প্রকাশিত:মঙ্গলবার,০৭ মে ২০১৯।২৪বৈশাখ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ।
বিক্রমপুর খবর: অনলাইন ডেস্ক : বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী আর নেই। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন দেশ বরেণ্য সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী। টানা ১৮ দিন অজ্ঞান থাকার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই কণ্ঠশিল্পীকে, বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে চারটায় মৃত ঘোষণা করেন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তাররা।
আজ মঙ্গলবার (৭ মে) ভোর ৪টায় মারা যান তিনি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত সুবীর নন্দীর কন্যা ফালগুনী নন্দীর স্বামী ডা. রাজেশ সিকদার ও তার মেয়ে ফাল্গুনী নন্দী।
প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় জনপ্রিয় এই শিল্পীকে এয়ার এম্বুলেন্সে করে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৩০ এপ্রিল সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর একাধিকবার হার্ট অ্যাটাক হয় সুবীর নন্দীর। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে শেষ পর্যন্ত বিদায় নিলেন নন্দিত এ শিল্পী।
এর আগে দেশে তার চিকিৎসার বিষয়টি সমন্বয় করেন জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন।
তিনি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, সুবীর নন্দী চিকিৎসার বিষয়ে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হয়। তারা জানিয়েছে, সুবীর নন্দীর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। তাকে ফেরানোর জন্য চিকিৎসকেরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন।
প্রসঙ্গত,একুশে পদকপ্রাপ্ত এ সংগীতশিল্পী গত ১২ এপ্রিল পরিবারের সঙ্গে মৌলভীবাজারে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যান। ১৪ এপ্রিল ঢাকায় ফিরে আসার জন্য বিকালে শ্রীমঙ্গল এসে ট্রেনে উঠেন তারা। পরে সেখানেই অসুস্থ হয়ে পড়েন সুবীর নন্দী। সেখান থেকে চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে যান পরিবারের সদস্যরা। তাৎক্ষণিক তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়।সেখানে তাকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়। এক পর্যায়ে লাইফ সাপোর্টও দেওয়া হয়।
জন্ম: ১৯৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর
জন্মস্থান: হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানায় নন্দী পাড়া
নামক মহল্লায় এক কায়স্থ সম্ভ্রান্ত সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা: সুধাংশু নন্দী
মা: পুতুল রানী
পড়াশোনা: হবিগঞ্জ গভঃ
হাইস্কুলে। স্নাতক করেছেন হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে
সঙ্গীতে হাতখড়ি: মায়ের কাছে ছয় বছর বয়সে
বেতার গান : ১৯৬৩ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে
প্রথম প্লেব্যাক: ১৯৭৬ সালে ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রে
প্রথম একক অ্যালবাম: সুবীর নন্দীর গান (১৯৮১ সাল)
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: পাঁচবার (১৯৮৪,১৯৮৬, ১৯৯৯, ২০০৪, ২০১৫)
একুশে পদক: ২০১৯
তার পিতা সুধাংশু নন্দী ছিলেন একজন চিকিৎসক ও সঙ্গীতপ্রেমী। তার মা পুতুল রানী চমৎকার গান গাইতেন কিন্তু রেডিও বা পেশদারিত্বে আসেন নি। ছোটবেলা থেকেই তিনি ভাই-বোনদের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিতে শুরু করেন ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে। তবে সঙ্গীতে তার হাতেখড়ি মায়ের কাছেই। বাবার চাকরি সূত্রে তার শৈশবকাল চা বাগানেই কেটেছে। পাঁচ-ছয় বছর বয়স পর্যন্ত বাগানেই ছিলেন। চা বাগানে খ্রিস্টান মিশনারিদের একটি স্কুল ছিল, সেখানেই পড়াশোনা করেন। তবে পড়াশোনার অধিকাংশ সময়ই তার কেটেছে হবিগঞ্জ শহরে। হবিগঞ্জ শহরে তাদের একটি বাড়ি ছিল, সেখানে ছিলেন।
১৯৬৩ সালে তৃতীয় শ্রেণী থেকেই তিনি গান করতেন। এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি সিলেট বেতারে গান করেন। তার গানের ওস্তাদ ছিলেন গুরু বাবর আলী খান। লোকগানে ছিলেন বিদিত লাল দাশ। সুবীর নন্দী গানের জগতে আসেন ১৯৭০ সালে ঢাকা রেডিওতে প্রথম রেকর্ডিং এর মধ্য দিয়ে। প্রথম গান `যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়` -এর গীত রচনা করেন মোহাম্মদ মুজাক্কের এবং সুরারোপ করেন ওস্তাদ মীর কাসেম। ৪০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গেয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি গান। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রে গেয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। চলচ্চিত্রে প্রথম গান করেন ১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত সূর্যগ্রহণ চলচ্চিত্রে। ১৯৮১ সালে তার একক অ্যালবাম “সুবীর নন্দীর গান” ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে বাজারে আসে। তিনি গানের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ব্যাংকে চাকরি করেছেন।
সুবীর নন্দীর আড়াই হাজারেরও বেশি গানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০টি গানের কথা।
১) যদি কেউ ধুপ জ্বেলে যায়: ১৯৭০ সালে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হয় সুবীর নন্দীর গাওয়া এই গানটি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এটিই ছিল সুবীর নন্দীর প্রথম প্রচারিত গান।
২) দিন যায় কথা থাকে: ১৯৭৬ সালে ‘সূর্যগ্রহণ’ সিনেমায় কণ্ঠ দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্লেব্যাক করার সুযোগ লাভ করেন সুবীর নন্দী। তবে ১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দিন যায় কথা থাকে’ সিনেমার শিরোনাম গানটি সুবীর নন্দীকে এনে দেয় তুমুল জনপ্রিয়তা। এই গানই যেন বাংলা সংগীতাঙ্গনে তার জন্য বিছিয়ে দেয় লালগালিচা।
৩) ও মাস্টার সাব: ১৯৭৮ সালে কালজয়ী বাংলা সিনেমা ‘অশিক্ষিত’ এর বিখ্যাত ‘ও মাস্টার সাব আমি দস্তখত শিখতে চাই’ গানটি ছিল সুবীর নন্দীর কণ্ঠের অন্যতম জনপ্রিয় গান।
৪) পাখিরে তুই দূরে থাকলে: সুবীর নন্দী এই তুমুল জনপ্রিয় গান গেয়েছেন ‘লাল গোলাপ’ সিনেমায়। তার ‘পাখিরে তুই দূরে থাকলে’ গানটি এখনো মুখে মুখে শোনা যায়।
৫) কত যে তোমাকে বেসেছি ভাল: ১৯৮৬ সালে ‘উছিলা’ সিনেমায় গাওয়া ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভাল’ সুবীর নন্দীর জনপ্রিয়তাকে পৌঁছে দেয় আকাশছোঁয়া জায়গায়।
৬) আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়: ১৯৮৪ সালে আলমগীর কবিরের ‘মহানায়ক’ সিনেমায় ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’ গানটিও বেশ সাড়া ফেলে তখনকার দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে। শুধু তাই নয়, এই গানটিই সুবীর নন্দীকে এনে দেয় প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
৭) পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই: ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’ও জনপ্রিয়তা পায় সমান তালে। লোকমুখে ঘুরতে থাকে এই গানগুলো।
৮) তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে: ‘শুভদা’ সিনেমায় গাওয়া এই গানটি সুবীর নন্দীকে এনে দেয় দ্বিতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
৯) একটা ছিল সোনার কন্যা: নন্দিত কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ কথার গানটি সুবীর নন্দীকে শুধু তৃতীয় জাতীয় পুরস্কারই এনে দেয়নি; বরং তাকে বাংলা সংগীতাঙ্গনে অমরত্বের স্থানে পৌঁছে দিয়েছে।
১০) ও আমার উড়াল পংখী রে: ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমারই আরেক গান ‘ও আমার উড়াল পংখী রে’ সমানতালে জনপ্রিয়তা পায়, ছড়িয়ে পড়ে লোকমুখে। নিজ কণ্ঠে গাওয়া এই গানের মতোই যেন উড়াল দিয়ে চলে গেলেন চারবার পুরস্কার পাওয়া কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী।