুগ্ধ করেছিলেন। শেখ ভানুর রচনা ‘নিশিথে যাইয়ো ফুলবনে’ দেহ ও সাধনতত্ত্বের গানটিকে প্রেমের গানে রূপান্তর করলেন কবি জসীমউদ্দীনকে দিয়ে এবং রূপান্তরিত এই গানটি রেকর্ড করলেন ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে।
তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- শোন গো দখিন হাওয়া, বিরহ বড় ভাল লাগে, সুবল রে বল বল, বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে, কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া এবং ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে লেখা তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে রাজগী নামক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গীত পরিচালনা জীবনের শুরু। তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় বহু গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- যদি দখিনা পবন (রাগপ্রধান), প্রেমের সমাধি তীরে (কাব্যগীতি), নিশীথে যাইও ফুলবনে (পল্লিগীতি), বধুঁগো এই মধুমাস (পল্লিগীতি) এবং ওরে সুজন নাইয়া (পল্লিগীতি)।
শুধু বাংলা গানই নয়, জনপ্রিয় বহু হিন্দি গানও সৃষ্টি হয়েছে তার হাতে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা, যায়ে তো যায়ে কাহা সমঝেগা কওন ইয়াহা, এক লাড়কি ভিগিভাগিসি, হাল ক্যায়সা হ্যায় জনাবকা, বাবু সমঝো ইশারে, ছোড় দো আঁচল, চান্দ ফির নিকলা, জীবনকে সফরমে রাহে মিলতে হ্যায় বিছাড়যানেকো এবং লতা মুঙ্গেশকর ও কিশোর কুমারের অসংখ্য সুপারহিট গান এসেছে শচীন দেব বর্মণের কাছ থেকেই।
ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৩৭ সালে সঙ্গীত জীবনের বিশ্বস্ত সঙ্গী মীরা ধরকে তিনি বিয়ে করেন। পরবর্তীতে সহধর্মিনী মীরা দেববর্মণ গীতিকার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁদের পুত্র রাহুল দেববর্মণও ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক এবং সুরকার ছিলেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে শচীন দেববর্মণ স্থায়ীভাবে মুম্বাইয়ে বসবাস করতে শুরু করেন।
বর্ণাঢ্য সঙ্গীতজীবনে ১৯৩৪ সালে বেঙ্গল সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলনে স্বর্ণপদক,১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সঙ্গীতে নাটক একাডেমি এবং এশিয়ান ফিল্ম সোসাইটি লন্ডন থেকে সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারত সরকার হতে পদ্মশ্রী খেতাব লাভ করেন। এছাড়া ১৯৫৯ সালে এশিয়া ফিল্ম সোসাইটি অ্যাওয়ার্ড,১৯৬৪ সালে সেন্ট হরিদাস অ্যাওয়ার্ড, ১৯৭০ ও ১৯৭৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৬৯ সালে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রী খেতাব লাভ।
পাশাপাশি ১৯৫৪, ১৯৭৩, ১৯৫৯, ১৯৬৫, ১৯৬৯, ১৯৭০ এবং ১৯৭৪ সালে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক এর জন্য ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন এবং ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৬৬, ১৯৬৯ ও ১৯৭৩ সালে শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন।
শৈশব
তাঁর জন্ম কুমিল্লায়, ত্রিপুরার চন্দ্রবংশীয় মানিক্য রাজপরিবারের সন্তান। বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করেন। তৎকালীন ত্রিপুরার অন্তর্গত কুমিল্লার রাজপরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। মা মণিপুরি রাজবংশের মেয়ে নিরুপমা দেবী। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ঐ কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। খ্রিস্টাব্দে ভিক্টোরিয়া কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ তে ভর্তি হন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে স্থায়ীভাবে মুম্বাইয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্যারালিটিক স্ট্রোক হয়ে কোমায় ছিলেন পাঁচ মাস। ৩১ অক্টোবর, ১৯৭৫ তাঁর প্রয়াণ হয়।
বংশ পরিচয়
