পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক, জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী মারা গেছেন

0
17
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক, জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী মারা গেছেন

প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল ২০২০ ইং ।। ১৫  বৈশাখ  ১৪২৭ বঙ্গাব্দ।। ৪ রমজান ১৪৪১

বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক, জাতীয় অধ্যাপক ও এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড.জামিলুর রেজা চৌধুরী (৭৭) মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।জানা যায় সোমবার মধ্যরাতে  সেহরির সময় পরিবারের সদস্যরা তাকে ডাকতে গেলে কোনো সাড়া না পেয়ে দ্রুত রাজধানী একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’

অধ্যাপক ড.জামিলুর রেজা চৌধুরীর জামাতা অধ্যাপক জিয়া ওয়াদুদ তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ঘুমের মধ্যে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর ‘ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক’হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।

জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর ভাগনে রিফাত জানান, বাদ যোহর জানাজা শেষে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

পদ্মা সেতুর প্রকল্পের মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ তদারক করছে কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে নামে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তাদের ওপরে রয়েছে অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ প্যানেল। ১১ সদস্যের এই প্যানেলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও কলম্বিয়ার সেতু বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন।এই আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্যানেলেরও নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন তিনি।  কিছু পাইল নিয়ে যে কারিগরি সমস্যা দেখা দিয়েছিলো, তা সমাধানও করেছেন তিনি দক্ষতার সাথে। এর আগে তিনি দেশের প্রথম মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে ৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ছিলেন ।

জাতীয় অধ্যাপক ড.জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৪২ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন৷ তার বাবা প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরী এবং মা হায়াতুন নেছা চৌধুরী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তার অবস্থান তৃতীয়। ড.জামিলুর রেজা চৌধুরীর শৈশবকাল বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার শৈশবকাল কেটেছে। তিন বছর বয়সে সিলেট ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে চলে যান আসামের জোড়হাটে। ১৯৪৭ সালের আগস্টে আবার সিলেটে ফিরে আসেন। এরপর তার বাবা বদলি হয়ে ময়মনসিংহে চলে যান। সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে তিনি ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য তিনি ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় )১৯৬৩ সালে তিনি প্রথম বিভাগে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন।

অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, তথ্য-প্রযুক্তিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। ২০১৮ সালের ১৯ জুন সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে যেসব বড় বড় ভৌত অবকাঠামো হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোতেই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি।

১৯৯৩ সালে যাদের হাত দিয়ে বাংলাদেশের ইমারত বিধি তৈরি হয়েছিল, জামিলুর রেজা চৌধুরী তাদের একজন।

বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফলাফল প্রকাশের কয়েকদিন পর নিয়োগপত্র ছাড়াই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন পুরকৌশল বিভাগে। এভাবেই তার শিক্ষকতা জীবন শুরু হল। ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বার্মাশেল বৃত্তি নিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডে। এই বৃত্তি বছরে একটাই দেয়া হতো। সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমএসসি করেন, অ্যাডভান্স স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। থিসিসের বিষয় ছিল, কংক্রিট বিমে ফাটল। ১৯৬৮ সালে তিনি কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন অব হাইরাইজ বিল্ডিং বিষয়ের উপর পিএইচডি করেন। পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে তিনি বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এর পর ১৯৭৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক ও ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০১ সাল পর্যন্ত বুয়েটে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে কখনো বিভাগীয় প্রধান ছিলেন, ডিন ছিলেন। বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক ছিলেন প্রায় ১০ বছর। ১৯৭৯ সালে ব্যাংককে UNESCAP- এ কয়েক মাস পরামর্শক হিসেবে ছিলেন। ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং এসোসিয়েট প্রফেসর ছিলেন। ২০০১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিআইটির গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন যুক্তরাজ্যের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের ফেলো। যুক্তরাজ্যের একজন চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার, বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটির ফেলো। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটি এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা), বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷অধ্যাপক চৌধুরী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনের সফটওয়্যার রফতানি এবং আইটি সার্ভিস রপ্তানী-সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি টাস্কফোর্সের একজন সদস্য। এছাড়া তিনি আরো অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ চলমান নানা উন্নয়ন প্রকল্পেও বিশেষজ্ঞ প্যানেলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এই অধ্যাপক।

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০১৭ সালে একুশে পদক,২০১০ সালে শেলটেক পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন স্বর্ণপদক, ১৯৯৭ সালে ড. রশিদ স্বর্ণপদক, ২০০০সালে রোটারি সিড অ্যাওয়ার্ড,লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল (ডিস্ট্রিক-৩১৫) স্বর্ণপদক,ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি একটি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল বিষয়ের ওপর এ ধরনের ডিগ্রি পেয়েছেন এছাড়া জাইকা রিকগনিশন অ্যাওয়ার্ড  সহ অসংখ্য সম্মাননা লাভ করেন।

অধ্যাপক ডা.জামিলুর রেজা চৌধুরীর তার স্ত্রীর নাম সেলিনা নওরোজ চৌধুরী; তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র থেকে ফলিত পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রিধারী৷ ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক; বড় সন্তান (মেয়ে) কারিশমা ফারহিন চৌধুরী পেশায় পুরকৌশলী এবং ছোট সন্তান (ছেলে) কাশিফ রেজা চৌধুরী ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রী করেছেন৷

জাতীয় অধ্যাপক ডা.জামিলুর রেজা চৌধুরী সবশেষ বর্তমানে তিনি  ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া পাসিফিকের  উপাচার্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন