প্রকাশিত : শনিবার,১৫ জুন ২০২৪ ইংরেজি,১ আষাঢ় , ১৪৩১ বাংলা (বর্ষা কাল),৮ জিলহজ ১৪৪৫ হিজরি
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : সময়ের সরল প্রবাহে প্রকৃতি ক্রমশ পাল্টে যেতে থাকে স্বাভাবিক নিয়মেই। এই পাল্টাপাল্টিই হচ্ছে ঋতুর পরিবর্তন। ঋতুবৈচিত্র্যের দিক থেকে ষড়ঋতুর দেশ আমাদের সুজলা সুফলা বঙ্গভূমি। আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই নিয়ে বর্ষাকাল। রিমঝিম বৃষ্টি, একরাশ সজীবতা আর কদমফুলের সুবাস নিয়ে হাজির হয় বর্ষাকাল। পৃথিবীর আর কোনো দেশে ঋতু হিসেবে বর্ষার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা নাম নেই। এই ঋতু যেন শুধু আমাদেরই ঋতু। কদম ফুলের স্নিগ্ধ ঘ্রাণ যুগে যুগে নগরবাসী কিংবা গ্রামবাসীকে মুগ্ধ করে এসেছে। তাই বর্ষা কবিদের ঋতু, রবীন্দ্রনাথের ঋতু। বৃষ্টির সঙ্গে আমাদের প্রেম সেই আদিকাল থেকেই। বৃষ্টি আমাদের প্রথম প্রেমিক, প্রথম প্রেমিকা, বর্ষায় জমে ওঠে অনন্য প্রেম। বর্ষা নিয়ে রচিত হয়েছে কত যে গল্প, ছড়া, কবিতা, গান তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেই জন্যই হয়তো বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবিতা বর্ষার কাব্য; বর্ষাকে অবলম্বন করেই বাঙালির প্রেমের কবিতা।’ কারণ একজন কবি প্রকৃতিকে দেখেন খুব কাছ থেকে। একেবারে ভেতর থেকে বের করে আনে তার রূপ, সেই রূপের নির্যাস ঢালেন তাঁর লেখায়। তখন সেই প্রাণবন্ত লেখা শান্তির পরশ রেখে যায় আমাদের প্রাণে। এভাবে সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের প্রাণের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, মূলত প্রকৃতির সঙ্গে গড়ে ওঠে এমন সম্পর্ক যা স্থাপন করে দিতে পারেন কেবল একজন সাহিত্যিকই।
আমাদের প্রকৃতি বর্ষা এলে নতুন করে সাজে, যেন কবির ঘরে প্রবেশ করে নতুন বউ। আর সেই নতুন বউকে ঘিরে একের পর এক কবিতা লিখে যায় কবি, যেখানে থাকে প্রেম, বিরহ, অভিমান এবং রোমাঞ্চ। এসব মূলত জনজীবনেরই অংশ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তেমনই একজন সম্পর্ক স্থাপনকারী, যাঁর লেখায় সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে বর্ষা ও জনজীবনের। রবীন্দ্রনাথ জনজীবনকে দেখেছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, প্রকৃতিকে দেখেছেন হৃদয় দিয়ে। ফলে তিনি সীমার মধ্যে পান অসীমের স্পন্দন। তাই এক ফোঁটা বৃষ্টির ছোঁয়ায় কিংবা মেঘের ছায়ায় গভীর রোমান্সে ভরে ওঠে একটা কবিতা। রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাঝে বর্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন পরম ভালোবাসায়। বর্ষার গহিনের যে রূপ, তার অন্তরের যে আকুতি, বৈচিত্র্য, ছন্দ ও লয়, সবই রবীন্দ্রনাথকে আপ্লুত করেছে। সব ঋতুই তাঁর কাছে প্রিয় হলেও বর্ষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল নিঃসন্দেহে বেশি। তাঁর লেখায় রয়েছে বর্ষার আগমন, সৌন্দর্য, আক্রমণ ও প্রস্থান। বর্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন গান, কবিতা, ছড়া, গল্প এমনকি জীবনস্মৃতিও। তাঁর বর্ষাবন্দনা এতই সমৃদ্ধ যে বাংলা সাহিত্যে এমন বর্ষাবন্দনা মেলা ভার। তাই বর্ষা উদযাপনে রবীন্দ্রনাথের সম্ভবত কোনো বিকল্প নেই। বর্ষার প্রতি এই অনুরাগের কারণ সম্পর্কে নিজেই বলেছেন, “বর্ষা ঋতুটা বিশেষভাবে কবির ঋতু”। তাঁর সব কবিতা বিষয়বস্তু অনুসারে সাজানো হলে দেখা যায় বর্ষার কবিতাই সবচেয়ে বেশি, গানের ক্ষেত্রেও তাই। গীতবিতানে প্রকৃতি পর্যায়ের গানের সংখ্যা ২৮৩। এর মধ্যে বর্ষা পর্যায়ের গানের সংখ্যাই ১২০টির মতো।
এবার আসি তাঁর লেখায়। ‘মেঘদূত’ কবিতায় কবি বর্ষাদিনের জল-ছল-ছল হাওয়া-উচ্ছল রূপের ছবি এঁকেছেন এভাবে –
“আজি অন্ধকার দিবা বৃষ্টি ঝরঝর,
দুরন্ত পবন অতি,
আক্রমণে তার বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিড়ি মেঘ ভার,
খরতর বক্রহাসি শূন্যে বরষিয়া।”
এই কবিতায় কত সুন্দর করে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন বর্ষাদিনের উচ্ছৃঙ্খল বাতাসের দুরন্তপনার কথা। বিদুৎ চমকানোর মুহূর্তও যেন একেবারে ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কারো কারো মতে রবীন্দ্রনাথ মূলত ‘বর্ষা এবং নদীর কবি’৷ তাঁর অধিকাংশ কবিতা, গান ও ছোটগল্পে বর্ষার কথা ছাড়াও উপমা ও চিত্রকল্প হিসেবে এসেছে বর্ষা ও বৃষ্টি সম্পর্কিত বিষয়াবলি। ১৩২১ সনের আষাঢ় মাসে লেখা ‘আষাঢ়’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন :
“ভারতবর্ষের প্রত্যেক ঋতুরই একটা
না-একটা উৎসব আছে। কিন্তু কোন
ঋতু যে নিতান্ত বিনা কারণে তাহার হৃদয় অধিকার করিয়াছে তাহা যদি দেখিতে চাও তবে সঙ্গীতের মধ্যে সন্ধান করো। কেন না, সংগীতেই হৃদয়ের ভিতরকার কথাটা ফাঁস হইয়া পড়ে। বলিতে গেলে ঋতুর রাগ-রাগিণী কেবল বর্ষার আছে আর বসন্তের। সংগীতশাস্ত্রের মধ্যে সকল ঋতুরই জন্য কিছু কিছু সুরের বরাদ্দ থাকা সম্ভব, কিন্তু সেটা কেবল শাস্ত্রগত। ব্যবহারে দেখিতে পাই, বসন্তের জন্য আছে বসন্ত আর বাহার; আর বর্ষার জন্য মেঘ, মল্লার, দেশ এবং আরো বিস্তর। সংগীতের পাড়ায় ভোট লইলে, বর্ষারই হয় জিত।”
রবীন্দ্রনাথের গান শুনলে আমাদেরও তাই মনে হয়। প্রতি বর্ষায় তিনি রচনা করেছেন নতুন নতুন গান, যেসব আজও স্পন্দন জাগায় আমাদের মনে। বৃষ্টির ফোঁটা ঝরলেই আমরা গাইতে থাকি –
“আজি ঝর ঝর মুখর বাদলদিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতেই
কেন মন লাগে না…”
কিংবা –
“এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়,
এমন মেঘস্বর বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়…”
‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল’ হাতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন কবি। বলতেন “মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিগ-দিগন্তের পানে…” কিংবা বৃষ্টির ছোঁয়ায় যখন আনন্দে নেচে উঠত মন, তিনি গেয়ে উঠতেন :
“হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে…”
বর্ষার দিনে এসব গান গুনগুন করে বহু বর্ষাপ্রেমিক, বহু রবীন্দ্রপ্রেমিক। মনের অজান্তেই মনে জেগে ওঠে প্রেম। এমনই হৃদয়ছোঁয়া শত শত বর্ষার গান লিখেছেন তিনি।
‘বর্ষামঙ্গল’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন –
“স্নিগ্ধসজল মেঘকজ্জল দিবসে
বিবশ প্রহর অচল অলস আবেশে।
শশী তারা হীনা অন্ধতামসী যামিনী,
কোথা তোরা পুরকামিনী।
আজিকে দুয়ার রুদ্ধ ভবনে ভবনে,
জনহীন পথ কাঁদিছে ক্ষুব্ধ পবনে,
চমকে দীপ্তদামিনী।
শূন্য শয়নে কোথা জাগ পুরকামিনী।”
কবিতাটিতে কবি কত সুন্দর করে একটি বর্ষা দিন চিত্রায়ন করেছেন।
বর্ষার দিনে সব কেমন যেন স্থবির হয়ে পড়ে। সে কথা বলেছেন, ‘অপেক্ষা’ কবিতায় –
“মেঘেতে দিন জড়ায়ে থাকে মিলায়ে থাক মাঠে,
পড়িয়া থাকে তরুর শিরে,
কাঁপিতে থাকে নদীর নীরে,
দাঁড়ায়ে থাকে দীর্ঘ ছায়া মেলিয়া ঘাটে বাটে।”
তা ছাড়া ‘বর্ষার রূপ’ কবিতায় মানবজীবনের প্রবাহকে বর্ষার প্রবাহের সাথে তুলনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রবাহেরও শেষ হয়। রাজ্যের সৌন্দর্য নিয়ে যেমন হাজির হয় বর্ষা, ঠিক তেমনই একটা সময় চলেও যায়। তখনো ভালোবাসা থেকে যায় বর্ষার প্রতি, ইচ্ছে হয় আবার ফিরে পেতে। সেই ইচ্ছেটা কবির কাছে আরো প্রবল। তাই তো তিনি ‘মেঘমুক্ত’ কবিতায় ডেকেছেন চলে যাওয়া বর্ষাকে –
“মেঘ ছুটে গেল, নাই গো বাদল,
আয় গো আয়,
আজিকে সকালে শিথিল কোমল বহিছে বায়।
পতঙ্গ যেন ছবিসম আঁকা
শৈবাল-পরে মেলে আছে পাখা,
জলের কিনারে বসে আছে বক গাছের ছায়,
আজ ভোর থেকে নাই গো বাদল,
আয় গো আয়।”
এককথায় বর্ষা আর রবীন্দ্রনাথের কবিতা যেন একই ধারায় প্রবাহিত। মেঘ থেকে ঝরা বর্ষার বৃষ্টি যেমন আমাদের প্রশান্তি দেয়, তেমনিভাবে আমাদের মনকে প্রশান্তি দেয় রবীন্দ্রনাথের কলম থেকে ঝর বর্ষার কবিতা। সে কারণেই তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে আমাদের বর্ষা উদযাপনের প্রধান অবলম্বন। রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা ছাড়া আমাদের বর্ষা যেন প্রায় অসাড়, তাঁর গান ছাড়া যেন প্রেম হয়ে পড়ে স্থবির।
গদ্যেই বা কম কিসে? ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ বর্ষায় নিস্পন্দ বঙ্গদেশের থমকে দাঁড়ানো রূপটি এঁকেছেন এভাবে :
“বন্যার সময়ে গোরুগুলি যেমন জলবেষ্টিত মলিন পঙ্কি সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠ প্রাঙ্গণে মধ্যে ভিড় করিয়া করুণ নেত্রে সহিষ্ণুভাবে দাঁড়াইয়া শ্রাবণের ধারা বর্ষণে ভিজিতে থাকে, বাংলাদেশ আপনার কর্দমপিচ্ছিল ঘনসিক্ত রুদ্ধ জঙ্গলের মধ্যে মূকবিষণ্ণমুখ সেইরূপ পীড়িতভাবে অবিশ্রাম ভিজিতে লাগল। চাষিরা টোকা মাথায় দিয়া বাহির হইয়াছে; স্ত্রীলোকেরা ভিজিতে ভিজিতে বাদলার শীতল বায়ুতে সঙ্কুচিত হইয়া কুটির হইতে কুটিরান্তরে গৃহকার্যে যাতায়াত করিতেছে ও পিছল ঘাটে অত্যন্ত সাবধানে পা ফেলিয়া সিক্তবস্ত্রে জল তুলিতেছে এবং গৃহস্থ থাকিলে কোমরে চাদর জড়াইয়া, জুড়ো হস্তে, ছাতি মাথায় বাহির হইতেছে অবলা রমণীর মস্তকে ছাতি এই রৌদ্রদগ্ধ বর্ষাপ্লাবিত বঙ্গদেশের সনাতন পবিত্র প্রথার মধ্যে নাই।”
আবার যদি তাকাই ‘সমস্যাপূরণ’ গল্পে –
“ছোটো একটা নদীর ধারে হাট। বর্ষাকালে নদী পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। কতক নৌকায় এবং কতক ডাঙায় কেনাবেচা চলিতেছে, কলরবের অন্ত নাই। পণ্যদ্রব্যের মধ্যে এই আষাঢ় মাসে কাঁঠালের আমদানিই সবচেয়ে বেশি, ইলিশ মাছও যথেষ্ট। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে; অনেক বিক্রেতা বৃষ্টির আশঙ্কায় বাঁশ পুঁতিয়া তাহার ওপর একটা কাপড় খাটাইয়া দিয়াছে।”
এই গল্পটায় সুন্দর একটা চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি, আর তা হলো খেটে খাওয়া মানুষদের জীবনধারণের কিস্তি। বৃষ্টির সময় দরিদ্র মানুষগুলো বসে থাকলে চলে না। বৃষ্টিতে ভিজে হলেও তাদের বাইরে বেরুতে হয়, কাজ করতে হয়। সত্যিকার অর্থে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি থেকে বাদ পড়ে না জনজীবনের ঘরে বাইরের কোনো কিছুই। সেই জন্যই তিনি হতে পেরেছেন মহান এবং অমর।
এসব অমর কৃর্তির জন্যই তিনি বর্ষাপ্রেমিক, কবিতাপ্রেমীদের কাছে থেকে যাবেন চিরস্মরণীয় হয়ে।