কুমিল্লার ঐতিহাসিক অভয় আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক সংগীত প্রাণ প্রয়াত শ্রী পরিমল দত্তের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, শহরের চর্থা এলাকার গোল পুকুরের দণি পাড়ের এই বাড়িটি ছিল তৎকালীণ ভারতবর্ষের ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের সৎভাই মহারাজ নবদ্বীপ কুমার দেব বর্মন বাহাদুরের। ত্রিপুরার এই মহারাজার স্ত্রী ছিলেন বেশ কয়েকজন। তার মধ্যে পাটরাণী পুত্র মহারাজা নবদ্বীপ কুমার দেব বর্মন বাহাদুরকে আরেক রাণীর পুত্র বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর হত্যা করতে উঠে পড়ে লাগলে উপায়ান্তর না দেখে মহারাজ নবদ্বীপ রাজ বাড়ির কর্মকর্তা শ্রী কৈলাস সিংহের পরামর্শে সপরিবারে কুমিল্লায় চলে আসেন। জানা যায়, বিখ্যাত ‘রাজমালা’ গ্রন্থটি কৈলাশ সিংহ রচনা করেছিলেন। কৈলাস সিংহের পরামর্শে মহারাজ নবদ্বীপ সিংহাসনের দাবীও এ সময় ছেড়ে দিয়েছিলেন। কুমিল্লা শহরের পূর্ব চর্থায় অবস্থিত এ বাড়িটি তৎসময়ে নির্মিত হয়েছিল। বাড়িটি দেখতে কুমিল্লা শহরের ব্রিটিশ আমলে তৈরী বাড়িগুলোর মতোই মনে হয়। কোন রাজ প্রসাদের মত দেখতে এ বাড়িটি নয়। এই কুমার দেব বর্মন বাহাদুরের পুত্রই হলেন শচীন দেব বর্মন।
প্রাথমিক সঙ্গীত শিক্ষা
বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেব বর্মন ছিলেন একজন সেতারবাদক এবং ধ্রূপদী সঙ্গীতশিল্পী। তিনিই ছিলেন শচীন দেববর্মনের প্রথম শিক্ষক। এরপর তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা চলে উস্তাদ বাদল খান এবং ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে। ধ্রূপদী সঙ্গীতের এই শিক্ষা তাঁর মধ্যে সঙ্গীতের মৌলিক জ্ঞান সঞ্চারে গভীর ভূমিকা পালন করে। এই শিক্ষা তার পরবর্তী জীবনের সুর-সাধনায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। পরবর্তীতে তিনি উস্তাদ আফতাবউদ্দিন খানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শহরের চর্থা এলাকার শচীন দেব বর্মনের বাড়ির উল্টো দিকে অবস্থিত মুন্সি বাড়ির ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাড়ির জমিদার সালাহউদ্দিন আহম্মেদ প্রকাশ মর্তুজ মিয়ার বন্ধু ছিলেন শচীন দেব বর্মন। মর্তুজ মিয়ার পরিবারিক ইতিহাস থেকে শচীন দেবের গায়ক হওয়ার পিছনের চমকপ্রদ তথ্য জানা যায়। জানা যায়, কৈশোরে একদিন শচীন দেব বর্মন ও মর্তুজ মিয়া যখন মুন্সি বাড়ির সামনের রাস্তায় রাতের বেলায় পায়চারী করছিলেন তখন শচীন দেব গুণগুন করে গান গাইছিলেন। এ সময় বাড়ির সামনে বসা জমিদার নাবালক মিয়া বাড়ির চাকর সফর আলীকে রাস্তায় গান গাওয়া ছেলেটাকে ডেকে আনতে বললেন। সফর গিয়ে শচীন দেবকে বললেন, শচীন কর্তা আপনাকে হুজুর ডেকেছে। তখন শচীন দেব ভয় পেয়ে যায়। পরে অভয় দিয়ে তাকে ডেকে এনে নাবালক মিয়া জিজ্ঞাসা করেন, তোর তো গলা ভালো, কোন বাদ্য যন্ত্র আছে কিনা? তখন শচীন না সূচক উত্তর দিলে জমিদার নাবালক মিয়া পিয়ানো, হারমোনিয়াম, তবলাসহ সংগীতের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি কিনে তার নিজ গৃহের একটি কে সংগীত সাধনের ব্যবস্থা করে দেন। একজন তবলচি রেখে দেন।
কুমিল্লায় শচীন দেববর্মণ
বীরচন্দ্র মাণিক্যের অর্থানুকূল্যে, কুমিল্লার চর্থায় ৬০ একর জমি নিয়ে প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন কুমার বাহাদুর নবদ্বীপচন্দ্র। এই প্রাসাদে ১৯০৬ সালের পয়লা অক্টোবর তাঁর ছোট সন্তান শচীন দেববর্মণের জন্ম। ১৯১০ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঠাকুরপাড়ার সুরলোক, কান্দিরপাড়ের সবুজ সংঘ নাট্যদল, দি গ্রেট জার্নাল থিয়েটার পার্টি, ইয়ংম্যান্স ক্লাব ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছিল কুমিল্লার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। ত্রিপুরার মহারাজারা কুমিল্লায় তৈরি করেছেন টাউনহল, নাট্যশালা, লাইব্রেরি এবং নানা সংস্কৃতিক কেন্দ্র। