প্রকাশিত:মঙ্গলবার,২২ জানুয়ারি ২০১৯।
বিক্রমপুর খবর::অনলাইন ডেস্ক: ‘তাড়াতাড়ি বাসায় আস, আমার হার্টঅ্যাটাক হয়েছে।’ ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে হাজারও জনপ্রিয় গানের সুরস্রষ্টা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের শেষ কথা ছিল এটি। ভোর ৪টার দিকে এ কথা বলার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে পরপারে চলে যান বুলবুল।
জনপ্রিয় এ শিল্পীর ব্যক্তিগত সহকারী রোজেন জানান, ভোর ৪টার দিকে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল মুঠোফোন থেকে তাকে ফোন করেন। বলেন, তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে,তার হার্টঅ্যাটাক হয়েছে।
রোজেনের ভাষ্য-ভোর ৪টার দিকে স্যার ফোন করে বলেন,তাড়াতাড়ি বাসায় আসো, আমার হার্টঅ্যাটাক হয়েছে।এর পর ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে আমি স্যারের বাসায় যাই।কিন্তু গিয়ে তার কোনো পালস পাইনি।
রোজেন জানান,পরে বুলবুলকে দ্রুত রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে) নিয়ে যাওয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা তাকে সাড়ে ৫টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন। বুলবুলের সঙ্গে তার কোনো কথা বলার সুযোগ হয়নি বলে জানান রোজেন।
হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা.আশীষ চক্রবর্তী জানান,আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মৃত্যু হয়েছে হার্টঅ্যাটাকে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা এটিই নিশ্চিত হয়েছেন। হাসপাতালে আনার আগেই তিনি মারা যান।
জানা গেছে,দীর্ঘদিন ধরে হার্টের অসুখে ভুগছিলেন কিংবদন্তি সংগীত ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। গত বছরের মাঝামাঝি বুলবুলের হার্টে আটটি ব্লক ধরা পড়ে। তার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে পেরে চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর বুলবুলকে ভর্তি করা হয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। সেখানে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা বুলবুলের বাইপাস সার্জারি না করে রিং পরানোর সিদ্ধান্ত নেন। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা.অধ্যাপক আফজালুর রহমানের অধীনে বুলবুলের শরীরে দুটি স্টেন্ট(রিং)স্থাপন করা হয়।রিং পরানো শেষে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন বুলবুল।
এর পর থেকে তিনি বাসাতেই বেশি সময় কাটাতেন।গানে আর তাকে দেখা যায়নি। তার জীবনযাপনেও বেশ পরিবর্তন আসে।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলী বাদল’ ছবিতে সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। তিনি স্বাধীনভাবে গানের অ্যালবাম তৈরি করেছেন এবং অসংখ্য চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন।
সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আবদুল হাদি, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, আগুন, কনকচাঁপাসহ বাংলাদেশি প্রায় সব জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীর গাওয়া বহু জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা তিনি। ১৯৭৬ সাল থেকে তার নিয়মিত গান করা। প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি গান লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন। চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করে দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।
এই জনপ্রিয় শিল্পীর জন্ম ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায়। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বুলবুল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাইফেল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রণাঙ্গনে। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ স্মৃতি-বিস্মৃতি নিয়ে বহু জনপ্রিয় গান লিখেছেন ও সুর করেছেন।
‘এই দেশ আমার সুন্দরী রাজকন্যা’, ‘আয় রে মা আয় রে’, ‘উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম’, ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে, ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সেই রেললাইনের ধারে’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না’-এমন বহু কালজয়ী গানের স্রষ্টা এ শিল্পী।
তিনি প্রেমের জন্য লিখেছেন- ‘আমার সারা দেহ খেও গো মাটি’, ‘ভাড়া কইরা আনবি মানুষ’, ‘প্রেমের তাজমহল’সহ আরও বহু জনপ্রিয় গান।
উল্লেখযোগ্য আরো কিছু রচিত গান–
সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য, ও আমার আট কোটি ফুল দেখ গো মালি, একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না, আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি, আমার বুকের মধ্যেখানে, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন, আমি তোমারি প্রেমও ভিখারি, ও আমার মন কান্দে, ও আমার প্রাণ কান্দে, আইলো দারুণ ফাগুনরে, আমার একদিকে পৃথিবী একদিকে ভালোবাসা, আমি তোমার দুটি চোখে দুটি তারা হয়ে থাকবো, আমার গরুর গাড়িতে বৌ সাজিয়ে, পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে যেন পেয়েছি, তোমায় দেখলে মনে হয়, হাজার বছর আগেও বুঝি ছিল পরিচয়, কত মানুষ ভবের বাজারে, তুই ছাড়া কে আছে আমার জগৎ সংসারে, বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম, আম্মাজান আম্মাজান, স্বামী আর স্ত্রী বানায় যে জন মিস্ত্রি, আমার জানের জান আমার আব্বাজান, ঈশ্বর আল্লাহ বিধাতা জানে, এই বুকে বইছে যমুনা, সাগরের মতই গভীর, আকাশের মতই অসীম, প্রেম কখনো মধুর, কখনো সে বেদনা বিধুর, আমার সুখেরও কলসি ভাইঙ্গা গেসে লাগবে না আর জোড়া, পৃথিবীর জন্ম যেদিন থেকে, তোমার আমার প্রেম সেদিন থেকে।পড়ে না চখের পলক, যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, কী আমার পরিচয়, অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে, তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন, তোমার আমার প্রেম এক জনমের নয়, তুমি হাজার ফুলের মাঝে একটি গোলাপ, জীবনে বসন্ত এসেছে, ফুলে ফুলে ভরে গেছে মন, ঘুমিয়ে থাকো গো স্বজনী, আমার হৃদয় একটা আয়না, ফুল নেব না অশ্রু নেব, বিধি তুমি বলে দাও আমি কার, তুমি মোর জীবনের ভাবনা, হৃদয়ে সুখের দোলা, তুমি আমার এমনই একজন, যারে এক জনমে ভালবেসে ভরবে না এ মন।
উত্তরে ভয়ঙ্কর জঙ্গল দক্ষিণে না যাওয়াই মঙ্গল, কোন ডালে পাখিরে তুই বাঁধবি আবার বাসা, একাত্তুরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল আগুন, বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয় এখানে সভ্যতারই ফুল ফোটানো হয়, আমায় অনেক বড় ডিগ্রি দিসে, এই জগৎ সংসারে তুমি এমনই একজন, জীবন ফুরিয়ে যাবে ভালবাসা ফুরাবে না জীবনে, পৃথিবীতো দু দিনেরই বাসা, দু দিনেই ভাঙে খেলাঘ, অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন, ওগো সাথি আমার তুমি কেন চলে যাও, তুমি সুতোয় বেঁধেছ শাপলার ফুল নাকি তোমার মন, একদিন দুইদিন তিনদিন পর, তোমারি ঘর হবে আমারি ঘর, কী কথা যে লিখি, কি নামে যে ডাকি।নদী চায় চলতে, তারা যায় জ্বলতে, চতুর্দোলায় ঘুমিয়ে আমি ঘুমন্ত এক শিশু, চোখের ভেতর কল বসাইছে, আমার জীবন নায়ে বন্ধু তুমি প্রাণের মাঝি, তুমি স্বপ্ন তুমি সাধনা, নদী চায় চলতে, তারা যায় জ্বলতে, আকাশটা নীল মেঘগুলো সাদা সাদা, আমার তুমি ছাড়া কেউ নেই আর, শেষ ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে আবার কেন পিছু ডাকো, চিঠি লিখেছে বউ আমার, মাগো আর নয় চুপি চুপি আসাসহ আরও অনেক গান।
ব্যক্তিগত জীবনে এক সন্তানের জনক ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তার ছেলে সামির আহমেদ।
তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে শিল্পাঙ্গনে। শোকে স্তব্ধ গানের জগতের লোকজন।
বুলবুল রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।