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের দিকে শচীন দেবের বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, অজয় ভট্টাচার্য, মোহিনী চৌধুরী, সমরেন্দ্র পাল, কাজী নজরুল ইসলাম, শৈলবালা দাম, ধ্রুপদীয়া সৌরেন দাশ, সুধীন দাশ প্রমুখ। সেখানে নিয়মিত আসতেন চলচ্চিত্র পরিচালক সুশীল মজুমদার, ননী মজুমদার, ব্রজেন ব্যানার্জি, জিতু দত্ত, অরুণ মহলানবিশ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। গানের ধরণ ছিল ভোরকীর্তন, নগরকীর্তন, কবিগান, ঢপযাত্রা। সাহিত্যিক, সুরকার, গীতিকার, কবি ও সঙ্গীতজ্ঞগণ একত্রিত হতেন ইয়ংমেন্স ক্লাবে। আড্ডা থেকে ভেসে আসত নজরুল ও শচীন দেবের গান। নজরুল কুমিল্লা এলে থাকতেন তালপুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটি ঘরে। কুমিল্লা থেকে শচীন দেব কলকাতা চলে আসেন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে।
প্রথম দিকের কাজ
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে তিনি প্রথম গান করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে পিতা নবদ্বীপচন্দ্র কলকাতায় দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী। শচীন দেব তখন থাকতেন কলকাতার ত্রিপুরা প্যালেসে। নিজের লেখা ‘সরগমের নিখাদ’ নামক আত্মজীবনীতে শচীন দেববর্মণ স্বয়ং লিখেছেনঃ “পিতার মৃত্যুর পর আমি যেন অগাধ জলে পড়ে গেলাম। এই অবস্থায় আমি আগরতলা বা কুমিল্লা গিয়ে থাকলে রাজকীয় আরামে ও নিশ্চিন্তে নিজেদের বাড়িতে বাস করতে পারতাম এবং রাজ্য সরকারের কোনো উচ্চপদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম। আমার বড় ভাইরা আমাকে তাই করতে বললেন। আমার কিন্তু এ ব্যবস্থা মনঃপূত হলো না। নিজে একলা সংগ্রাম করে, নিজে উপার্জন করে সঙ্গীত সাধনায় জীবন কাটিয়ে দেব। মনের মধ্যে একমাত্র এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কলকাতার ত্রিপুরা প্রাসাদ ছেড়ে ভাড়া করা সামান্য একখানা ঘরে আমার আস্তানা বাঁধলাম।”
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অডিশনে ফেল করলেন ভারতের রেকর্ড প্রস্তুতকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এইচএমভিতে। তবে সে একই বছর তার প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয় হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস থেকে শচীন দেবের প্রথম রেকর্ডকৃত দুটি গান হল পল্লীগীতির ঢঙে গাওয়া “ডাকিলে কোকিল রোজ বিহানে” যার গীতিকার হেমেন্দ্র কুমার রায় এবং খাম্বাজ ঠুমরি অঙ্গের রাগপ্রধান “এ পথে আজ এসো প্রিয়” যার গীতিকার শৈলেন রায়। ১৯৩০-এর দশকে তিনি রেডিওতে পল্লীগীতি গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পূর্ব বাংলা এবং উত্তর-পূর্ব বাংলার পল্লীগীতির উপর তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল।
কর্মজীবন
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে অল ইন্ডিয়ান মিউজিক কনফারেন্সে তিনি গান গেয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে ঠুমরি পেশ করে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁকে মুগ্ধ করেছিলেন। শেখ ভানুর রচনা ‘নিশিথে যাইয়ো ফুলবনে’ দেহ ও সাধনতত্ত্বের গানটিকে প্রেমের গানে রূপান্তর করলেন কবি জসীমউদ্দীনকে দিয়ে এবং রূপান্তরিত এই গানটি রেকর্ড করলেন ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৩৭ এ মীরা ধরকে বিয়ে করেন। মীরা ধর ছিলেন তার সঙ্গীত জীবনের বিশ্বস্ত সঙ্গী। বাংলা গানের জগতে মীরা ধর তথা মীরা দেববর্মণ অন্যতম সার্থক গীতিকার। তাঁর লেখা গানের মধ্যে আছে শোন গো দখিন হাওয়া, বিরহ বড় ভাল লাগে, সুবল রে বল বল, বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে, কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া এবং ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে লেখা “তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল”।
প্যারালিটিক স্ট্রোক হয়ে পাঁচ মাস কোমায় থাকার পর ১৯৭৫ সালে ৩১ অক্টোবর তাঁর প্রয়াণ ঘটে। যেমনিভাবে অসাধারণ কিছু গানের জন্য কালজয়ী হয়ে আছে তার কণ্ঠস্বর। ঠিক তেমনি সুরের মায়াজালে উপমহাদেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের জাগিয়ে রাখবেন সঙ্গীতের এই পথিকৃৎ।

নিউজটি শেয়ার করুন .. ..

‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন